'গরু পাচারকারী সন্দেহে' পাখির মতো গুলি করে সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করা বিএসএফের সদস্যরাই সীমান্তে গরু পাচারের সঙ্গে সরাসরি জড়িত! হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ আয় করেছে অনেকে- বলছে খোদ সিবিআই!

বাংলাদেশ সীমান্তে পাখির মত গুলি করে মানুষ মারাটা ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের অনেক পুরনো অভ্যাস। হাজার হাজার বাংলাদেশী নাগরিক নিহত হয়েছেন তাদের গুলিতে, কখনও আবার আটক হয়ে সয়েছেন অকথ্য নির্যাতন। এসব হত্যাকান্ডের বেশিরভাগের পরেই বিএসএফের দেয়া মুখস্ত স্টেটমেন্ট থাকতো এরকম- গরু পাচারকারী সন্দেহে বিএসএফ তাদের আটক করতে চেয়েছে, কিন্ত তারা পালানোর চেষ্টা করায় গুলি ছুঁড়তে বাধ্য হয়েছিল, আর সেই গুলিতেই এই বাংলাদেশীদের মৃত্যু হয়েছে। ক্রসফায়ারের মতো মুখস্ত একটা গল্প, তাদের কথা অনুযায়ী, বিএসএফ গরু পাচারকারী ছাড়া জীবনে কারো ওপর গুলি চালায়নি কখনও।

কিন্ত ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন্সের তদন্তে যে রিপোর্ট বেরিয়ে এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, বিএসএফের উচ্চপদস্থ অফিসার থেকে সৈনিক লেভেলের লোকজনও বাংলাদেশ সীমান্তে গরু পাচারের সঙ্গে জড়িত! জ্বী, সিবিআই বলছে এই কথা! মালদা-মুর্শিদাবাদ এবং উত্তর ২৪ পরগনার সীমান্ত দিয়ে এসব গরু পাচার করা হতো বলে জানানো হয়েছে। বিএসএফের কমান্ড্যান্ট পর্যায়ের এক অফিসার সহ বেশ কয়েকজন গরু পাচারকারীকে ইতিমধ্যেই আটক করা হয়েছে। সতীশ কুমার নামের যে বিএসএফ অফিসার আটক হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের কয়েকটা রাজ্যে তার বাড়ি আছে, সম্পদের পরিমাণও নেহায়েত কম নয়! 

ঘটনাটাকে মোটামুটি কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসাই বলা যায়। ২০১৮ সালে কেরালায় সিবিআইয়ের দুর্নীতি দমন শাখার হাতে আটক হন বিএসএফ কমান্ড্যান্ট জিবু ডি ম্যাথিউ। আয়ের সঙ্গে বেমানান প্রায় ৫০ লাখ টাকার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছিল। আর সেই অভিযোগের তদন্ত করতে গিয়েই বেড়িয়ে আসে গরু পাচারের সঙ্গে জড়িত বিএসএফ ও শুল্ক কর্মকর্তাদের নাম। বেরিয়ে আসতে থাকে চাঞ্চল্যকর সব তথ্যও। 

সীমান্তে গরু পাচারের সঙ্গে সরাসরি জড়িত বিসএফ- বলছে সিবিআই

সিবিআই- এর জিজ্ঞাসাবাদে জিবু জানিয়েছে, তাকে ওই টাকা দিয়েছিল বিশু শেখ ওরফে এনামুল হক নামে এক ব্যক্তি। জিজ্ঞাসাবাদে জিবু স্বীকার করে, গরু পাচারে বিশু শেখের সিন্ডিকেটকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে ওই টাকা পেয়েছিল সে। কান টানলেই মাথা আসার মতো এরপরের ঘটনাগুলো ঘটে গেছে একে একে। মোবাইল রেকর্ডের সূত্র ধরে আটক হয় গরু পাচারকারী এনামুল। জিবু এবং এনামুলের জবানবন্দীতেই জানা যায় বিএসএফ কমান্ড্যান্ট সতীশ কুমারের নাম। সিবিআই তখন তদন্ত শুরু করে তাকে নিয়েও।

জার্মান দৈনিক ডয়েচে ভেলের বাংলা ভার্সনে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বিএসএফ এর ৩৬ নম্বর ব্যাটেলিয়নের কমান্ড্যান্ট ছিলেন সতীশ কুমার। তার সল্টেলেকের বাড়ি ইতিমধ্যেই সিল করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও অন্যান্য রাজ্যে তার নামে আরও বাড়ি আছে। পশ্চিমবঙ্গের মালদায় পোস্টেড হলেও, মালদা-মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের দীর্ঘ সীমান্তে কাজ করেছেন সতীশ। এবং সেই সময়েই গরু পাচারের ঘটনার সঙ্গে তিনি যুক্ত হন। নিজে গরু পাচার করেই ক্ষান্ত থাকেননি, কাঁচা টাকার লোভে ছেলেকেও এই কাজের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন সতীশ। 

সিবিআই- এর দাবী, ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে প্রায় ১৬ মাস সীমান্তে কাজ করেছিলেন সতীশ। সেই সময় প্রায় ২০ হাজার গরু পাচারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন তিনি। সেসব গরু পাচারে মাধ্যমে প্রচুর অবৈধ টাকা উপার্জন করেছেন তিনি। তবে এখানেই শেষ নয়, বিএসএফ এবং শুল্ক বিভাগের এমন আরও অফিসার গরু পাচারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থেকে সুবিধাভোগী হয়েছেন, তারাও সিবিআইয়ের নজরে আছে বলে জানা গেছে। 

প্রতি মাসেই হাজার হাজার গরু পাচার করা হয়েছে সীমান্ত দিয়ে

বিএসএফের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে হাজার হাজার গরু পাচার করেছে বিশুর সিন্ডিকেট। মোটা টাকার বিনিময়ে সীমান্ত খুলে দেওয়া হয়েছে গরু পাচার করতে। শুধু পাচারে সহায়তা নয়, বাজেয়াপ্ত গরুকে খাতা-কলমে বাছুর হিসাবে দেখিয়েও প্রতারণা করা হয়েছে।  বাজেয়াপ্ত হওয়া গবাদি পশু নিলামে তোলার সময় গরুকে বাছুর হিসেবে দেখানো হতো। প্রাপ্তবয়স্ক গরুর দাম যদি হয় ষাট হাজার টাকা, তাহলে বাছুরের দাম হতো পঁচিশ থেকে ত্রিশ হাজার। নিলাম থেকে পাওয়া ষাট হাজার টাকার মধ্যে গরুকে বাছুর হিসেবে দেখানোয় পঁচিশ-ত্রিশ ভারত সরকারের কোষাগারে যেতো, বাকিটা এই পাচারকারী সিন্ডিকেটের পকেটে। মাসে ১৫-২০ হাজার অবৈধ গরুর নিলাম হতো। নয়-ছয় করা টাকার পরিমাণটা কল্পনা করার চেষ্টা করুন এবার, শিউরে উঠতে হবে। 

আশংকার ব্যাপার যেটা, সেটা হচ্ছে বিএসএফের অসাধু কর্মকর্তা বা সৈনিকেরা শুধু যে গরু পাচারের সঙ্গেই যুক্ত, এমনটা নয়। এনআইএ এবং সিবিআইয়ের সূত্রগুলোর বরাত দিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম জানাচ্ছে, গরু পাচারকারীরা বেআইনী অস্ত্র পাচারের সঙ্গেও যুক্ত। পাচারের বিভিন্ন পদ্ধতির বিষয়ে জানতে পেরেছে এনআইএ। পাচারকারীরা জেএমবির সঙ্গে জড়িত বলেও অভিযোগ উঠেছে। তবে এসব বিষয়ে বিস্তারিত তদন্ত শেষ হবার আগে কিছু জানাতে চান না সিবিআই কর্মকর্তারা। ভাবুন একবার, ভারতের নানা মহল থেকে বারবার বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে জঙ্গীরা নাকি সীমান্তবর্তী প্রদেশগুলোতে নেটওয়ার্ক তৈরি করে তাদের দেশের ক্ষতিসাধন করতে চাইছে। অথচ এখন আমরা শুনতে পাচ্ছি সেসব জঙ্গির কাছে অস্ত্র আসছে ভারত থেকে, সেদেশেরই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রশ্রয়ে! আইরনি আর কাকে বলে! 

কিছুদিন আগে বিএসএফ অভিযোগ করেছিল, গরু পাচারের সঙ্গে নাকি বিজিবি জড়িত। কুরবানীর আগে তো এমনও বলেছিল, পাচার করা গরু জবাই করলে কুরবানী হবে না, কাজেই বাংলাদেশী নাগরিকেরা যেন ভারত থেকে পাচার হওয়া/অবৈধভাবে যাওয়া গরু না কেনেন। বিএসএফের আচরণ দেখে 'ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না' প্রবাদটির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। সারাজীবন গরু পাচারকারী অপবাদ দিয়ে এদেশের মানুষকে গুলি করে মারলো যারা, তারাই দেখি গরু পাচার করে সম্পদের পাহাড় গড়েছে, আর এদেশের নিরীহ নাগরিকদের কপালে জুটেছে বুলেট, কাঁটাতারে ঝুলে থেকেছে ফেলানির নিথর দেহ... 

ছবি কৃতজ্ঞতা- এএনআই, দ্য হিন্দু। 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা