ভয়াবহ দাবানলে পুড়ছে অস্ট্রেলিয়া। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকায় আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে দাবানল নিয়ন্ত্রণে আনতে জরুরি ভিত্তিতে সেনাবাহিনী মাঠে নামাচ্ছে ভিক্টোরিয়া ও নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্য সরকার। ইতিমধ্যই, প্রায় ৫০ কোটি পশুপাখির মারা যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

অস্ট্রেলিয়ায় ভয়াবহ দাবানলে স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি ও সরীসৃপ বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ৫০ কোটি প্রাণী প্রাণ হারিয়েছে। সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুবিদরা এ আশঙ্কা করেছেন। নববর্ষের প্রথম দিন পর্যন্ত এই দাবানলে প্রাণ হারিয়েছেন ১৭ জন স্থানীয় অধিবাসী। দেশটির নিউ সাউথ ওয়েলস ও ভিক্টোরিয়া অঙ্গরাজ্যে মূলত দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে। গত সেপ্টেম্বর থেকে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর এ দাবানল শুরু হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ দাবানলপ্রবণ এলাকা থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছেন। দাবানলের ভয়াবহতার মাত্রা এতটাই চরম আকার ধারণ করেছে যে, নিউজিল্যান্ডের আকাশও কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে। দাবানল থেকে রক্ষা পেতে আশ্রয়ের খোঁজে হাজার হাজার মানুষ সেখানকার সমুদ্র উপকূলের দিকে পালিয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, লাল হয়ে ওঠার আকাশের নিচে সমুদ্রে নৌকায় বা উপকূলে তাঁবু বানিয়ে বসবাসের অভিজ্ঞতা ভয়ানক। দাবানল নিয়ন্ত্রণে মাঠে নামছে সেনাবাহিনী।

অস্ট্রেলিয়ায় সাধারণত গ্রীষ্মকালে তাপদাহের কারণে জঙ্গলে দাবানল হয়। স্থানীয়রা একে বলে থাকে বুশফায়ার। এই দাবানল কতোটা ভয়ংকর হতে পারে, ধারণকৃত চিত্র ও ভিডিওতে উঠে এসেছে তার করুণ চিত্র। আগুনের এ তীব্রে রোষের মুখে অসহায় হয়ে পড়ে হাজার হাজার মানুষ। কখনও সংলগ্ন এলাকা থেকে মানুষজনকে উদ্ধার করা অথবা দাবানলের পথে গাছ কেটে আগুন থামানোর চেষ্টাতেই অবলম্বন খোঁজেন স্থানীয়রা। সরকারিভাবে বিমান থেকে বিশেষ তরল মিশ্রণ ঢেলে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেও কাজ হচ্ছে না।

বুশফায়ার বা দাবানলপ্রবণ এলাকায় জনবসতি তুলনামূলক কম থাকে। ফলে লোকজনের প্রাণহানি বা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কিছুটা কম হয়। তবে এ দাবানলে প্রচুর গাছ ও জীবজন্তুর প্রাণহানি ঘটেছে। নিউ সাউথ ওয়েলসের প্রায় এক কোটি একর ভূমির গাছপালা দাবানলে পুড়ে গেছে।  ভিক্টোরিয়া অঙ্গরাজ্য থেকে ৪ হাজার মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সেখানকার টেলিফোন লাইন ও  ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ হয়ে গেছে। দাবানল কবলিত এলাকার পানি সিদ্ধ হওয়ায় তা পান অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। আগুন থেকে বাঁচতে উপকূলে আশ্রয় নেওয়া মানুষের জন্য খাবার ও পানি সরবরাহের জন্য নৌবাহিনীর জাহাজ মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে ভিক্টোরিয়া রাজ্য প্রশাসন। এছাড়া দাবানল আবহাওয়া কর্মকর্তারা সতর্ক করেছেন, শনিবার শক্তিশালী বাতাস এবং তাপমাত্রা ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস হওয়ার পর পরিস্থিতি আবারও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। 

দাবানলের ভয়াবহতা

দাবানলের কারণে স্থানীয় প্রাণীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে কোয়ালা, কারণ এই প্রাণীগুলো ধীরে ধীরে চলাচল করে এবং ইউক্লিপটাস গাছের পাতা খেয়ে বেঁচে থাকে। আর এই গাছ অতিমাত্রায় দাহ্য। ফলে খুব দ্রুত গাছগুলো পুড়ে যায়। আশঙ্কা করা হচ্ছে, চার মাসে দাবানলে অন্তত আট হাজার কোয়ালা মারা গেছে। যা ওই অঞ্চলের মোট কোয়ালার এক তৃতীয়াংশ। ধারণকৃত চিত্রে দেখা গেছে, ক্যাঙ্গারুগুলো আগুন থেকে বাঁচার জন্য পালানোর চেষ্টা করছে। ক্যাঙ্গারু উদ্ধার অভিযানে সময় দমকল বাহিনীর কর্মীরা হাজার হাজার দগ্ধ কোয়ালার মরদেহ দেখেছেন। অন্য সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কয়েক হাজার কাকাতুয়ার মরদেহ রয়েছে সেখানে। অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় দাবানলের কারণে ধ্বংসের পরিমাণ নির্ণয়ে হিমশিম খাচ্ছে বিশ্ব।

বাস্তুবিদ মার্ক গ্রাহাম অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টকে জানিয়েছেন, দাবানল অতিমাত্রায়-অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় ব্যাপকমাত্রায় বিভিন্ন পশু-পাখি-প্রাণী মারা গেছে, বিশেষত গাছপালা পুড়ছে। তিনি আরও বলেন, ‘এতো বিশাল এলাকায় আগুনে পুড়েছে, এখনও জ্বলছে যার কারণে আমরা সম্ভবত সেখানের প্রাণীর মরদেহগুলো আর খুঁজে পাবো না।’ এই বিষয়টিকে ‘ভয়ঙ্কর’ বলে বর্ণনা করে প্রাণী উদ্ধারকর্মীরা বলেছেন, ‘চিকিৎসার জন্য যে পরিমাণ পশু-প্রাণী আনা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছিলো, আমাদের চিকিৎসাকেন্দ্র ততো বেশি প্রাণী আসেনি। আমাদের উদ্বেগ হচ্ছে সেগুলো আর জীবিত নেই।’

খোলা চিঠিতে ১৩টি সংগঠনের স্ট্যান্ড আপ ফর ন্যাশার নামের একটি জোট সতর্ক করে বলেছে, এই দাবানলের প্রভাব হচ্ছে মারাত্মক ও চলমান। এই প্রাণহানির পরিমাণ সম্ভবত কখনওই জানা যাবে না। তবে এটা নিশ্চিতভাবে কোটি কোটি হবে। অস্ট্রেলিয়ার পরিবেশমন্ত্রী সুশান লে বলেছেন, দাবানল বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত এবং সঠিক মূল্যায়ন না হওয়া মৃত পশু-পাখি-প্রাণীর প্রকৃত সংখ্যা জানা যাবে না।

দাবানলের ভয়াবহতায় বিপন্ন প্রাণীকূল 

কিছু দিন আগেও আমাজনে দাবানলের ভয়াবহতা আমরা দেখেছি। পৃথিবীর উপর চাপিয়ে দেয়া এ ভয়াবহতার দায়ভার আমরা কোনোভাবেই এড়াতে পারি না। পরিবেশকে দিনের পর দিন ভারসাম্যহীনতার দিকে আমরাই ঠেলে দিয়েছি। এভাবে চলতে থাকলে সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন এ ধরণী কোনোভাবেই আর কোনো প্রাণীর বসবাসের যোগ্য থাকবে না।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা