কিছু একটা হলেই টেন মিনিটস স্কুল, একাত্তর টিভি বা ফ্রান্সকে বয়কটের হিড়িক শুরু হয়। কিন্ত আরবি পড়ানোর নাম করে, আল্লাহর ভয় দেখিয়ে মাদ্রাসায় যে শত শত শিশুকে ধর্ষণ করা হয়, তাদেরকে কেন বয়কট করা হয় না?

ফেসবুকে ফ্রান্সকে বয়কটের একটা হিড়িক চলছে। ফ্রান্স দেশটাকে বয়কট করার, ফরাসী ব্র‍্যান্ড এবং পণ্য বয়কটের ডাক দেয়া হচ্ছে। বয়কট ফ্রান্স, বয়কট ফ্রেঞ্চ প্রোডাক্ট- এরকম বাহারী হ্যাশট্যাগ ভাইরাল হচ্ছে, অনেক জায়গায় ফ্রান্স বানানটাও আবার ভুল। কেউ ফ্রান্সকে বয়কট করতে চাইলে করবে, সেটা তার ব্যাপার। ফ্রান্সের পণ্য ব্যবহার করতে না চাইলে না করবে, সেটাও যার যার ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অন্তর্গত। কেউ যদি মনে করে ফ্রান্স নামক রাষ্ট্রটা এবং তার ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা মিলে ইসলাম ধর্ম এবং মহানবীকে ইচ্ছাকৃতভাবে কটুক্তি করছে, সে অবশ্যই ফ্রান্স এবং ফ্রান্সের পণ্য বয়কট করতে পারে, অর্থনৈতিক চাপ তৈরি হোক বা না হোক, এই প্রতিবাদের অধিকার প্রত্যেকের আছে। 

ফ্রান্স বয়কটের ডাক নিয়ে আমার কোন আপত্তি নেই। তবে একটা জায়গায় প্রশ্ন আছে। আমরা কি বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোকে বাদ দিয়ে তুলনামূলক অগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো নিয়ে বেশি মাতামাতি করি না? টেন মিনিট স্কুল বয়কট, একাত্তর টিভি বয়কট, ফ্রান্স বয়কট- সবই কিন্ত ওই ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানার অজুহাতে। আমার প্রশ্ন একটাই, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে যে মাদ্রাসায় শিক্ষক নামধারী কিছু কুলাঙ্গারের হাতে ছাত্ররা ধর্ষণ এবং যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছেন, তখন ধর্মানূভুতিতে আঘাত লাগে না? তখন কেন কেউ বয়কটের ডাক দেয় না? 

কেন মাদ্রাসায় ছাত্র ধর্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ এই ইস্যুটা নিয়ে কথা বলতে গেলে সবাই 'আরে ধর্ষণ তো স্কুল-কলেজেও হয়' বা 'এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা' বলে পাশ কাটাতে চায়? কেন কুলাঙ্গার কিছু শিক্ষকের সমালোচনা করাটাকে একদল ধর্মান্ধ লোক 'ধর্মের সমালোচনা' বলে মনে করে? এরা আসলে কাদের পিঠ বাঁচাতে চায়? ধর্ষকদের রক্ষা করার বেলায় এদের স্বার্থটা কী?

এরকম ঘটনা প্রতিদিনই চোখে পড়বে

ফ্রান্সে যেটা হয়েছে, সেটা জঘন্য একটা কাজ। কল্পিত কার্টুন প্রদর্শনের প্রতিবাদে কাউকে হত্যা করাটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আবার সেই হত্যাকান্ডের পর ফ্রান্স সরকার যা করছে, যেভাবে প্যারিসের ভবনে, দেয়ালে সেই কার্টুনগুলোই বড় করে এঁকে প্রদর্শন করছে, সেটাও কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এটাও এক ধরনের উগ্রপন্থা, একটা নির্দিষ্ট ধর্ম এবং সেই ধর্মের অনুসারীদের প্রতি ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ। একটা রাষ্ট্র কখনোই একজনের অপরাধের দায় পুরো কমিউনিটির ওপর চাপিয়ে দিতে পারে না। 

আপনি ফ্রান্সকে বয়কট করুন, ফ্রেঞ্চ পণ্য বয়কট করুন, আপনাকে আমি সমর্থন দেবো। কিন্ত তার আগে আমাকে বলুন, মাদ্রাসায় যারা ইসলামী শিক্ষা দেয়ার নাম করে কোমলমতি শিশুদের ধর্ষণ করে, সেই নরপিশাচগুলোকে বয়কটের ডাক কেন কেউ দেয় না? টেন মিনিটস স্কুল, আয়মান সাদিক বা একাত্তর টিভি বয়কটে যত আগ্রহ দেখি, তার এক শতাংশও কেন এই অমানুষগুলোকে বয়কটের বেলায় দেখা যায় না? 

যারা মাদ্রসায় ধর্ষণের ঘটনাগুলোকে 'সংখ্যায় অতি নগণ্য' ভেবে উড়িয়ে দেন, তাদের জন্য একটা পরিসংখ্যান দেই। গত সপ্তাহের শনিবার থেকে শুক্রবার, শুধু এই সাত দিনে পত্রিকায় বারোটি ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে, মাদ্রাসায় ছাত্র ধর্ষণের। করোনার কারনে অনেক মাদ্রাসা বন্ধ, তবুও সপ্তাহে বারোটি ধর্ষণের ঘটনা মিডিয়ার নজরে এসেছে। বাস্তব সংখ্যাটা আরও তিন-চারগুণ বেশি বলেই ধরে নিন। তবুও আমরা শুধু পত্রিকায় প্রকাশিত সংখ্যাটা নিয়েই কথা বলি। সপ্তাহে বারোটা, মাসে ৪৮টা, বছরে অন্তত সাড়ে ছয়শো শিশু মাদ্রাসায় বা মক্তবে পড়তে গিয়ে শিকার হচ্ছে শিক্ষক নামধারী কুলাঙ্গারদের লোলুপ লালসার। 

প্রথম আলোতে প্রকাশিত খবর

প্রতিবছর শীতকালে সারাদেশে ওয়াজ মাহফিল হয়। দুনিয়াবি কত বিষয় নিয়ে সেখানে আলোচনা হতে দেখি। নারীর পোশাক থেকে হিন্দুর পূজা, নীল আর্মস্ট্রংয়ের কাল্পনিক ইসলাম গ্রহণ থেকে এন্টারকটিক মহাদেশের অস্তিত্ব- সবকিছু নিয়েই বক্তারা কথা বলেন, বলেন না শুধু মাদ্রাসায় পড়ুয়া শিশু-কিশোরদের ওপর হওয়া অবর্ণনীয় এই নির্যাতন নিয়ে। এই একটা বিষয়ে কাউকে মুখ খুলতে দেখা যায় না। না গিয়াসউদ্দীন তাহেরী, না মিজানুর রহমান আজহারী। ছাত্র ধর্ষণের ঘটনায় গ্ল্যামার নেই, নারীর পোশাকের মতো রগরগে বর্ণনা নেই, বলতে গিয়ে শরীরে জোশ আসে না, তাছাড়া অপরাধীরা সবাই পাঞ্জাবী-জোব্বা পরিহিত- তাই এদের নিয়ে কথা বলার রিস্কও কেউ নিতে চায় না! 

আমি আমার স্বল্প জ্ঞানে যেটা বুঝি, টেন মিনিটস স্কুলের একটা ভিডিওতে যৌনতায় নারীর সম্মতি নিয়ে কথা বলা হলে তাতে ইসলামের কোন ক্ষতি হয় না। তাদের এক বা দুইজন মেম্বার সমকামীতাকে সমর্থন করলেও ইসলামের ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। একাত্তর টিভিতে যখন বলা হয় যে বাংলাদেশের অনেক মসজিদ অবৈধ জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে, তখনও আমি তাতে ইসলামের ক্ষতি হতে দেখি না, কারন তেতো হলেও কথাটা সত্যি। এদেশে অনেক অঞ্চলেই মসজিদ বানানোটা অন্যের জমি দখলের একটা মূখ্য উদ্দেশ্য। 

কিন্ত আমি যখন দেখি মাদ্রাসায় আরবি পড়ানোর নাম করে বাচ্চাদের ধর্ষণ করা হয়, হুজুর আবার এসব পাপ করার সময় ছাত্রদের আল্লাহর গজবের ভয় দেখান, অবুঝ শিশুগুলোকে ধর্মের ভয় দেখিয়ে কাবু করে রাখেন- তখন ইসলামের ক্ষতি হয়। অথচ সেই ক্ষতি নিয়ে কেউ কথা বলে না, এই পিশাচগুলোকে কেউ বয়কট করে না, বয়কটের ডাক দেয়া হয় শুধু একাত্তর টিভির বেলায়, ফ্রান্সের বেলায়। 

এসব পিশাচদের বয়কটের ডাক কেউ দেয় না

এই যে এতগুলো বাচ্চাকে প্রতিদিন, প্রতি বছর মেন্টাল ট্রমার মধ্যে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, শিশুগুলোর স্বাভাবিক মানসিক বিকাশটা নষ্ট করে দেয়া হচ্ছে, মানসিক আঘাতের মাধ্যমে তাদেরকে জম্বি বানিয়ে ফেলা হচ্ছে, আর পুরো কাজটাই করা হচ্ছে ধর্মের নাম ভাঙিয়ে, হুজুরের কথা না শুনলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবেন- এরকম যুক্তি দেখিয়ে। অথচ আমাদের দেশের ইসলামিক স্কলাররা, যারা কিনা সময়ে অসময়ে অমুক-তমুককে বঅয়কটের ডাক দেন- তাদেরকে কখনও এই ঘটনাগুলোর সমালোচনা করতে দেখিনি। কখনও শুনিনি যে তারা মাদ্রাসায় ঘটা নিপীড়নের প্রতিবাদ করছেন।

তারা কখনও বলেন না যে মাদ্রাসায় ঘটতে থাকা এরকম পাপাচার বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে, এমন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যেই জড়িত থাকুক, তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে, সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। এই অপরাধীরা বুক ফুলিয়ে সমাজে দাপিয়ে বেড়ায়, কিন্তু তারা টু-শব্দটিও করেন না এদের বিরুদ্ধে। অথচ আমার ধারনা, টেন মিনিটস স্কুল, একাত্তর টিভি বা ফ্রান্সকে বয়কটের চেয়ে এই নিপীড়ক পাপিষ্ঠদের বয়কট করাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা তো জাতিগতভাবেই অগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বেশি নাচানাচি করি, তাই একাত্তর বা ফ্রান্স বয়কট আমাদের কাছে পাত্তা পায়, আড়ালে থেকে যায় মাদ্রাসায় যৌন নিপীড়নের এই রোমহর্ষক ঘটনাগুলো...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা