গণিতে পঞ্চাশ পাওয়ায় এক শিক্ষক তাকে বলেছিলেন, 'তুই তো অঙ্ক পারিস না, আর্টস বা কমার্স নে, ভালো করবি।' একটা জেদ চেপে গিয়েছিল ছেলেটার মনের ভেতরে, গণিতের ভয়কে জয় করার জেদ...
অঙ্কে খুব একটা ভালো ছিল না ছেলেটা। ক্লাস এইট থেকে নাইনে ওঠার সময় এক শিক্ষক তাকে বললেন, 'তুই তো অঙ্কে কাঁচা, তোর সায়েন্স পড়ার দরকার নেই, বরং আর্টস বা কমার্স নে, ভালো করবি।' ছেলেটার স্বপ্নজুড়ে ছিল সে সায়েন্সে পড়বে, বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি সম্পর্কে জানবে। শিক্ষকের এই পরামর্শটা খুব গায়ে লাগলো তার। জেদ চেপে গেল, অঙ্ককে বশে আনতেই হবে। তীর ছোঁড়ার জন্যে ধনুকে তীর গেঁথে যেমন পেছনের দিকে টান দিয়ে ধরতে হয়, সেরকম ছেলেটাও নিজেকে পিছিয়ে নিয়ে গেল। ক্লাস সিক্স-সেভেনের বইগুলো দিয়ে আবার সে শুরু করলো 'মিশন অঙ্ক'। মাঝে অনেককিছুই ঘটে গেছে, সেই গল্পগুলো একটু পরে বলছি। তার আগে বর্তমান পরিচয়টা জানিয়ে দেই। সেই ছেলেটাকে আমরা এখন চমক হাসান নামে চিনি, অনেকের কাছেই যার আরেক না 'অঙ্ক ভাইয়া'!
হ্যাঁ, অলরাউন্ডার চমক হাসানের কথাই বলছি, গণিতকে ভয়ের জায়গা থেকে সরিয়ে আনন্দের একটা বিষয়ে পরিণত করার জন্যে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন যে মানুষটি। অনেকেই তাকে গণিত শিক্ষক হিসেবে চেনে, চমক হাসান কিন্ত এই পরিচয়টা একদমই পছন্দ করেন না। তিনি গনিতের আনন্দ ছড়িয়ে বেড়ান, অঙ্ক জিনিসটা যে মোটেও ভয়ের কিছু নয়, বরং দারুণ মজার জিনিস- সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করেন তিনি। আর সেজন্যেই ইউটিউবে নিজের চ্যানেলে 'গণিতের রঙ্গ' বা 'চটপট গণিত' নামের সিরিজ বানান, 'ডিজে পিথাগোরাস' টাইটেলের র্যাপ গান গেয়ে ফেলেন, যেটার কথা ও সুর আবার তারই!
গণিত বিষয়টা চমক হাসানের কাছেও একটা সময়ে ভয়ের নামই ছিল। ক্লাস নাইনের ওই ঘটনার পরে তিনি আদাজল খেয়ে নামলেন সেই ভয়কে জয় করার জন্যে। বুয়েটে ভর্তি হবার পরে গণিত অলিম্পিয়াডের সঙ্গে যুক্ত হলেন, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের সংস্পর্শে এলেন। অলিম্পিয়াডের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটা ক্যাম্প করা হয়েছিল যেখানে গণিতের একটা অংশ শেখানোর দায়িত্ব পান তিনি৷ সেই থেকে শুরু৷
বুয়েটের পড়ালেখা শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্যে তিনি চলে গেলেন আমেরিকায়। কিন্ত যে কাজটা তাকে আনন্দ দিতো, তাকে উৎফুল্ল রাখতো, সেটাকে ভীষণ মিস করা শুরু করলেন তিনি। ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে আসার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিলেন ইউটিউবকে। ২০১২ সালের কথা সেটা। ইউটিউবে গণিতের ওপরে ভিডিও বানিয়ে আপলোড দিতে থাকলেন চমক হাসান, শুরু করলেন 'গণিতের রঙ্গে' সিরিজটা দিয়ে। আমাদের স্কুল-কলেজগুলোতে যেভাবে গণিতটা পড়ানো হয়, সেটা উপভোগ্য কখনোই হয়ে ওঠে না। বরং গণিতের প্রতি একটা বিবমিষা জন্ম নেয়। একারণেই অসংখ্য শিক্ষার্থী অঙ্ক না বুঝে শুধু ফর্মূলাটা মুখস্ত করারও চেষ্টা করে। আমাদের বেশিরভাগ শিক্ষকও এই জায়গাটায় ভীষণ উদাসীন, গণিতের মধ্যে যে দারুণ মজা লুকিয়ে থাকতে পারে, সেটা তারা আমাদের কখনও জানাননি। কে জানে, হয়তো তারা নিজেরাও জানেন না গণিতের এই রস সম্পর্কে!
চমক হাসান গণিতের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সেই 'মজার' সন্ধান দিতে নামলেন। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়লো তার ইউটিউব চ্যানেল, তার বানানো ভিডিওগুলোর ভিউ বাড়তে থাকলো। সেসব ভিডিওতে গল্পের ছলে তিনি অঙ্কভীতি দূর করার চেষ্টা করেছেন, হাতে ধরে সহজ ভাষায় বুঝিয়েছেন জ্যামিতি, ক্যালকুলাস কিংবা শূন্যের ইতিবৃত্ত- সবকিছুই সহজ ভাষায় বোঝানোর চেষ্টা করেছেন তিনি সেসব ভিডিওতে। ছাত্র-ছাত্রীরাও অন্যরকম এক শিক্ষকের দেখা পেয়ে লুফে নিলো তাকে। এই শিক্ষক বকা দেন না, বেতের বাড়ির ভয় দেখান না, একটু অন্য নিয়মে অঙ্ক করলে কেটে 'জিরো' বসিয়ে দেন না- তার ওপরে ভীষণ মজা করে কথা বলেন, অঙ্ক নিয়ে গানও শোনান- তাকে ভালো না বেসে উপায় আছে?
গত ছয় বছর ধরে চমক হাসান তার ইউটিউব চ্যানেলে অঙ্ক নিয়ে অজস্র ভিডিও বানিয়েছেন, সেগুলো ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে সমাদৃতও হয়েছে দারুণভাবে। তবে শুধু অঙ্কই নয়, আরও অনেক অনেক জায়গায় তিনি দারুণ পারদর্শী। তার গানের গলা চমৎকার, বুয়েটে পড়ার সময়ে 'সুয়া চান পাখি' গানটা কোন শিল্পী গাইলে কেমন হতো, সেটাই বন্ধুদের দেখিয়েছিলেন মজা করে। কোন এক বন্ধু সেটা ভিডিও করে ফেসবুকে আপলোড করে দিয়েছিলেন, সেটাও অনেক আগের কথা। সেই ভিডিও ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল, যারাই দেখেছেন, চমকের গায়কী এবং অভিব্যক্তি দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়েছেন নিশ্চিত!
গণিত অলিম্পিয়াডের যে থিম সং, সেটা তার লেখা। 'মন মেলে শোন, শুনতে পাবি...' শিরোনামের সেই গানটা প্রতিটা গণিত উৎসবেই গাওয়া হয়। এর বাইরেও তিনি নিজের লেখা গানে সুর করে গেয়েছেন। কিছুদিন আগেও 'সাড়ে আট হাজার মাইল দূরে' শিরোনামের একটা গান গেয়েছিলেন, দেশ থেকে অনেক দূরে থাকার কষ্টটা ফুটিয়ে তুলেছিলেন সেই গানে। ডিজে পিথাগোরাস নামের একটা র্যাপ গানও বানিয়েছেন কিছুদিন আগে। যে পিথাগোরাসের উপপাদ্য ছিল আমাদের কাছে আতঙ্ক, সেই পিথাগোরাস আর তার উপপাদ্যকেই হাসির ছলে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন চমক হাসান।
যে ভালো রাঁধে, সে নাকি চুলও বাঁধে। এত গুণ যে মানুষটার, তিনি আবার দারুণ লেখেনও। বেশ কয়েকটি বই বেরিয়েছে তার, হাসিখুশী গণিত নামের একটা বই আছে তার, 'গল্পে গল্পে জেনেটিক্স' নামেও একটা বই লিখেছেন তিনি। সবশেষ বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে চমক হাসানের নতুন বই- 'নিমিখ পানে: ক্যালকুলাসের পথে পরিভ্রমন’। আমাদের জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে ক্যালকুলাস কিভাবে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, সেটাই তিনি বলেছেন এই বইতে।
তড়িৎকৌশলের ওপরে পিএইচডি করা চমক হাসান এখন 'বোস্টন সায়েন্টিফিকে' কাজ করছেন গবেষণা ও উন্নয়ন প্রকৌশলী হিসেবে। বাংলাদেশেও এখন দারুণ জনপ্রিয় তিনি, ঢাকার রাস্তায় অনেকেই দেখলে চিনতে পারেন তাকে, সেলফি তুলতে চান। দেশে ফিরে কিছু করবেন, সেই ইচ্ছেটা তার অনেকদিনের। চমক হাসান বলছিলেন-
"আমার ইচ্ছে আছে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর, নিজের গবেষণা ক্ষেত্রটাকে এগিয়ে নেওয়ার। এর সাথে গণিত ও বিজ্ঞানের উপর বই লেখা, ভিডিও করা চালিয়ে যাব। গণিত-বিজ্ঞান নিয়ে গণমাধ্যমে অনুষ্ঠান করারও পরিকল্পনা আছে। গণিত আর বিজ্ঞানের জন্য ভালোবাসাকে প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলগুলোতে পৌঁছে দিতে চাই। একটা সুস্পষ্ট রূপরেখা দাঁড়া করাতে চাই যেন, ৪৮৮ টি উপজেলায় ৪৮৮ টা গণিত ক্লাব প্রতিষ্ঠা করা যায়, এরপর সেখান থেকে সাড়ে চার হাজার ইউনিয়ন পরিষদে মানুষের কাছে গণিত আর বিজ্ঞানের আনন্দ তুলে ধরা যায়।"
অঙ্ক জিনিসটা যে এত মজার হতে পারে, সেটা আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের অনেকেই হয়তো জানতেও পারতেন না, যদি চমক হাসান না থাকতেন। দেশে ফিরে তিনি আরও বড় পরিসরে কাজ করার যে স্বপ্নটা তিনি দেখছেন, সেটা পূরণ হলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের অঙ্কভীতি দূর হতে সময় লাগবে না খুব বেশি। সেই ভীতি দূর করার জন্যে একজন 'অঙ্ক ভাইয়া' তো আছেন!