দরপত্রের রূপকথা: তিন কোটি টাকার বাঁশের সাঁকো!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
টেন্ডার লিস্টে এমন ১৩টি জায়গায় ব্রিজ সংস্কার করা হবে বলে টাকার অনুদান নেওয়া হয়েছে, সেসব জায়গায় আসলে ব্রিজের কোনো অস্তিত্বই নেই! সংস্কার তো দূরের কথা...
আমাদের দেশে 'উন্নয়ন প্রকল্প' বরাবরই এক প্রহসনের নাম। কারা যে এর দায়িত্বে থাকে, তারা কী যে করে, দিনশেষে কতটুকুই বা উন্নয়ন হয়... তার পুরোটা নিয়ে লিখতে গেলে সাত কাণ্ড রামায়ন হয়ে যাবে। উন্নয়ন প্রকল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটা নিয়েই বিস্তর অভিযোগ আছে জনসাধারণেরও। আবার, জনসাধারণের খুব বেশি কিছু করার নেইও। তারা অভিযোগ জানায়, হয়তো কর্তৃপক্ষ শোনে, হয়তো শোনে না। এরপর নতুন কোনো প্রসঙ্গ আসে, এরকম উন্নয়ন প্রকল্পের কথা মানুষ ভুলেও যায় একসময়ে এসে৷ উন্নয়নের কথা শুনতে শুনতে ভোগান্তিতে দিন কাটানোই তাদের একমাত্র নিয়তি। এটাই হয়ে এসেছে আবহমান কাল ধরে।
প্রহসনের উন্নয়ন প্রকল্পের সূত্র ধরে এক অদ্ভুতুড়ে রহস্যেঘেরা উন্নয়ন প্রকল্পের খবর পাওয়া গেলো সম্প্রতি, যেখানের ধোঁকাবাজির গল্প ছাড়িয়ে গিয়েছে সাম্প্রতিক সময়ের আর যেকোনো ধোঁকাবাজিকেই। আয়রন ব্রিজ পুনর্নির্মাণ প্রকল্প অথবা আইবিআরপি এর আওতায় গত ২৮ জুলাই ৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বরগুনার আমতলী ও তালতলী উপজেলায় ৩৩টি লোহার ব্রিজ সংস্কারের জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এই টেন্ডারের লিস্ট প্রকাশের পরই তা আলোচনার জন্ম দেয় স্থানীয় সবার মধ্যে। মোট আটটি প্যাকেজের অধীনে ৩৩টি লোহার ব্রীজ সংস্কারের কথা বলা হয় এ দরপত্রে। কিন্তু সেখানে কোন ব্রীজ সংস্কারের জন্যে কত টাকা খরচ হবে... তা নিয়ে কোনো কিছু বলা হয় নি। মূল সমস্যা আসলে টেন্ডার লিস্টের এই ঝাপসা কনসেপ্টেও না। মূল সমস্যা হচ্ছে, টেন্ডার লিস্টে এমন ১৩টি জায়গায় ব্রিজ সংস্কার করা হবে বলে টাকার অনুদান নেওয়া হয়েছে, সেসব জায়গায় আসলে ব্রিজের কোনো অস্তিত্বই নেই! অথচ সে সব জায়গাতেও ব্রীজের সংস্কারের জন্যে টাকা খরচের কথা বলা হয়েছে!
পরবর্তীতে এ বিষয়টি জানাজানি হলে এলাকায় বেশ চাঞ্চল্য ছড়ায় এবং এলজিইডি কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এই টেন্ডার'কে বাতিল করা হয়৷ বিবিসি বাংলার বরাতে জানা যায়, স্থানীয় একজন সাংবাদিক টেন্ডার পাওয়া জায়গাগুলোতে ঘুরে এসে কমপক্ষে চারটি জায়গা এমন পেয়েছেন, যেখানে কোনো সেতুই নেই। সে সাথে তিনি জানান একটি ভয়ঙ্কর তথ্যও। টেন্ডারে একটি খালের নাম বলা হয় নাশবুনিয়া। যে খালের ওপরেও চার কোটি টাকার একটি ব্রিজ রয়েছে বলে জানানো হয়। অথচ এ নামে নাকি কোনো খালই নেই ঐ এলাকায়!
এটুকুতে থামলেও হতো। মিথ্যের বেশাতি গড়িয়েছে আরেকটু দূর। দরপত্রের এই তালিকায় প্রায় সবগুলো ব্রিজের দৈর্ঘ্যই নির্ধারিত দৈর্ঘ্যের চেয়ে বাড়িয়ে দেখানোর পাশাপাশি অনেক জায়গাতে লোহার ব্রিজের জায়গায় বানানো হয়েছে বাঁশের সাঁকোও!
এরকম অদ্ভুতুড়ে কর্মকাণ্ড চলছে এই দরপত্রকে কেন্দ্র করে। স্থানীয় মানুষজন প্রতিবাদ করেছে, বিক্ষোভ সমাবেশও করেছে। এই মানুষজন প্রতিবছরই একটা ভালো ব্রিজের জন্যে, একটা শক্তপোক্ত ব্রীজের জন্যে ধর্না দিয়েছে এলজিইডি অফিসে, জনপ্রতিনিধিদের কাছে। আশ্বাস পেয়েছেন, ব্রীজ পাননি। বাধ্য হয়েই বাঁশের সাঁকো দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে পার হচ্ছেন তারা নিয়মিত। অথচ আজ তারা জানতে পারছেন, তাদের বাঁশের সাঁকোর জায়গায় তিন কোটি টাকার লোহার সেতুর বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। সে টাকায় ব্রীজ আসেনি। সে টাকা কোথায় তাও তারা জানেন না৷ অসহায় মানুষগুলো মনের দুঃখ কোথায় প্রকাশ করবেন, তাও তারা জানেন না। এভাবেই চলছে।
অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করি প্রশাসনের দিক থেকে। কারা এমন অদ্ভুতুড়ে ও মিথ্যে কথার টেন্ডার লিস্ট বানালো, তা নিয়ে প্রশাসন কোনো কথাই বলেনা। এবং বিষয়টিকে ধামাচাপা দেয়ার জন্যে তারা বারবারই বলে যাচ্ছে, একটা ভুল হয়েছিলো। ঢাকা থেকে লোক এসেছিলো। এখন আবার নতুন করে টেন্ডার দেওয়া হবে। স্রেফ এটুকুই। তাদের মুখ থেকে আর কিছু বের করা যায় না আর।
আচ্ছা, মানলাম। নতুন করে টেন্ডার লিস্ট করা হবে। এটাতে সমস্যা দেখিনা। কিন্তু একটা প্রশ্ন রয়েই যায়, যদি স্থানীয় সেই সাংবাদিক ও মানুষজন এই ভুলগুলো ও প্রহসনগুলো চোখে আঙুল দিয়ে না দেখাতো, তাহলে এলজিইডির বরগুনা কিংবা আমতলী কার্যালয়ের কর্মকর্তারা কী এই ভুতুড়ে লিস্টটা বাস্তবায়নের জন্যেই পারমিশন দিতেন? একটা দরপত্র যখন করা হয়, তখন যারা এটির সাথে যুক্ত, তাদের কী একবার হলেও খোঁজ নেয়া উচিত ছিলো না, দরপত্রের সব তথ্য, সব পরিসংখ্যান ঠিক আছে কী না? লোহার ব্রিজের জায়গায় বাঁশের সাঁকো, কল্পিত খালের ওপরে চার কোটি দামের ব্রিজ, ব্রিজের দৈর্ঘের আকাশকুসুম বৃদ্ধি নিয়ে তাদের কেন কোনো ধারণা থাকবেনা? নাকি, তারা সবই জানতেন? জেনেও চুপ ছিলেন অর্থকড়ির মোহে? সর্ষের মধ্যেই কি ভূত তাহলে?
আমরা বিভিন্ন বিষয়ে সরকারকে গালিগালাজ করি, দোষারোপ করি। বটি, বালিশের কাভার, জানালার পর্দার লাখ লাখ দাম দেখে হাহুতাশ করি। অনলাইনে ট্রল করি। কিন্তু মাঝেমধ্যে মনে হয়, যে দেশের উঁচুস্তর থেকে একেবারে তৃনমূল পর্যন্ত সবখানেই এত দুর্নীতিগ্রস্থ, অসাধু লোকের ছড়াছড়ি, সে দেশে সামান্য যে ছিটেফোঁটা হলেও উন্নয়ন হয়, সেটিই আসলে আশাব্যঞ্জক। অবশ্য এ দেশে সৎ হয়েও বা লাভ কী? যারা সৎ হবেন তাদের হয় ওএসডি করা হবে, নাহয় কোনো দোষ ধরিয়ে বসিয়ে দেয়া হবে চিরতরে। দেশ ক্রমশ চলে যাবে নষ্টদের দখলে। যাবে কী, এখনই চলে গিয়েছে প্রায় পুরোটাই। যৎসামান্য যা বাকি আছে তাও কয়দিন থাকে, সেটিই দেখার বিষয় এখন।
এবং এভাবেই উন্নয়নের মহাসড়কে চলছে বাংলাদেশ!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন