লাইলি-মজনু থেকে শুরু করে শিরি-ফরহাদ; প্রেম নিয়ে পাগলামির কত গল্পই তো শোনা যায়। কিন্তু এই কাহিনীটা এতটাই কিম্ভুৎকিমাকার যে তা পৃথিবীতে প্রেম নিয়ে করা সব ধরণের পাগলামিকেই ছাড়িয়ে যাবে!

প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে কতশত পাগলামির কাহিনীই তো শোনা যায়। সেই লাইলি-মজনু থেকে শুরু করে শিরি-ফরহাদ, কতশত গল্পই তো শোনা যায়। কিন্তু যে কাহিনীটা বলতে যাচ্ছি তা এতটাই কিম্ভুৎ যে সম্ভবত তা পৃথিবীতে প্রেম নিয়ে করা সব ধরণের পাগলামিকেই ছাড়িয়ে যাবে! চলুন শোনা যাক সেই কাহিনী...

জনশ্রুতি অনুসারে, কার্ল টেঞ্জলার ১৮৭৭ সালে জার্মানির ড্রেসডেনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অস্ট্রিয়াতে ১৯১০ সালে আবহাওয়া বিষয়ে লেখাপড়া করেন এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত সেখানেই থেকে যান। দেশে ফিরে ১৯২০ সালে টেঞ্জলার বিয়ে করেন এবং দুটি সন্তানের জনক হন। এরপর তিনি অভিবাসী হিসেবে আমেরিকার ফ্লোরিডাতে গমন করেন।

আমেরিকার মেরিন হসপিটালে রেডিওলজিক টেকনিশিয়ান হিসেবে জয়েন করার পর তিনি তার পরিবার ও নাম ত্যাগ করেন এবং কাউন্ড কার্ল ভন ক্যাসেল নাম নিয়ে সেখানে কাজ করতে থাকেন। কিছুদিন পরে সেই হাসপাতালেই তার সাক্ষাৎ হয় মারিয়া এলেনা মিলাগ্রো ডি হোয়োস নামের কিউবান বংশোদ্ভূত এক আমেরিকান মহিলার সাথে। প্রথম দেখাতেই টেঞ্জলারের মনে হয় এতদিনে তার স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। যখন জার্মানিতে ছিলেন, তরুণ টেঞ্জলার প্রায়ই কল্পনা করত কালো চুলের একজন সুন্দরী মেয়েকে, যে সত্যিকারের ভালবাসা হয়ে তার জীবনে নেমে আসবে।

টেঞ্জলার

হোয়োস তার ২২ বছর বয়সে কল্পনায় দেখা সেই সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। হোয়োসকে দেখা মাত্রই টেঞ্জলার তার প্রেমে পড়ে যান। টেঞ্জলারের কাছে মনে হয় তারা বুঝি দুজন-দজনার জন্যেই জন্মেছে। কিন্তু বিধি বাম, টেঞ্জলারের আশা নিরাশায় পরিণত হয় যখন তিনি জানতে পারেন হোয়োস যক্ষায় আক্রান্ত। সে সময়, উনিশ শতকের প্রথম ‍দিকে এ রোগকে মরণব্যাধি হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

এ রোগ সারানোর মতো যোগ্যতা টেঞ্জলারের না থাকলেও তিনি চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখেননি। বিভিন্ন ধরনের টনিক, স্পর্শমণি, নানাধরণের ঔষধ সেখানে যা পেয়েছেন, তা দিয়েই হোয়োসকে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। টেঞ্জলার নিজে হোয়েসের বাড়িতে গিয়ে তার সেবা করতেন এবং নতুন নতুন সব উপহার দিয়ে হোয়েসকে খুশি রাখার চেষ্টা করতেন। সম্ভাব্য সবরকমভাবে তার ভালবাসার কথা হোয়েসকে জানাতেন। টেঞ্জলারের এই পাগলের মতো ভালবাসা এবং সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে ১৯৩১ সালে পৃখিবী থেকে বিদায় নেন হোয়েস।

হোয়োস

তার মৃত্যুর পর টেঞ্জলার তার দেহাবশেষ রাখার জন্য কি ওয়েস্ট সেমেট্রিতে একটি মূল্যবান পাথরের জমকালো সমাধিস্তম্ভ কেনার জন্য হোয়েসের মা-বাবার অনুমতি নেন। টেঞ্জলার হোয়েসের মৃতদেহটি সুন্দর করে সাজিয়ে সমাধিস্তম্ভের মধ্যে তালা দিয়ে রাখেন এবং হোয়েসের পরিবারকে ফাঁকি দিয়ে সমাধিক্ষেত্রের চাবি রেখে দেন নিজের কাছে। টেঞ্জলার প্রায় দু’বছর যাবৎ প্রতিদিন রাতেই হোয়েসের কবরে যেতেন। কিন্তু এরপর কোন এক অজানা কারণে তার চাকরি চলে যায় এবং একই সঙ্গে সে হোয়েসের কবরে যাওয়াও বন্ধ করে দেন।

তার হঠাৎ এ পরিবর্তনে অনেকেই বিস্মিত হয়, কিন্তু তারা কল্পনাও করতে পারেনি আসল কারণ আরও কতটা বিস্ময়কর। ১৯৩৩ সালের এপ্রিলে টেঞ্জলার হোয়েসের দেহটি কবর থেকে বের করে নিজের সাথে নিজের বাড়িতে এনে রাখেন! এ কারণেই তার আর হোয়েসকে দেখতে কবরস্থানে যাবার দরকার পড়তো না! 

এবার টেঞ্জলারের নতুন কাজ হলো দুই বছরের পুরনো মৃতদেহটাকে সংরক্ষণ করা। তিনি মৃতদেহটা সংরক্ষণের প্রয়োজনে পুরনো একটা এরোপ্লেনের মধ্যে নিজস্ব একটা মেডিক্যাল ল্যাবরেটরি গড়ে তোলেন। হোয়েসের ক্ষয়িষ্মু শরীরটা অক্ষত রাখার জন্য নিজের তৈরি বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। হোয়েসে শরীরে কোট পরাতেন, কাঁচের চোখ দিয়ে চোখ বানাতেন, ছোট ছোট কাপড় গুঁজে মাথা এবং শরীরের শেপ ঠিক রাখার চেষ্টা করতেন। সামান্য নকল চুল লাগিয়ে মাথা ঢেকে রাখতেন।

টেঞ্জলার প্রচুর পরিমাণ সুগন্ধি, ফুল, জীবাণুনাশক এবং সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করে হোয়েসের মৃতদেহ থেকে আসা দুর্গন্ধ ঢেকে রাখার চেষ্টা করতেন। প্রচুর পরিমান মোম লাগিয়ে মৃতদেহটির মুখমন্ডল ঠিক রাখার চেষ্টা করতেন। এভাবে তিনি হোয়েসকে 'বাঁচিয়ে রাখতে' চাইতেন! টেঞ্জলার মৃতদেহটিকে পোশাক, গ্লাভস এবং গহনা দিয়ে সাজিয়ে রাখতেন। লাশটি রাখত তার নিজের শোবার বিছানায়। এভাবে কেটে যায় সাতটি বছর!  

টেঞ্জলার হোয়েসের মৃতদেহটি নিয়ে অনেক সময় নাচের ভঙ্গিতে দোলাতেন! পরবর্তীতে অনেকে এটাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলে যে, টেঞ্জলার হোয়েসের মৃতদেহটি আকাশে উড়ানোর চেষ্টা করতেন যাতে অন্য কোন গ্রহ থেকে আসা ঐশ্বরিক শক্তি বলে মৃতদেহটির শরীরে প্রাণের সঞ্চার হয়। আবার প্রাণ ফিরে পায় হোয়েস।

কিন্তু এরপর শহরের মানুষজনের চোখে এই অদ্ভুত ব্যাপারটা ধরা দিতে শুরু করে। তারা অনেকে লক্ষ্য করে, টেঞ্জলার নিয়মিত মেয়েদের পোশাক এবং সুগন্ধি ক্রয় করে। এর ওপর আবার একটা স্থানীয় ছেলে একদিন দেখতে পায়, টেঞ্জলার বিশালাকার একটা পুতুলের সাথে নাচছে। হোয়েসের পরিবারও কিছু একটা সন্দেহ করতে শুরু করে। ১৯৪০ সালে হোয়েসের বোন টেঞ্জলারের বাড়িতে আসে এবং সে সেখানে যা দেখে তাতে সে অবাক হয়ে যায়।

Caption

সে দেখে যে তার মৃত বোনের মতো দেখতে একটা পুত্তলিকা। নিয়মশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সেখানে পৌঁছালে তারা বুঝতে পারে যে সেটা হোয়েসের মতো দেখতে কোন পুতুল নয়, সেটা স্বয়ং হোয়েস। এরপর তারা টেঞ্জলারকে কবর ডাকাতির দায়ে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। ময়নাতদন্তের পর হোয়েসের মৃতদেহটি স্থানীয় একটি ফিউনারেল হাউসে রাখা হয় যেখানে আশেপাশের প্রায় ৭০০০ মানুষ এই মৃতদেহটি দেখতে আসে।

অবশেষে হোয়েসকে সমাহিত হয় সেই সিমেট্রিরই অন্য একটি কবরে, যা আর কেউ কখনো চিহ্নিত করতে পারেনি। বিচারকার্য চালনার সময় আদালতকে সাইক্রিয়াটিস্টরা মতামত নেন, টেঞ্জলারের কোন মানসিক ব্যাধি নেই, কাজেই তিনি আদালতের বিচারের জন্য পুরোপুরিই উপযুক্ত। কিন্তু টেঞ্জলার যে অপরাধটি করেছেন, তাতে আইনের কোনো সুস্পষ্ট বিধান না থাকায় শেষ পর্যন্ত তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

কার্ল টেঞ্জনারের বিচারকার্য চলাকালে পাগল প্রেমিক হিসেবে অনেকের সমবেদনাও লাভ করেন তিনি। এরপর জীবনের বাকি দিনগুলো টেঞ্জলার একা একাই কাটিয়ে দেন। ১৯৫২ সালে নিজ বাড়িতে নিঃসঙ্গ অবস্থায়ই তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর তিন সপ্তাহ পর মানুষজন তার মৃতদেহ আবিষ্কার করে।

তথ্যসূত্র- Carl Tanzler Fell In Love With His Patient, Then Lived With Her Corpse

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা