বেশিরভাগ পুরুষের ধারণা, নরমাল ডেলিভারি হলে নারীর যোনীপথের ইলাস্টিসিটিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। যৌন আনন্দের ব্যাপারটি আর পুরোপুরি উপভোগ করা যায় না...

বাংলাদেশের বিশাল সংখ্যক পুরুষের স্ত্রীদের সাথে যৌনচিন্তায় মারাত্মক দৈন্যতা আছে। তাদের ধারণা নরমাল ডেলিভারি (ভ্যাজাইনাল ডেলিভারি) হলে যোনীপথের ইলাস্টিসিটিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। যৌন আনন্দের ব্যাপারটি আর পুরোপুরি উপভোগ করা যায় না। আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিতে হাসপাতালে সিজারিয়ান সেকশনের অন্যতম প্রধান কারণ- কিছুসংখ্যক (পরিমানটা বিশাল) স্বামীদের যৌন-মানসিক দৈন্যতা। 

যেখানেই গেছি, একটু খোলাসা করে কথা বলার পরিবেশ তৈরি হলেই এমন অদ্ভুত যুক্তি আমি পেয়েছি। বিয়ের আগেই ঠিক করে রাখে, তারা স্ত্রীদের কখনোই নরমাল ডেলিভারিতে যেতে দিবে না। অনেক বিবাহিত স্বামী স্ত্রীদের কাউন্সেলিং করে রাখে সিজারের জন্য। স্ত্রীরা মায়ের জাতি। জন্মের পরপরই তাদের অনেকগুলো স্বপ্নের একটা হল- একদিন সন্তানের মা হবে। অল্পবয়স থেকে তারা ছোট বাচ্চাদের সাথে ইন্টিমেট হয়। আদর করতে শুরু করে। এই আদরের উৎস তাদের মাতৃত্ব। তাদের হরমোন তাদের ছোট্টকাল থেকেই মা হতে শেখায়। তারা বেড়ে ওঠতে থাকে আর তাদের চিন্তারা ক্রমশ পরিবর্তন হয়। 

সিনেমায় নিষ্ঠুর নরমাল ডেলিভারি দেখে তারা কখনো ব্যাথাহীন সিজার চায়, কখনো নিকটাত্মীয় নারীদের সিজারের পোস্ট সার্জিক্যাল কম্পলিকেশন দেখে নরমাল ডেলিভারি চায়। স্বামীর এক অভিমত, শাশুড়ির আলাদা অভিমত, নিজের বাবা-মা তো আছেই। যার পেটে বাচ্চা, তার আর অভিমত নেওয়া হয় না। 

ফেসবুকে কিছু হুজুরের ভাষণ ভাইরাল হয়েছে। অসৎ সন্তান নরমালে হয়, সৎ বাচ্চা হতে কেন সিজার লাগে। এই শ্রেণির হুজুররা সাধারণত সমালোচনা করতে মজা পায়। তারা গাইনী-অবস ব্যাপারে বিন্দুমাত্র জানে না। তারা জানে না, বাচ্চার সাইজ বড় হলে জন্মের সময় মায়ের যোনীপথ, জরায়ু ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। এমন পরিস্থিতি হলে সিজার একমাত্র পথ। তারা জানে না, বাচ্চা স্বাভাবিক থাকার পরেও শুধুমাত্র মায়ের বার্থ ক্যানাল যথেষ্ট বড় না হলে সিজারে যেতে হবে। না গেলে বাচ্চাও মারা যাবে, বাচ্চার মায়ের বার্থ ক্যানাল ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তারা জানে না, গর্ভাবস্থায় যদি মায়ের আকস্মিক হাইপ্রেশার জন্ম নেয়, ঘনঘন অজ্ঞান বা খিঁচুনি হয়, তখন আর কিছু না চিন্তা করে অটিতে নিয়ে সিজার করা হয়। এক্ষেত্রে বাচ্চার বয়স বিবেচনায় রাখা হয়না। এমনকী বাচ্চা মারা গেলেও না। আগে মায়ের জীবন।

এতসব ব্যাপার-স্যাপার আল্টাসনোগ্রামসহ নানাবিধ নিরীক্ষার পর অবসটেট্রিশিয়ানে সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে, বাচ্চা নরমাল ডেলিভারি হবে নাকি সিজার হবে। আমরা জনগণ সারাজীবন নরমালের স্বপ্ন দেখলেও ডাক্তারের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত। মায়ের পেটে সন্তানের ব্রিচ প্রেজেন্টেশন থাকতে পারে, বাচ্চার অস্বাভাবিক অবস্থান, জমজ বাচ্চা, মায়ের কার্ডিওমায়োপ্যাথি, জেনিটাল হার্পিস, প্লাসেন্টা জরায়ুর একেবারে নিচে থাকা, জরায়ুর চিড় সবকিছুই থাকতে পারে। এসব ক্ষেত্রে নরমাল ডেলিভারিরি কথা চিন্তা করা আর মায়ের জীবন, বাচ্চার জীবন নিয়ে খেলা করা একই কথা। তবে সব ঠিকঠাক যদি থাকে। 

তবে মা যদি চায়, সেভাবেই ডাক্তার এগোবে। বাবা নয়। পরিবার নয়। মায়ের কথা চিকিৎসাশাস্ত্রে স্পষ্ট বলা আছে। তাতে স্বামীর যদি যৌন দৈন্যদশাও সৃষ্টি হয়, ভাবার সময় নাই। অলয়েজ মাম ইজ ফার্স্ট কনসিডারেশন। আজকাল সিজার বেড়ে গেছে। বেড়ে যাবার ফলে মাতৃমৃত্যুও কমে গেছে, খেয়াল করেছেন? আমরা যখন ৯০ তে প্রাইমারিতে পড়তাম, তখন গ্রামে প্রত্যেক মাসেই এক দুই মা মারা যেত বাচ্চা জন্ম দিতে। আমার মা বলত, জান্নাতুল ফেরদৌসে যাবে। মহিলার ভাগ্য ভালো। ডেলিভারিতে মারা গেছে। তখন মাতৃমৃত্যু এতটাই স্বাভাবিক ছিল। মৃত্যুটাও আনন্দের ছিল। আপনার চারপাশে অনেকেই আছে, খেয়াল করুন, তাদের মা মারা গেছে জন্মের সময়। পুরাতন সিনেমাগুলোও দেখবেন, একই সিনারিও। বাচ্চা বেঁচে গেল কিন্তু মা নেই। এখন এই সিনারিওগুলো নেই। কেন এসব হচ্ছে? 

সিজার এককালে সময়ের দাবী মেটাতে বাংলাদেশে এসেছিল। এরপর দাবী মেটানো আর শেষ হয়নি। একশো হাইকোর্ট রুল জারি করলেও সিজার কমাতে পারবেন না। এটা একজন মায়ের এবং সন্তানের বেঁচে থাকার বিষয়। তাদের যেটা সবচেয়ে ভালো, ডাক্তার সেটা করতে বাধ্য। যদি ভ্যাজাইনাল ডেলিভারিতে মায়ের মৃত্যুর চান্স থাকে, আপনি যতই বলুন সেই চিকিৎসক আপনার স্ত্রীর ভ্যাজাইনাল ডেলিভারি করবে না। হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দিবে। তখন সংবাদ মাধ্যমে আরো বাজেভাবে ব্যাপারগুলো চলে আসবে। আপনার ধারণা হবে, ডাক্তার কসাই। টাকার জন্য ভ্যাজাইনাল ডেলিভারি করল না। বাচ্চার ডাক্তারকে আগে সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ দিতে হবে। এরপর বাচ্চার মা সিদ্ধান্ত নিবে। এরপর তার পরিবার। কিন্তু ডাক্তার যদি যথাযথ কারণ দেখাতে পারেন, সেটাই ফাইনাল ফুলস্টপ। 

রোগীমৃত্যু এবং ডাক্তার পেটানোর ঘটনাগুলো বাড়ার পর দেশের ডাক্তাররা নিজেদের আজকাল 'মানুষ' হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। তাহলে তাদেরকে স্বীকার করেও নিতে হবে ডাক্তাররাও অমানুষ হয়, নষ্ট হয়, খারাপ হয়। তাদের মধ্যে বিশাল সংখ্যক ডাক্তার আছে যারা পেট কেঁটে শুধু বাচ্চা বের করে না, গলাকেটে টাকাও বের করে নেয়। রোগীর কিছুই বলার থাকে না। কিছুই করার থাকে না। রোগী নিজেও জানে না তাকে কোরবানীর খাসি বানানো হয়েছে। কারণ হাসপাতালে আসলে মন্ত্রীও অসহায়। ডাক্তার যা করবে তাই মেনে নিতে হয়।

অপ্রয়োজনীয় সিজার কীভাবে কমাবেন? 

  • ১. সরকারি হাসপাতালে সিজারের চেয়ে নরমাল ডেলিভারি বেশি হয়। মাকে সেখানে নিতে পারেন। বিনাকারণে কেউ আপনার সিজার করবে না। 
  • ২. সরকারি হাসপাতালের পরিবেশ খারাপ, নোংরা। তাহলে হাইকোর্টে রিট করে লেবার ওয়ার্ডকে বেসরকারির মতো পরিবেশ নিশ্চিত করা যেতে পারে। কিংবা সরকারি মেডিকেলের মানের আইসিইউ লেভেলের পরিবেশ আনা যেতে পারে। 
  • ৩. নরমাল ডেলিভারিতে কষ্ট আছে সত্য, কিন্তু সন্তানের লাভও আছে। এটা বাচ্চার মা কে, বাবাকে বোঝানো যেতে পারে। 
  • ৪. অনেক সময়ই সিজার করতে হয়। কেন করতে হয় ডাক্তার এটা ডিটেইল রোগীর লোককে বোঝাবে। রোগীর লোক আরেকজন ডাক্তারের কাছে মতামত নিতে পারে, ঘটনা সত্য নাকি মিথ্যা। কারণ এদেশে সবচেয়ে বড় ব্যবসা হল সিজার এবং প্রাইভেট মেডিকেলগুলোতে বাচ্চা জন্মের পরপরই 'বাচ্চার অবস্থা খারাপ' বলে যেকোনোভাবে NICU তে ঢোকানো হয়। এরা ১৫ হাজার টাকায় সিজারের কথা বলে ডেকে এনে পকেট থেকে দশ বিশ লাখ গায়েব করে দেয় শুধুমাত্র বাচ্চার অবস্থা খারাপ বলে। 

এজন্য দরকার নতুন কোন ইনিসিয়েশন। বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকে কড়া নজরদারী। [দক্ষিনবঙ্গে আমরা ডাক্তাররা খ্যাপ মারতে যাই। অল্পসময়ে ভাল ইনকাম করতে। কারন সরকার আমাদের ভাতা দেয়না। আমরা টিকে থাকতে, বাধ্য হয়ে যাই। আমরা জানি, এসব ক্লিনিক টিকেই আছে সিজারের উপর। কেউ আসলেই তাকে অটিতে ঢোকানোর নিয়ম এখানে। পেটে ব্যাথা হলেই এপেন্ডিসাইটিস হয়েছে বলেও অপারেশন করে ফেলা হয়। আমি নিজের চোখে দেখেছি। অথচ মেয়েটির কিছুই হয়নি] এবার ভাবুন আপনিই।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা