ছেলেধরার গুজবে আমরা অসহায় নারীকে পিটিয়ে মেরেছি, ধর্ম অবমাননার গুজব রটিয়ে মানুষ হত্যার পর তার লাশ পুড়িয়ে উল্লাস করেছি। মানসিকভাবে অসুস্থ পুলিশ অফিসারকে হত্যার খবরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছি! আমাদের হাতে লেগে আছে নিরপরাধ মানুষের রক্ত, বুকে মিশে আছে অসহায়ের প্রতি ঘৃণা- এরপরও নিজেকে মানসিকভাবে সুস্থ দাবী করি কীভাবে?

ঘটনা এক

২০শে জুলাই ২০১৯, বাড্ডা, ঢাকা। উত্তর বাড্ডার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে তসলিমাকে পিটিয়ে মারা হয়। রেনু তার মেয়েকে ভর্তি করানোর জন্য খবর নিতে সেখানে গিয়েছিলেন। তাসলিমা বেগম রেনু মানসিকভাবে খানিকটা অপ্রকৃতস্থ ছিলেন। পদ্মা সেতুর কাজে শিশুদের মাথা লাগবে, এই গুজবে তখন মানুষজন ছেলেধরা সন্দেহে যাকে তাকে পিটিয়ে মারছে। স্কুলের সামনে খোঁজখবর নিতে আসা রেণুকে স্থানীয় কয়েকজন ছেলেধরা অপবাদ দিয়ে মারা শুরু করে। স্কুলের শিক্ষকেরা তাকে উদ্ধার করে স্কুলের ভেতরে নিয়ে যান। সেখান থেকে রেনুকে ছিনিয়ে নিয়ে আসে 'মাথামোটা জনতা'। 

সাপ পেটানো দেখেছেন কখনও? নিস্তেজ হয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত সাপকে যেভাবে পেটানো হয়, রেনুকেও সেদিন ঠিক সেভাবেই মারা হয়েছিল। পঞ্চাশ-একশো কিংবা তারও বেশি মানুষ একজন নিরীহ, নিরস্ত্র মহিলাকে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে, একটা গুজবের ওপর ভিত্তি করে। শুধু মারপিট করেই ক্ষান্ত হয়নি জনতা, সেই ঘটনার ভিডিও ধারনও করা হয়েছে। দুই সন্তানের মা ছিলেন রেনু, ছেলে তাহমিদের বয়স ১২ বছর, মেয়ে তুবার বয়স ৫। তাহমিদ জেনে গেছে, মা আর কখনও ফিরে আসবে না। তুবা তবু অপেক্ষায় থাকে, সে জানে না, তার জন্মদাত্রী এদেশের কিছু পাষণ্ডের উন্মত্ত তাণ্ডবের শিকার হয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। 

তাসলিমা বেগম রেনু

ঘটনা দুই

লালমনিরহাটের পাটগ্রামে মসজিদের ভেতর কোরআন অবমাননার গুজব রটিয়ে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয় রংপুর ক্যান্টনমেন্ট স্কুল এন্ড কলেজের সাবেক লাইব্রেরিয়ান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র শহিদুন্নবী জুয়েলকে। এক বছর আগে চাকরি থেকে অবসর নেন জুয়েল, এরপর মানসিকভাবে খানিকটা অপ্রকৃতস্থ হয়ে পড়েছিলেন বলে জানা যায়। ভীষণ ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন, সেই মানুষটাকেই ধর্ম অবমাননার অপবাদ দিয়ে পিটিয়ে মারা হলো, তারপর তার লাশে আগুন জ্বালিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়েছিল সেখানকার 'তৌহিদী জনতা'! 

শহিদুন্নবী জুয়েলের হত্যাকান্ডের খবরটাকে অনলাইনে হালাল করার চেষ্টা করেছে অনেক বরাহশাবক। তাদের যুক্তি ছিল, মসজিদের ভেতর ঢুকে কেউ কোরআন শরীফকে পায়ের নিচে পিষ্ট করলে নাকি তার এরকমই শাস্তি হওয়া উচিত! অথচ পুলিশি তদন্তে জানা গেছে, কোরআন অবমাননার কোন ঘটনা মসজিদে ঘটেইনি সেদিন! পুরোটাই একটা রটনা, আর সেই গুজবটা রটিয়ে জুয়েলকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের জিম্মা থেকে ছিনিয়ে নিয়ে খুন করা হয়েছে। ধর্মের নামে বর্বরতার এক জঘন্য নজির সেদিন স্থাপিত হয়েছে লালমনিরহাটে। 

শহিদুন্নবী জুয়েল

ঘটনা তিন

মানসিক সমস্যায় ভুগে রাজধানীর আদাবরে মাইন্ড এইড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুল করিম। ৩১তম বিসিএসের ক্যাডার ছিলেন এএসপি আনিসুল। গতকাল সকালে হাসপাতালে ভর্তির পর কয়েক মিনিটের মধ্যেই মারা যান তিনি। পরিবারের অভিযোগ, ভর্তির পরপর হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করেছেন। 

হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজ থেকে দেখা গেছে, বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটের দিকে পুলিশ কর্মকর্তা আনিসুল করিমকে টানাহেঁচড়া করে একটি কক্ষে ঢোকানো হয়। তাকে হাসপাতালের ছয়জন কর্মচারী মিলে মাটিতে ফেলে চেপে ধরেন। এরপর নীল পোশাক পরা আরও দুজন কর্মচারী তার পা চেপে ধরেন। এ সময় মাথার দিকে থাকা দুজন কর্মচারী হাতের কনুই দিয়ে তাকে আঘাত করছিলেন। হাসপাতালের ব্যবস্থাপক আরিফ মাহমুদ তখন পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। একটি নীল কাপড়ের টুকরা দিয়ে আনিসুলের হাত পেছনে বাঁধা হয়। 

চার মিনিট পর আনিসুলকে যখন উপুড় করা হয়, তখনই তার শরীর নিস্তেজ ছিল। একজন কর্মচারী তখন আনিসুলের মুখে পানি ছিটান। তাতেও আনিসুল করিম নড়াচড়া করছিলেন না। তখন কর্মচারীরা কক্ষের মেঝে পরিষ্কার করেন। সাত মিনিট পর সাদা অ্যাপ্রোন পরা একজন নারী কক্ষে প্রবেশ করেন। ১১ মিনিটের মাথায় কক্ষের দরজা লাগিয়ে দেওয়া হয়। ১৩ মিনিটের মাথায় তার বুকে পাম্প করেন সাদা অ্যাপ্রোন পরা নারী। ততক্ষণে আনিসুল করিম মারা গেছেন। এরপরে তার পরিবারের সদস্যদের জানানো হয় আনিসুল অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। এরপর তারা তাকে দ্রুত হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউটে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসক তাঁকে পরীক্ষা করে মৃত ঘোষণা করেন।

একবার ভাবুন, পদস্থ একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে হাসপাতালের ভেতরে কর্মচারীরা পিটিয়ে মেরে ফেলছে! পুলিশ অফিসারের যদি জীবনের নিরাপত্তার এই হাল হয়, সাধারন জনগনের নিরাপত্তা কোথায়? মানসিক সমস্যার চিকিৎসা করতে আসা একজন মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে হাসপাতালের ভেতর- এটা যে কত জঘন্য একটা ঘটনা, সেটা বলার ভাষা নেই। এরপরেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একদল অমানুষ এই ঘটনায় উল্লাস করছে। কারন নিহত ব্যক্তিটি একজন পুলিশ অফিসার। পুলিশ সদস্যদের দোষ-ত্রুটি টেনে এনে এই মৃত্যুকে হালাল করার চেষ্টা করছে পাষণ্ডের দল! 

পুলিশ কর্মকর্তা আনিসুল করিম

তিনটি ঘটনা উল্লেখ করা হলো মোট। ভিক্টিম তিনজনই পিটুনি বা হামলায় নিহত হয়েছেন। তিনজনের সামাজিক বা অর্থনৈতিক স্ট্যাটাস আলাদা আলাদা। কেউ এলিট সোসাইটির মানুষ, উঁচু পদে আসীন, কেউবা একদম সাদামাটা। কিন্ত প্রত্যেকেই ঘৃণা আর হিংসার শিকার।তারচেয়ে বড় মিল, তিনজনই মানসিকভাবে খানিকটা অপ্রকৃতস্থ ছিলেন। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর রেনু মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন, চাকরি ছাড়ার পরে শহিদুন্নবী জুয়েল মানসিক স্থিতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন খানিকটা। আর পুলিশ কর্মকর্তা আনিসুল করিমের মানসিক সমস্যাও বেশ কিছুদিন ধরেই ছিল। জনগনের উন্মত্ততা, পাশবিকতা থেকে তাদের কেউ রেহাই পাননি, অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্ত এই তিনজনকে কি আসলেই মানসিকভাবে অসুস্থ বলা যায়? 

পদ্মা সেতুতে মাথা লাগবে- এমন গুজবে বিশ্বাস করে ছেলেধরা সন্দেহে কয়েকশো মানুষ একত্রিত হয়ে একজন অসহায় নারীকে যারা পিটিয়ে মারলো, তারা কি মানসিকভাবে সুস্থ? যারা লালমনিরহাটে কোরআন অবমাননার গুজব রটালো, যারা চিলে কান নেয়ার সংবাদ শুনে জুয়েলকে হত্যা করলো নির্মমভাবে, তারপর মৃত মানুষটার লাশ আগুনে পোড়ালো- তারা মানসিকভাবে সুস্থ? নাকি যারা এই পুলিশ অফিসারের মৃত্যুতে ফেসবুকের কমেন্টবক্সে উল্লাস করছে- তাদেরকে মানসিকভাবে সুস্থ বলা যাবে?

দিনকে দিন অসহিষ্ণুতার সীমা ছাপিয়ে যাচ্ছি আমরা, কখনও ছেলেধরার নামে, কখনও ধর্মের নামে, আবার কখনও শুধু কারো উচ্ছৃঙ্খল আচরণ সহ্য করতে না পেরে তাকে খুন করে ফেলছি! এরপরও নিজেদের মানসিকভাবে সুস্থ হিসেবে দাবী করার কোন অধিকার কি আমাদের আছে? আপনার হাতে লেগে আছে নিরপরাধ মানুষের রক্ত, আপনার বুকে মিশে আছে অসহায়ের প্রতি ঘৃণা- এরপরও নিজেকে মানসিকভাবে সুস্থ দাবী করেন কীভাবে?

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা