যেখানে বেঁচে থাকার লাইসেন্স নেই, যেখানে অন্যায়ের বিচার নেই, সেখানে তিনি কতটা আর হিংস্র হবেন, কার উপর রাগ দেখাবেন। অক্ষমের ক্রোধকে কেউ পাত্তা দেয় না। তিনি তাই নিজের গায়ে গ্যাসোলিন দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিলেন...

যুবকের নাম মোহাম্মদ বোয়াজিজি। তিনি জন্মেছেন আফ্রিকার উত্তরদিকের একটি দেশ তিউনিসিয়ায়। অল্প বয়সে তার জীবনে এক করুন অধ্যায় আসলো। বয়স যখন তিন বোয়াজিজি হলেন পিতৃহারা। এই ছেলেটির পিতা লিবিয়ায় নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। পরিবারের মাথাকে হারিয়ে বোয়াজিজির পরিবার হয়ে পড়লো খুঁটিহীন।

তিউনিসিয়া এক কোটি মানুষের দেশ। এই দেশটিতে ছিলেন এক শাসক, বেন আলী। তিনি যেন শুধুই এক শাসক নন, ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন রাজা। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। নির্বাচন হলেই তিনি বিপুল ভোটে জেতেন। কিন্তু, জনগণ কি খুব সন্তুষ্ট তাকে নিয়ে?

যদিও উন্নয়নের রিপোর্টে ভালই অবস্থান অর্জন করেছিল দেশটি। ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম ২০০৯ সালে দেশটিকে আফ্রিকার সবচেয়ে প্রতিযোগিতাপ্রবণ দেশ বলে আখ্যায়িত করেছিল। বেন আলীর সময়ে তিনি এতটাই একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিকে ঝুঁকেছেন যে কখনো কখনো ধর্মীয় স্বাধীনতা পর্যন্ত হরণ হয়েছে দেশটিতে। জনবহুল এলাকায় মুসলিম নারীরা হিজাব পড়ার স্বাধীনতা পেতেন না। সংবাদমাধ্যম ছিল নিয়ন্ত্রিত। দেশটির কৃষিপ্রধান অঞ্চলগুলোর মানুষ সুখে ছিলেন না। দুর্নীতির করালগ্রাস ছেয়ে ধরলো তিউনিসিয়াকে। রাষ্ট্রীয় লুটপাটের অনিয়মই যেন এখানে নিয়ম।

নিম্মশ্রেনীর পরিবারগুলো এখানে বেশ মুশকিলের জীবনে অতিষ্ঠ। বোয়াজিজিও এমনই এক নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। বাবা মারা যাওয়ার পর দশ বছর বয়স যখন তার, তখন থেকেই সংসারের সমর্থনে তাকে জীবিকা খুঁজতে হয়েছে। বোনদের পড়ালেখার খরচ জোগাতে হয়েছে। নিজেও পড়ালেখার চেষ্টা করেছেন কিছু। কিন্তু, বেশি দূর নয়। হাইস্কুল লেভেল পর্যন্ত পড়েই থামতে হয়েছে তাকে। না থেমে উপায় কি! যে দিনকাল পড়েছে তিউনিসিয়ায় তাতে উচ্চশিক্ষিত হয়ে বেকার থাকাটাই যেন নিয়তি। উচ্চাকাঙ্খার লোভে অতটুকু নির্মম জীবনের অপেক্ষা তিনি করেননি। নেমে গেছেন ফলের ব্যবসায়।

আরব বসন্তের শুরুটা হয়েছিল বোয়াজিজির মাধ্যমেই

ফুটপাতে তার একটি ফল সবজির দোকান ছিল। কিন্তু, নির্বিগ্নে রুটিরুজি করবেন তার উপায় নেই। পুলিশ প্রায়ই সমস্যা করে৷ পুলিশের উৎপাত বাড়ছিল দিনে দিনে। ব্যবসা করতে হলে তাদের ঘুষ দিতে হবে, না দিলে ফুটে যেতে হবে, এমন অবস্থা। কিন্তু এভাবে কতদিন সহ্য করা যায়! ডিসেম্বর ১৭, ২০১০। অন্যান্য দিনের মতো বোয়াজিজি তার ফল-সবজির গাড়ি নিয়ে বের হলেন। গাড়িটা তার নিজের না। ধার করা এই গাড়ি নিয়ে যখন নামলেন রাস্তায়, প্রসাশনের লোক এসে থামালো তাকে। পুলিশের অনুমতি ছাড়া বোয়াজিজি কেন জীবিকা নির্বাহ করবে এই ছিল অভিযোগ। হায় তিউনিসিয়ার পুলিশ, বেঁচে থাকার লাইসেন্সও যেন তাদের হাতে জিম্মি। যেমন আটক হলো বোয়াজিজির বেঁচে থাকার অবলম্বন ফল-সবজির গাড়িটি। শুধু তাই নয়, প্রশাসনের পক্ষ থেকে আগত এক নারী বোয়াজিজিকে থাপ্পড় মেরে বসলেন। অপমানে বোয়াজিজির লজ্জার সীমা রইলো না৷ একনায়কতন্ত্র যারা মানে, তাদের লজ্জা না থাকতে পারে, কিন্তু সাধারণ বোয়াজিজির লজ্জা আছে।

একনায়করা আইনের দোহাই দিয়ে কথা বলেন। বোয়াজিজি তাই একনায়কতন্ত্রের দেশটিতে আইনের আশ্রয় চাইলেন প্রথমে। অভিযোগ নিয়ে গেলেন গভর্নরের কাছে। কিন্তু, গভর্নর তার সাথে দেখাই করলো না। বোয়াজিজির তখন কি মনে হলো কে জানে! হয়তো তার সহ্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকা একজন অসহায় মানবসন্তান তিনি। তার মাথায় কি কাজ করেছিলো তখন কে জানে! তিনি অদ্ভুত এক কাজ করে বসলেন। গভর্নরের অফিসের সামনে এক টিন গ্যাসোলিন নিয়ে এলেন।

না গভর্নরের অফিস পুড়িয়ে দেননি তিনি। যেখানে বেঁচে থাকার লাইসেন্স নেই, যেখানে অন্যায়ের বিচার নেই, সেখানে তিনি কতটা আর হিংস্র হবেন, কার উপর রাগ দেখাবেন। অক্ষমের ক্রোধকে কেউ পাত্তা দেয় না। তিনি তাই নিজের গায়ে গ্যাসোলিন দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিলেন। একজন জীবন্ত মানুষ সারাজীবন অন্তরে যেভাবে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিলেন এইসব অনিয়মের ভেতর, তা যেন আজ বহিরাগত হয়ে দৃশ্যমান হলো এই অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে। মানুষ দেখলো, গভর্নরের অফিসের সামনে জ্বলছে এক অসহায় প্রাণ৷

আত্মাহুতি দেয়া বোয়াজিজিকে স্মরণ করছে তিউনিসিয়ার মানুষ

হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল বোয়াজিজিকে। কিন্তু তার মেয়াদ ছিল আর মাত্র আঠারো দিন। মৃত্যুর সাথে লড়াইটা এর চেয়ে বেশি আর দীর্ঘস্থায়ী হলো না। কিন্তু, তিনি জ্বালিয়ে গেলেন জীবনের লড়াই। আগুন দিয়ে নিজেকে যেদিন জ্বালিয়ে দিলেন তিনি, পরদিন বিক্ষোভ হলো ছোট পরিসরে। সিদি বৌজিজ শহরে সেই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে ছিলেন বোয়াজিজির গর্ভধারিণী মা এবং কিছু বন্ধু-স্বজন। সেই বিক্ষোভের ছবি ইন্টারনেটে প্রকাশিত হলো। আল জাজিরাতে প্রচারিত হলো। ফলে তিউনিসিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে এই খবর অজানা থাকলো না।

সবার মধ্যেই চাপা ক্ষোভ ছিল। তা যেন স্ফুলিঙ্গের মতো বেরিয়ে আসার মোক্ষম এক যুতসই কারণ খুঁজে পেল। এরপর একের পর এক বিক্ষোভ, বিপ্লব, মিছিল সংগঠিত হচ্ছে তিউনিসিয়ায়। বোয়াজিজির ঘটনার প্রতিবাদে সংগঠিত বিক্ষোভের বিষয় বিস্তৃত হতে থাকে। বেকার যুবকরা বলতে থাকেন অর্থনৈতিক দুরবস্থার কথা, বেকার জীবনের অভিশাপের কথা, দুর্নীতির কথা, বেন আলীর একনায়কতন্ত্রের কথা। বিপরীতে একনায়ক বেন আলীর খুঁটির সৈনিক রাষ্ট্রীয় বাহিনী বিক্ষোভকারীদের দমনে মাঠে নামে। কিন্তু, মধ্যবিত্তের ভেতর এই আন্দোলন এতটাই ছড়িয়ে যায় যে, এই দাবানল থামানো অসম্ভব হয়ে পড়ে।

এর মধ্যে আবার আইনজীবীরা স্ট্রাইক করে, শ্রমিক ইউনিয়ন স্ট্রাইক করে। অবস্থা বেগতিক টের পেয়ে বেন আলীর পার্টির অনেকেই দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করে। বেন আলী নিজেও গদি ছাড়েন, দেশও ছাড়েন প্রবল আন্দোলনের মুখে, ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি। এই বিপ্লব তিউনিসিয়ায় জেসমিন বিপ্লব নামে খ্যাত। কোনো দল, গোষ্ঠী থেকে এই আন্দোলন সূচিত হয়নি, একজন অখ্যাত ফল বিক্রেতা বোয়াজিজিই জ্বালিয়ে গেছেন এই বিপ্লব। এই ঢেউ লাগে অন্যান্য আরব দেশেও, যেখানে স্বৈরাচাররা আসন গেড়ে বসেছিলেন। তিউনিসিয়ার জেসমিন বিপ্লবের পর বিপ্লব হয় মিশরে। সেটিও সফল হয়। হোসনি মোবারক বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করেন। আরব বসন্তের ঢেউ এরপর কি তীব্রতা ধারণ করেছে সেই গল্প নাহয় তোলা থাকলো অন্য কোনো লেখার জন্যে...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা