গত দুই দশকে অন্তত ৮৭ হাজার বাংলাদেশি ফ্রান্সে গিয়ে আশ্রয় চেয়েছে। নাগরিকত্ব নিয়ে সেখানে বসবাস করছে অন্তত ১২ হাজার বাংলাদেশি। একদিকে ফ্রান্সের পণ্য বর্জন আরেকদিকে ফ্রান্স যাওয়ার এই চেষ্টাটা কী দ্বিচারিতা নয়?

একটা পোস্ট দিয়ে জানতে চেয়েছিলাম, একদিকে বাঙালি মুসলমানরা ফ্রান্সের পণ্য বর্জনের ডাক দিচ্ছে আবার সুযোগ পেলে তারাই আশ্রয়ের জন্য ফ্রান্স যেতে চায়। কথাটা বলেছি দ্বিচারিতা অর্থে। শুনে অবাক হতে পারেন কিন্তু বাস্তবতা হলো, পৃথিবীর যে দেশটিতে গিয়ে বাংলাদেশি মুসলমানরা সবচেয়ে বেশি আশ্রয় চায় তার নাম ফ্রান্স। গত দুই দশকে অন্তত ৮৭ হাজার বাংলাদেশি ফ্রান্সে গিয়ে আশ্রয় চেয়েছে। নাগরিকত্ব নিয়ে সেখানে বসবাস করছে অন্তত ১২ হাজার বাংলাদেশি। 

ব্যক্তিগতভাবে আমি বাংলাদেশ ছেড়ে কোথাও যেতে চাই না। আর দেশ ছাড়ার ভাবনা এলেও আমার মধ্যে ফ্রান্স যাওয়ার ভাবনা কোনদিন আসেনি। সাম্প্রতিক ঘটনার পর আরও আসবে না। অথচ শুধু বাংলাদেশ নয়, মরক্কো, সিরিয়াসহ অনেক দেশের মুসলমানরাই ফ্রান্সে যেতে চায়। আমি জানতে চাই, একদিকে  ফ্রান্সের পণ্য বর্জন আরেকদিকে ফ্রান্স যাওয়ার এই চেষ্টাটা কী দ্বিচারিতা নয়?

ব্যক্তিগতভাবে আমি ফ্রান্সের কোন পণ্য ব্যবহার করি না। কিন্তু আমি চাই ফ্রান্স আমাদের কাছ থেকে পোষাক কিনুন। আমার কাছে সবার আগে বাংলাদেশ। আমি কোনভাবেই চাই না ফ্রান্সে বাংলাদেশের রপ্তানির বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হোক। কিন্তু আপনারা যারা রোজ ফ্রান্সের বিপক্ষে ফেসবুকে লিখছেন আচ্ছা আপনারা কী ফ্রান্সে থাকা আপনাদের আত্মীয়-স্বজন কাউকে বলেছেন যে ওইদেশ বর্জন করো। না বললে কেন বলেননি? আমি তো মনে করি আপনারা যদি আসলেই মন থেকে বিশ্বাস করেন যে ফ্রান্স আমাদের মহানবীকে (সা.) অপমান করেছে তাহলে কী সেই দেশ বর্জনের ডাক দেওয়া উচিত না?

আরেকটা কথা বলি, আপনারা যারা মনে করেন একটা কার্টুন আকলেই মহানবী (সা এর)  অবমাননা হয় তাদের বলি, আমাদের নবী (সা.) এর চেহারা মোবারক তো কেউ দেখেনি। কাজেই একটা কার্টুন একে মহানবীকে ব্যঙ্গ করতে পারবে সেটা আমি মনে করি না। হ্যা, এই যে আধুনিকতা বা প্রগতিশীলতার নামে প্রায়ই কোরান পোড়ানো, নবীকে গালাগাল এগুলো মু্র্খতা। একদল লোক নিজের জ্ঞান প্রমাণ করতে এগুলো করে। তারা রসুলকে অপমান করে। আমি এগুলো ভীষণ অপছন্দ করি। কিন্তু কারও ধ্বংস আমি কামনা করি না। বরং চাই যারা এগুলো করে আল্লাহ তাদের হেদায়েত দিক। 

আচ্ছা একবার ভেবে দেখুন তো রসুলের জীবনটা। এখন তো কার্টুন আঁকছে কিন্তু রাসুল (সা.) বেঁচে থাকতে কীভাবে তাকে আক্রমণ করা হয়েছে? কাফেররা তাকে সারাজীবন অপমান করেছে। কষ্ট দিয়েছে। অসম্মান করেছে। হামলা করেছে। কিন্তু জবাবে রসুল কী করেছে তাদের মেরেছে? বিদায় হজ্জের ভাষণটা শুনুন। 

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার প্রতীক।যারা তাঁকে বঞ্চিত করত, তাদের তিনি অকাতরে দান করতেন। যারা জুলুম করত, তাদের প্রতি তিনি ছিলেন উদার। তিনি হিজরতের আগে তায়েফে ইসলাম প্রচার করতে যান, তখন সেখানকার মানুষ তাঁকে অকথ্য অত্যাচার করে তাড়িয়ে দেয়। তখন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, হে আল্লাহ! এরা কী করেছে, তা এরা বুঝতে পারছে না। তুমি এদের অন্তঃকরণে জ্ঞানের আলো প্রজ্বালিত কর।

ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ বাংলাদেশেই হয়েছে

হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি কখনো নিজের তরফ থেকে কারও জুলুমের বদলা নিতে দেখিনি। যুদ্ধ ছাড়া নিজ হাতে কোনো মানুষ এমনকি কোনো জীবজন্তুকে পর্যন্ত আঘাত করেননি। আচ্ছা তার উম্মত হয়ে আমরা কথায় কথায় কীভাবে এতো হিংসা ছড়াই। কীভাবে মানুষ মেরে আগুনে জ্বালিয়ে দেই। আচ্ছা এ কোন ইসলাম আমাকে বলেন তো? 

আমার কথা শুনলে আপনারা অনেকে রাগ করতে পারেন। দেখেন তো কোরানের প্রথম আয়াত কী? প্রথম আয়াত ইকরা। মানে পড়ুন। মূলত এই শব্দটিই প্রকৃতপক্ষে ইসলামের মূল এবং ভবিষ্যতের নির্যাস। ইসলামে বারবার পড়া বিশেষত জ্ঞানচর্চার কথা বলা হয়েছে। আচ্ছা বলুন তো কোথায় আজকে সেই জ্ঞানচর্চা? আমি মনে করি যেদিন থেকে মুসলামনরা জ্ঞান চর্চা থেকে সরে গেছে সেদিন থেকেই তাদের পতন শুরু হয়েছে। 

আরেকটা বিষয় হলো আখলাক। আজকে সারা বিশ্বের দিকে তাকান। আরব দেশগুলোর দিকে তাকান দেখেন কীভাবে হানাহানি চলছে। অথচ রসুল ও তাঁর সাহাবীদের চরিত্র দেখুন। আমি মনে করি অন্যদের প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে নয় বরং মুসলমানরা যদি তাদের আখলাক ঠিক করবে, রসুলের আদর্শ মেনে চলে এমনিতেই ভালো মানুষ হতে পারবে। 

আচ্ছা বলেন তো রসুলের যে আদর্শ সত্যবাদিতা, সৎপথে চলা, মানুষকে ভালোবাসা, মানুষের বিপদে পাশে থাকা, উদারতা এই গুণগুলো কী আমাদের আছে? নিজের নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ যে সবচেয়ে বড় জিহাদ সেটা আমরা ভুলে গেছি। ভেবে দেখেন নামাযের খবর নেই, হালাল আয়ের খবর নেই, হুট করে ফেসবুকে এসে আরেকজনকে গালি দেয়া, আরেকজনকে ছোট করার মধ্যেই আমাদের সব বাহাদুরি। আমরা মনে করি এতেই বুঝি ইসলাম পালন হয়ে যায়। কিন্তু বিশ্বাস করেন কোরান-হাদিস বা ইসলাম সম্পর্কে আমি যতোটা পড়েছি তাতে কোথাও মানুষকে হত্যা করে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া সমর্থন করে না। রসুল কোনদিন সেটা করেননি। 

আমার শুভাকাঙ্খিরা আমাকে প্রায়ই বলে ভাই আপনি যে এতোকিছু লেখেন কেউ শোনে এগুলো? ওরা তো না বুঝেই আপনাকে গালি দেয়, তবু কেন লিখেন? আমি বলি আমি লিখি কারণ রসুলের আদর্শে বিশ্বাসী। আমি মনে করি মানুষকে ঠিক পথে চলতে সাহায্য করা আমার কাজ। তাই আমি লিখি। লিখবো। 

সবাইকে অনুরোধ চলুন ঘৃণা না ছড়িয়ে, মুর্খের মতো কথা না বলে আমরা বিনয়ী হই, মানবিক হই। আমি নিশ্চিত প্রতিটা মুসলমান যদি রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুসরণ করে তাহলে আর অন্য কিছু নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা করতে হবে না। চলুন আমরা মানবিক মানুষ হই। মানুষে মানুষে ঘৃণা না ছড়াই। মানুষকে ভালোবাসি। মনে রাখবেন, আপনি যদি একজন মানুষকে কষ্ট দেন তাহলে সেই লোক যদি ক্ষমা না করে স্বয়ং আল্লাহও আপনাকে ক্ষমা করবে না। কাজেই মানুষ হওয়াটা, মানুষকে ভালোবাসাটা খুব জরুরী। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সত্যিকারের মানুষ হওয়ার তৌফিক দিন। আমিন।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা