
বেলজিয়ামের রাজধানি ব্রাসেলস। ১৬২ স্কয়ার কি,মি, আয়তনের ছোট এই শহরটি সাজানো, গোছানো ও কোলাহলমুক্ত। ইউরোপীয় কমিশনের হেডকোর্টার সহ অনেক নান্দনিক ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যের নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই শহরের আনাচে কানাচে। সময় পেলে ঘুরে আসুন ছোট, সুন্দর, ছবির মতো সাজানো এই শহরে।
দিনটি ছিল ঝলমলে রৌদ্রজ্জ্বল, ২০১২ সালের জুন মাসের ১২ তারিখ প্যারিসের গ্যা-দু-ন রেল স্টেশন থেকে থালেজ ট্রেনে চেপে বসলাম, গন্তব্য ব্রাসেলস মিডি রেল স্টেশন, বেলজিয়াম। ঘন্টায় প্রায় ৩০০ কিলোমিটার বেগে চলা হাই স্পিড ট্রেনে এটাই আমার প্রথম আন্তঃদেশীয় রেল ভ্রমন। ইউরোপে আন্তঃদেশ রেল ভ্রমণ কিছুটা ব্যয়বহুল, তবুও অভিজ্ঞতার ঝুলিতে নতুন কিছু মুহূর্ত যুক্ত করার জন্য কিছুটা বেশী খরচ মেনে নেওয়া যায় ।
কিছুটা উত্তেজনা আর রেল ভ্রমণে নতুন অভিজ্ঞতার আশায় অধীর আগ্রহে বসে আছি জানালার পাশে। ধীরে ধীরে ট্রেন চলতে লাগল, প্রেমের নগরী প্যারিসকে পিছনে ফেলে ছুটে যাচ্ছি নতুন দেশের আগমনী হাতছানিকে সাড়া দিতে। প্যারিসকে বিদায় জানানোর বেদনা আর বেলজিয়ামের আগমনী হাতছানি- দুইয়ে মিলে আমি যেন নতুন এক ভূবনে ডুব সাতার খেলছি।
ইতিমধ্যেই আমাদের ট্রেন শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে ছুটে চলল, আমি অবাক দৃষ্টিতে জানালায় তাকিয়ে আছি, ছবির মতো এত সুন্দর প্রকৃতি আগে কোনদিন দেখিনি। অনেক দূরে এক একটা নয়নাভিরাম খামার বাড়ি, সাজানো, গোছানো ফসলের মাঠ, সত্যিই চোখ জুড়িয়ে যায়। মনে হয় যেন বসার ঘরে সাজিয়ে রাখা ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে যাচ্ছি...
দেখছি আর ভাবছি, এত সুন্দর পৃথিবী অথচ কত সামন্য কয়েকটা দিনের আয়ু নিয়ে আমরা পৃথিবীতে আসি। জীবন সংসারের ঘানি টানতে টানতে কখন যে বেলা ফুরিয়ে যায়, ভাবতেই অবাক লাগে! তারপর সবকিছু গুছিয়ে যখন একটু অবসরের কথা ভাবি, তখন বিদায় বেলার ঘন্টা বেজে যায়। পৃথিবীটা কত সুন্দর, অথচ তার খুব সামান্যই আমরা দেখে যেতে পারি। তখন খুব আফসোস হয় যে কেন একটা জিওডাক বেঁচে থাকে ১৬০-১৭০ বছর! কেন একটা তুয়াতারা বেঁচে থাকে ২০০ বছর! কেন একটা কচ্ছপ বেঁচে থাকে ২৫০ বছর! আমরা মানুষেরা কেন নই!
কিছুক্ষন পর এরাইভাল এনাউন্সমেন্ট বেজে উঠলো, আমারা ব্রাসেলসে চলে এসেছি। ট্রেনের গতি কমে এলো, দেখতে দেখতে প্রায় ১ ঘন্টা ৩১ মিনিট পার হয়ে গেলো। নতুন দেশ, নতুন শহর, অন্যরকম একটা উত্তেজনায় ব্যাকপ্যাকটা কাঁধে নিয়ে নেমে পরলাম।
স্টেশনের বাইরে আমার বন্ধু অপেক্ষা করছিল, এরাইভাল লাউঞ্জে আমাকে দেখামাত্র হাত নেড়ে ছুটে এলো। অনেক দিন পর বন্ধুকে কাছে পাওয়া, প্রবাসের মাটিতে প্রিয় মানুষজনদের আকস্মিক কাছে পাওয়াটা বরাবরই আমার কাছে অন্যরকম আনন্দের দোলা দেয়।
দুজনেই ট্যাক্সি চড়ে বসলাম, গন্তব্য- ইথারবেক। ব্রাসেলস ছোট্ট একটা শহর, এত সুন্দর আর পরিপাটি যে যেদিকে তাকাই চোখ জুড়িয়ে যায়। দুই বন্ধুর কথোপকথন, আর খুনসুটিতে আমরা গন্তব্যে চলে এসেছি। আমার বন্ধু একটা স্টুডিও ফ্ল্যাট (এক বেডরুম, ছোট কিচেন, এটাচড বাথরুম) নিয়ে থাকতো, ইউরোপের স্টুডিও ফ্ল্যাটগুলো সহনীয় ভাড়া ও আনুসাঙ্গিক কম খরচের জন্য ব্যাচেলরদের কাছে খুব জনপ্রিয়। গোসল ও দুপুরের খাবার শেষে দুই বন্ধুর জমিয়ে আড্ডা দিলাম।
দিনের আলো ঝিমিয়ে এলো। পড়ন্ত বিকেলে ভ্রমনপিয়াসু মন আর কিছুতেই ঘরে থাকবে না, তাই মনের সাথে যুদ্ধ না করে বের হয়ে গেলাম আমার প্রথম গন্তব্য Parc du Cinquantenaire (পঞ্চাশতম বার্ষিকী পার্ক) চমৎকার একটা পার্ক, সাথে সুবিশাল খোলা মাঠ। ত্রিশ হেক্টর জায়গা জুরে পার্কটি এত বড় আর এত নয়নাভিরাম যা আমার ক্ষুদ্র লেখনীতে প্রকাশ করতে পারব না। এক পাশে পানির ফোয়ারা, অন্য পাশে মিউজিয়াম, সারি সারি গাছের ছায়া, নাম না জানা পাখির কিচির মিচির আর শত শত পর্যটকের পদচারণ।
১৮৮০ সালে এই পার্কের যাত্রা শুরু হয়েছিল তারপর যুগে যুগে অনেক পরিমার্জন ও সংযোজনের অব্যাহত ধারায় আজকের এই সুবিশাল দর্শনীয় স্থানটি দাঁড়িয়ে আছে কালের ইতিহাস হয়ে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে কখন যে রাতের নীরবতা চলে এলো, বুঝতেই পারিনি। প্রথম দিনের পাঠ চুকিয়ে ঘরে ফেরার পালা এখন...

ভোরের সোনালি আলোয় ঘুম ভেঙ্গে গেছে, টেবিলে রাখা ট্যুরিস্ট ইনফর্মেশন গাইডটা একটু নেড়েচেড়ে দেখছি, ফ্রেশ আপ হয়ে নাস্তার পাট চুকিয়ে যাত্রা করলাম নতুন দিনের নতুন গন্তব্য ইউরোপীয় কমিশনের হেড কোয়ার্টারে।
সুবিশাল স্টার আকৃতির এই কাচের বিল্ডিং সত্যিই খুব মনোমুগ্ধকর। ১৯৬০ সালের নির্মিত এই ভবনটি প্যারিসের ইউনেস্কো হেড কোয়ার্টারের আদলে গড়া। এখানেই অবস্থান করছে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট বিল্ডিং, কাউন্সিল বিল্ডিং, ইউরোপিয়ান এক্সটার্নাল এ্যাকশান সার্ভিস।

ছোট একটা কফি বিরতি শেষ করে মেট্রো ট্রেনে চেপে বসলাম, গন্তব্য- 'দ্য অটোমিয়াম', ১৯৫৮ সালের ব্রাসেলস ওয়ার্ল্ডস ফেয়ার এক্সপো ৫৮ উপলক্ষে নির্মিত অন্যতম নান্দনিক এক ভাস্কর্য।
মেট্রো ত্থেকে নামতে নামতে দুপুরের খাবার বেলা পার হয়ে গেল। হঠাৎ মনে পড়ে গেল সুকান্ত সাহেবের ঝলসানো রুটি পূর্ণিমা চাঁদের কথা। বেলজিয়ামের ট্র্যাডিশনাল ডিশ 'কারবোনাদ ফ্লেমন্দ' এর স্বাদ নেওয়ার জন্য তাই দেরি না করে চলে গেলাম পার্শ্ববর্তী এক বেলজিক রেস্তোরাঁতে। খাবারের দামটা যদিও একটু বেশী ছিল, কিন্তু অসাধারণ স্বাদে দামের বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলাম।
'দ্যা অটোমিয়াম' ১৯৫৮ সালের ব্রাসেলস ওয়ার্ল্ডস ফেয়ার এক্সপো ৫৮ উপলক্ষে নির্মিত হলেও বর্তমানে এটা মিউজিয়াম। এই মিউজিয়ামের ছয়টি গোলক জনসাধারণের দর্শনের জন্য উন্মুক্ত। নিচের গোলকটি ১৯৫৮ সালের এক্সপোর ইতিহাস প্রদর্শনীর জন্য স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত। দ্বিতীয় গোলকটি যে কোন অস্থায়ী প্রদর্শনের জন্য সংরক্ষিত। তৃতীয় বা মধ্যম গোলকটি নানান ইভেন্ট, পার্টি সেন্টার, চলচিত্র ও অন্যান্য সম্মলনের জন্য ব্যবহার করা হয়। উপরের শীর্ষ গোলক একটি রেস্টুরেন্ট। আর ষষ্ঠ গোলকটি ছয় থেকে বারো বছর বয়সী শিশুদের বহুমুখী শিক্ষা কার্যক্রমের ওয়ার্কশপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

এবার বেলজিয়ামের ৩য় দিবসের কথা। গন্তব্য- দ্য গ্র্যান্ড প্লেস, আর তার পাশে 'দ্য সিটি টাউন হল'। ইউরোপিয়ান স্থাপত্যগুলো বরাবরই আমার খুব ভাল লাগে, এত নান্দনিক আর এত মনোমুগ্ধকর যে দৃষ্টি ফেরাতে ইচ্ছা করে না। তারপর চলে গেলাম রয়াল মিউজিয়াম অফ ফাইন আর্টস, মোফ মিউজিয়াম, দ্য রয়্যাল প্যালেস অফ ব্রাসেলস; যদিও বেলজিক রাজা রানি ঐ প্যালেসে থাকেন না তবুও রাজবাড়ি বলে কথা।
চতুর্থ আর শেষ দিন যাত্রা শুরু ব্রাসেলসের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে প্রায় দশ হাজার নয়শত বিষ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত “সনিয়ান ফরেস্ট’’।
সারাদিন ফরেস্টে কাটিয়ে বিদায়বেলা কেন জানি মনটা হঠাৎ খুব উদাস হয়ে গেল, আধুনিক ব্যস্ত শহরের মাঝেও বন জঙ্গল, সাজানো গোছানো তাদের জীবন, আর আমরা! শহর তো অনেক দূরের কথা, গ্রামের জঙ্গল কেটেও সাবার করে দিচ্ছি অজানা মঙ্গলের আশায়।
আমি প্রকৃতি ভালোবাসি, বনের নিরবতা আমাকে অন্যরকম প্রশান্তি দেয়, পাখির কোলাহল, মেঠো পথ, ঝরা পাতার শব্দে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে অজানা পথে। হারিয়ে যেতে চাইলেও হারানো হয় না, ফিরে আসি আপন ঠিকানায়। সময় শেষ হয়ে যায় শুধু শেষ হয় না জীবনের পথচলা...

যেভাবে যাবেন: বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে বেলজিয়ামে ভ্রমণ করতে হলে শুরুতেই ভিসা লাগবে। ঢাকায় বেলজিয়ামের কোন এম্বাসি নেই, শুধু কনস্যুলেট অফিস আছে; কিন্তু সেখানে ভিসা ইস্যু সংক্রান্ত কোন সেবা দেওয়া হয় না। তবে যেহেতু বেলজিয়াম সেনজেনভুক্ত দেশ, সেহেতু ঢাকায় সুইডেন ভিসা এপ্লিকেশন সেন্টারে বেলজিয়ামের ভিসা আবেদন জমা দিতে হয়।
কেউ যদি নব্বই দিনের বেশী ভিসা আবেদন করতে চান, তাহলে দিল্লিতে বেলজিয়াম এম্বাসিতে যেতে হবে কিন্তু নব্বই দিন বা তিন মাসের কম ভিসার জন্য আবেদন করতে চান, তাহলে ঢাকার সুইডিশ ভিসা এপ্লিকেশন সেন্টারে জমা দিতে পারবেন।
ভিসা আবেদনের ফি ৮০ ইউরো সমপরিমান বাংলাদেশি টাকা। ট্রাভেল ইন্সুরেন্স কাভারেজ নূন্যতম ৩০ হাজার ইউরো সমপরিমান হতে হবে এবং অবশ্যই টোটাল ভ্রমণ দিবস কাভারেজ থাকতে হবে।
হোটেল: বেলজিয়ামে পাঁচ তারকা হোটেল থেকে শুরু করে বাজেট হোটেল এনং ইয়ুথ হোস্টেল সবই পাবেন। বাজেট হোটেলে ৩ হাজার থেকে শুরু করে আপনার সাধ্যমত যেকোন রেঞ্জের হোটেল পাবেন। তাছাড়া এয়ার বি,এন,বি তে হোম শেয়ারিং এর জন্যও বুকিং দিতে পারবেন তবে হোম শেয়ারিং এ খরচ তুলনামুলক অনেক কম।
খাবার: বেলজিয়ামের আনাচে কানাচে অনেক বাংলাদেশী রেস্টুরেন্ট আছে। যদিও রেস্টুরেন্টগুলো ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট হিসেবেই পরিচিত, সেখানে আপনি দেশীয় যে কোন খাবার কিনে খেতে পারবেন। এছাড়াও ফাস্ট ফুডের মধ্যে মেক’ডি, বার্গার কিং, সাব-ওয়ে, কেএফসি সহ বিশ্বের নামিদামি ব্র্যান্ডের সব খাবার পাবেন।
*
প্রিয় পাঠক, এই লেখাটি একজন কন্ট্রিবিউটর লিখেছেন। চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন