জামিয়া মিলিয়ার একটা ভিডিও পাওয়া যাচ্ছে অনলাইনে। একটা বাসার সামনে এক তরুণকে মাটিতে ফেলে ইচ্ছেমতো পেটাচ্ছে অস্ত্র আর ভারী পোষাকে সজ্জিত পুলিশ, এভাবে বোধহয় শত্রুকেও কেউ পেটায় না

সৌরভ গাঙ্গুলী আজীবন নিজেকে রাজনীতি থেকে একশো হাত দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ কিংবা কেন্দ্রীয়- কোন রাজনীতিতেই তিনি গা ভাসাননি, নিজের রাজনৈতিক অবস্থানটাও ব্যাখ্যা করেননি কখনও। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান হবার বিনিময়ে তাকে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির হয়ে কাজ করতে হবে- এমন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ- সেখানেও আপত্তি জানিয়েছেন সৌরভ। নিপাট ভদ্রলোকের ইমেজেই জীবনের এতগুলো বছর নির্বিবাদে কাটিয়ে দিয়েছেন প্রিন্স অফ ক্যালকাটা।

সৌরভের পরিবারেও এই আবহটাই আছে, বা ছিল। ধারাটা ভেঙেছেন সৌরভের মেয়ে। সানা গাঙ্গুলি বাবার পথে হাঁটেননি। সদ্যই আঠারোয় পা দিয়েছেন সানা, পেয়েছেন ভোটাধিকার। আঠারো বছর বয়স জগতটাকে চেনার জন্যে যথেষ্ট নয় মোটেও, কোন মতামত দাড় করানোর জন্যেও উপযুক্ত নয় হয়তো। কিন্ত ভালো আর মন্দের ফারাকটা তো ধরা যায় অন্তত। তার দেশে গত কিছুদিন ধরে যা চলছে, তাতে মুখ বন্ধ করে রাখতে পারেননি এই তরুণী, দেশকে ধর্মের ভিত্তিতে দ্বিখণ্ডিত হতে দেখে মুখ খুলেছেন তিনি, চেপে রাখতে পারেননি নিজের হতাশা আর ক্ষোভ। খুশবন্ত সিংয়ের লাইন উদ্বৃত করে সানা লিখেছেন- “আজ যারা আমরা নিজেদের নিরাপদ মনে করছি, ভাবছি আমরা তো মুসলমান বা খ্রিস্টান নই, তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছি।”

সানার মতো সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্ম নেয়া অজস্র ভারতীয় তরুণ-তরুণী এখন দাঁড়িয়ে আছেন একই মিছিলে। সেই মিছিল থেকে উচ্চারিত হচ্ছে একটাই মূলমন্ত্র- অখণ্ড ভারত! নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের নামে বিজেপি সরকার যেভাবে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করতে চাইছে, সেটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে লাখো-কোটি মানুষ। সেই মিছিলে ছাত্র আছে, আছে উদ্বাস্তু ভিক্ষুকও। সরকারী চাকুরিজীবীরা যেমন এই আইনের প্রতিবাদে পদত্যাগ করছেন, তেমনই আবার ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে, সেশন জটে পড়ার শঙ্কা মাথায় নিয়ে রাস্তা অবরোধ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা।

আন্দোলন চলছে রাজপথে

আর ভারত সরকার কী করছে? পুলিশ লেলিয়ে দিচ্ছে ছাত্রদের ওপর, নাগরিকত্ব বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামলেই তাকে ‘দেশদ্রোহী’ বা ‘পাকিস্তানের এজেন্ট’ ঘোষণা করা হচ্ছে, দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া ইউনিভার্সিটির ভেতরে বিনা অনুমতিতে ঢুকে ছাত্রদের বেধড়ক পিটিয়েছে পুলিশ, সেই এলাকায় যতো ছাত্র-ছাত্রী থাকেন, তাদের বাসভবন আর হোস্টেলে রেইড দেয়া হয়েছে। বাসা থেকে বের করে এনে পেটানো হয়েছে অনেককে, অন্তর্জালে ঘুরে বেড়াচ্ছে ধারণকৃত ভিডিও। প্রকাশ্য দিবালোকে ছাত্র-ছাত্রী নির্বিশেষে যার তার গায়ে পুলিশের লাঠির বাড়ি পড়ছে! ছাত্রীরা প্রাণভয়ে কাঁদতে কাঁদতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ছে, আহত এক ছাত্রের হাত কেটে ফেলতে হয়েছে। এই হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে’ প্রতিবাদের শাস্তি!

তবে জামিয়ার ঘটনাটাই মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে পুরো চিত্রনাট্যের। এর আগে পর্যন্ত আন্দোলনটা ছিল একটা নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষের মধ্যে। আসামের আন্দোলন বা প্রতিবাদের ঘটনাও চাপা পড়েই যাচ্ছিলো প্রায়, ইন্টারনেট শাট ডাউন করে দেয়ার কারণে খবরাখবর পাওয়া যাচ্ছিলো না তেমন। কিন্ত ছাত্রদের ওপর যেই হাত তুললো অমিত শাহ’র পুলিশ ফোর্স, সঙ্গে সঙ্গে সেই আন্দোলনটা হয়ে গেল পুরো দেশের। দাবানলের মতো সেটা ছড়িয়ে পড়লো কাশ্মির থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত। মুসলিম-অমুসলিমের ভেদাভেদটা আর রইলো না কোথাও। বোম্বে আইআইটি, আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, চন্ডিগড় ইউনিভার্সিটি বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়- সবাই একযোগে প্রতিবাদ জানালো রাস্তায় নেমে, অচল হয়ে গেল অর্ধেক ভারত।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন সর্বস্তরের মানুষ

জামিয়া মিলিয়ার একটা ভিডিও পাওয়া যাচ্ছে অনলাইনে। একটা বাসার সামনে এক তরুণকে মাটিতে ফেলে ইচ্ছেমতো পেটাচ্ছে অস্ত্র আর ভারী পোষাকে সজ্জিত পুলিশ, এভাবে বোধহয় শত্রুকেও কেউ পেটায় না। সেই তরুণকে আগলে ধরে বাঁচানোর চেষ্টা করছে তার কয়েক সহপাঠী, সবাই নারী- হিজাব পরিহিতাও আছে কয়েকজন। নারীদের দেখেও পুলিশের লাঠি থামছে না, বরং তারা দ্বিগুণ আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ছে তাদের ওপর। রক্তাক্ত সেই তরুণকে পরে উদ্ধার করে নিয়ে গেছে তার সহপাঠীরা, পুলিশের এই অতি উৎসাহী আচরণের কারণটা এখানে মোটেও স্পষ্ট নয়।

ছোট্ট করে জানিয়ে রাখি, যে আইন প্রণয়ন নিয়ে ভারতজুড়ে এখন সংঘাত আর গণ্ডগোল, সেটার মুখ্য উদ্দেশ্য যে ধর্মীয় বিভাজন ঘটিয়ে এক বিশাল সংখ্যক মুসলমানের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার চক্রান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়- শরণার্থী হিসাবে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের উল্লেখ দেখেই সেটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। পাকিস্তানের আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ, যারা নিজ ধর্মের সুন্নী মতাবলম্বীদের হাতে নির্যাতিত হয়ে আসছে বছরের পর বছর ধরে- তারা তাহলে ভারতে আশ্রয় নিতে পারবেন না?

মায়ানমার এই আইনের আওতায় আসেনি, কারণ, মায়ানমারে আক্রান্ত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা মুসলমান, তাদের জন্যে নরেন্দ্র মোদি বা অমিত শাহ’র প্রাণ কাঁদে না। একই ভাবে বাদ পড়েছে নেপাল, ভুটান আর শ্রীলঙ্কার নামও। নেপাল বা ভুটান থেকে শরণার্থী হিসাবে যারা ভারতে এসেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে আক্রমণকারী হিসেবে মুসলমানদের দেখানোর উপায় নেই। একই কারণে বাদ গিয়েছেন শ্রীলঙ্কা থেকে নিপীড়িত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া তামিল উদ্বাস্তুরাও। এই আইনে বিশেষ কয়েকটি প্রতিবেশি দেশ এবং বিশেষ কয়েকটি সম্প্রদায়কে বেছে নেওয়ার একটাই উদ্দেশ্য- ভারতকে মুসলমানশূন্য করা।

পুরো ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে আন্দোলন

এমন ঘৃণ্য ঘটনার পরে চুপ থাকাটা সম্ভব নয়, অন্তত স্বাভাবিক কোন মানুষের পক্ষে তো অবশ্যই নয়। উগ্র সাম্প্রদায়িকতা মনের ভেতরে পুষে রাখলেই কেবল এসব দৃশ্য দেখে আনন্দ পাওয়া সম্ভব। মোদি-শাহ জুটির পক্ষ থেকে যতোই বলা হোক, ভারতীয় মুসলমানদের কারো কোন শঙ্কা নেই, সেটা কী আদৌ বিশ্বাস করার মতো? এই মোদি সরকারই তো অযোধ্যায় মন্দির বানাচ্ছে, কাশ্মীরের মানুষকে মাসের পর মাস ধরে একরকম গৃহবন্দী করে রেখেছে। নাগরিকত্ব রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়াটা যে কতটা গলদপূর্ন, সেটা তো আসামের ঘটনাতেই প্রমাণীত। এরপরেও তারা তথাকথিত ‘হিন্দু রাষ্ট্রে’র স্বপ্নে বিভোর এখনও। আর তাই প্রতিবাদ করলেই নেমে আসছে অত্যাচারের স্টিম রোলার।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জন গন মন’ কবিতার প্রথম অংশটাই ভারতের জাতীয় সঙ্গীত। সেখানে দুটো লাইন ছিল- অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী, হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক, মুসলমান খৃস্টানী; পূরব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন-পাশে, প্রেমহার হয় গাঁথা…  ভারতের মানচিত্র থেকে উদারতা শব্দটা দূর হয়ে যাচ্ছে, সেখানে ঠাই করে নিয়েছে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প। হিন্দু-মুসলমানের পাশাপাশি সহাবস্থানের দিন শেষ করতে চাইছে অনেকে। মোদি-শাহ জুটি সিংহাসনে বসে যা করে চলেছেন, সেটা ‘প্রেমহার গাঁথা’র সঙ্গে কোনভাবেই যায় না। প্রেমের বদলে ঘৃণার বীজই তো ভারতের বুকে বপন করছেন তারা!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা