এমনিতেই এদেশে বইসংক্রান্ত ব্যবসায় মন্দা থাকে সারাবছরই। যা বিক্রি হয় তারও সিংহভাগ পাঠ্যবই ও চাকরীর বই। সৃজনশীল বা সুকুমার বৃত্তিগুলোর জন্যে যে বই, সে বইয়ের বাজার সারাবছরই চলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। সেই বাজারের ওপর "করোনা" যেন এসেছে মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে।

"করোনাভাইরাস" এর প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকে সারা পৃথিবীতেই মোটামুটি একটা আমূল পরিবর্তন এসেছে। যেই পৃথিবী আগে প্রচার করতো মানুষে মানুষে কাছে আসার গুরুত্ব,  সেই পৃথিবীতেই এখন দূরত্বের হোলসেল প্রমোশন।  প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে মানসিক নৈকট্য রয়ে গিয়েছে আজও, কিন্তু কমে গিয়েছে শারিরীক উপস্থিতির সুযোগ এবং আবেদনও। মহামারী চিরস্থায়ীভাবে হয়তো থাকবে না, কিন্তু চলে গেলেও দাগ রয়ে যাবে অনেকখানেই। শিল্প, সাহিত্য, ব্যবসা, জীবন ও জীবিকা সবখানেই। গুটিবসন্ত শরীর থেকে চলে গেলেও দাগ থেকে যায় অনেকদিন, এও অনেকটা সেরকম।

এরকম পরিবর্তনের ভীড়ে খোঁজ নিচ্ছিলাম বই ও বই সংক্রান্ত ব্যবসার। এমনিতেই এদেশে বইসংক্রান্ত ব্যবসায় মন্দা থাকে সারাবছরই। যা বিক্রি হয় তারও সিংহভাগ পাঠ্যবই ও চাকরীর বই। সৃজনশীল বা সুকুমার বৃত্তিগুলোর জন্যে যে বই, সে বইয়ের বাজার সারাবছরই চলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। সেই বাজারের ওপর 'করোনা' যেন এসেছে মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে। 

এ বছরের মার্চ মাসের ৮ তারিখে প্রথম করোনা রোগী সনাক্ত হয় এ দেশে। এরপর খুব তাড়াতাড়িই সবকিছু বন্ধ করে দেয়া হয়। ফেব্রুয়ারির বইমেলার পর যে বইগুলো অবিক্রিত থেকে যেতো সে বইগুলো পাঠানো হতো বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। মার্চ থেকে শুরু হয়ে এই সরবরাহ চলতো জুলাই পর্যন্ত। প্রকাশকদের বইয়ের বিপনন এভাবেই মেলার পরেও থাকতো বজায়।  কিন্তু মার্চে শুরু হওয়া 'লকডাউন' সেই সরবরাহের কাজকে পুরোপুরিই বন্ধ করে দিয়েছে। এ কারণে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ধারণা করতে পারেন? না পারারই কথা অবশ্য। প্রায় চারশো কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে এই লকডাউন ও আনুষঙ্গিক কারণে বই-বাজারের স্থবিরতার কারণে! এবং এই ক্ষতির প্রকোপ থেকে প্রকাশক যেমন রেহাই পাননি, তেমনি রেহাই পাননি বই বিক্রেতা, পরিবহনকারী কিংবা ছাপাখানার মালিক, কর্মচারী, বই বাঁধাইকর্মী কেউই। 

সেদিন গেলাম নীলক্ষেতে। না গেলেই ভালো হতো। কেন? সেটাই বলছি। সেখানে যে মহাশ্মশানের শূন্যতা দেখলাম, সেটি কাম্য ছিলোনা মোটেও। ইতস্তত বইয়ের দুয়েকটা দোকান খোলা। বই কেনার মানুষজন নেই মোটেও। টানা ফুটপাত, যেখানে থাকতো থরেবিথরে বই, সেই ফুটপাত এখন গড়ের মাঠ! মুখব্যাদান করে তাকিয়ে আছে ইট-সিমেন্টের দীর্ঘ সারি, যেন কিছু আগেই এখানে বলি দেয়া হয়েছে অজস্র মানুষকে। এখন যেখানে নেমে এসেছে নিঃসীম নৈশব্দ। বই-ব্যবসার সাথে বহুকাল ধরে যুক্ত মানুষজনও চলে যাচ্ছেন ভিন্ন পেশার খোঁজে। সে তালিকায় জ্বলজ্বলে নাম-  গোলাম মোস্তফা, যিনি 'মোস্তফা চাচা' নামে পরিচিত ছিলেন নীলক্ষেতের বইপ্রেমীদের কাছে, তিনিও বিগত কয়েক দশকের বই বিক্রির দোকানটা বিক্রি করে চলে যাচ্ছেন অন্যত্র। এমনই ভাঙ্গনের সুর এখানে। 

এরকম অবস্থা বাংলাবাজারেও। যে বাংলাবাজার প্রতিমুহুর্তেই ছিলো দারুন গতিশীল, পাঠক-প্রকাশক-বই- কাগজের ঘ্রাণ এর মিশেলে যেখানে সবসময়ই ছিলো এক হট্টগোল... সেই জায়গায় এখন আগের সেই ভীড়টিই আর নেই। দোকান হয়তো কিছু কিছু খোলা, কিন্তু তা খোলার জন্যেই খোলা। বই কেনার জন্যে কেউ আসে না৷ নতুন বই ছাপানোর কোনো তাগিদ দেখা যায় না। আগের প্রকাশিত বইগুলোর ওপরে ধুলো জমে নিয়মিত বিরতিতে... এভাবেই চলছে।  গত ৩১ মে থেকে সবকিছু স্বাভাবিক হবার পরেও কোনো রকমফেরই ঘটেনি এখনো। ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসছে যেন সবকিছুই।

বাংলাবাজারেও ছাপা হচ্ছেনা আর নতুন বই

সৃজনশীল বইয়ের কথা নাহয় বাদই দিলাম।পাঠ্যবইয়েরও কোনো ভবিষ্যৎ নেই যেন। ক্লাস বন্ধ, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলো হচ্ছে না, পাবলিক পরীক্ষাগুলোর ভবিষ্যতও অনিশ্চিত। কে বই কিনবে? কেনই বা কিনবে? কীভাবেই বা কিনবে?  এই ত্রিশঙ্কু অবস্থা থেকে পাঠ্যবইয়ের বাজারেও মন্দার সুর৷ এই মহামারি শুরুর পর সেভাবে বিক্রি হয়নি কোনো বই-ই। যেসব বই ছাপা হয়েছিলো, সেগুলোও আবহাওয়া, জলবায়ু, প্রকৃতিগত কারণে প্রতিদিনই হচ্ছে একটু একটু করে নষ্ট। 

প্রকাশনা শিল্পের ব্যবসা কমে গেছে প্রায় ৯০ শতাংশ। ইতোমধ্যেই যে বিনিয়োগ করে রেখেছিলেন প্রকাশকরা, আশঙ্কা দেখা গিয়েছে সেগুলো গচ্চা যাওয়ারও। বাংলাদেশে জ্ঞান ও সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশক সমিতির সবমিলিয়ে ২০৫টি  সদস্যভুক্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে,  কাগজ-কলমের হিসেবের বাইরে রয়েছে আরো কিছু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। সংখ্যার হিসেবে একশো ছাড়িবে যাবে তালিকা। দেশে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সদস্য অর্থাৎ প্রকাশক ও বিক্রেতা রয়েছেন প্রায় ১২ হাজারের মতন। এরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বই-ব্যবসার মন্দার কারণে৷ তাছাড়া প্রেস, বাঁধাইখানা সবখানে যে মানুষগুলো নিরন্তর কাজ করছে বই প্রকাশ, বিপনন ও বিতরনের কাজে সবাই পড়েছেন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে।

নীলক্ষেতের বইয়ের দোকানগুলোতেও এখন ভাঙ্গনের সুর

মার্চের শুরুর দিকে অনেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এবং অনেক লেখকও ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনলাইনে বই প্রকাশ করেছিলেন পাঠকদের জন্যে। কিন্তু সে উদ্যোগও হালে পানি পায়নি অতটা। এ দেশ ই-বুক, ডিজিটাল বুক ফরম্যাট নিয়ে বিজনেস করার জন্যে যে এতটা সক্ষম হয়ে ওঠেনি এখনো, সেটা টের পাওয়া গিয়েছে হাড়েহাড়েই। প্রকাশকেরাও তাই অনলাইনে বই বিক্রির উদ্যোগ থেকে গুটিয়ে নিয়েছেন হাত। সুতরাং সামাজিক দূরত্বের সময়ে অনলাইনে যে বইয়ের প্রচার ও প্রসার হবে, সেটি এদেশের প্রেক্ষাপটে ততটা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেনি আজও। 

তাছাড়া মানুষ যে এখন বই কিনবে সে আশা করাটাও আসলে এক রকমের ধৃষ্টতা। এই স্থবির সময়ের প্রেক্ষাপটে কারোরই মানসিক অবস্থা বই পড়ার মতন অতটা ভালো নয়। তাছাড়া যেখানে দৈনন্দিন নূন্যতম চাহিদা অর্থাৎ খাবার, বাসস্থান, চিকিৎসার স্থায়িত্ব নিয়ে মানুষ হিমশিম খাচ্ছে,  অর্থনৈতিক ভিত্তি নিয়েই মানুষ দোটানায়, ঝুঁকিতে পড়ে গিয়েছে, সেখানে বই আসলে মানুষের প্রায়োরিটি লিস্টের কোন প্রকোষ্ঠে পড়ে রয়েছে, সেটা নিয়ে না ভাবাই ভালো হয়তো।

যদিও বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির পক্ষ থেকে সমিতির সদস্য ও এর সঙ্গে জড়িত কর্মীদের প্রায় দুই লাখ পরিবারের জন্য স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি তিনটি স্তরে অনুদান ও প্রণোদনার কথা বলা হয়েছে। সেই অনুদান ও প্রণোদনা কতটুকু কী সাহায্য করবে সমিতির সদস্যের, সেই প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। তবে এই সমিতি ছাড়াও আরো অজস্র তৃণমূল মানুষ যারা বই-ব্যবসার সাথে জড়িত, যাদের রুটিরুজির সংস্থান আসে দুই মলাটের সওদা থেকেই... তাদের জন্যে কারো কোনো উদ্যোগ আছে কী না। জানা নেই কারো।

সোশ্যাল মিডিয়া, হরেকরকম স্ট্রিমিং সাইট এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য জিনিসের ভীড়ে এমনিতেই বই 'একঘরে' হয়ে পড়ছে দিনকে দিন। সে বিবেচনায় এভাবে যদি চলতে থাকে, তাহলে আর কতদিন পাঠক নতুন বইয়ের গভীর ঘ্রাণ প্রাণভরে নিতে পারবে, সে নিয়ে একটা শঙ্কা রয়েই যায়। ক্রমশ শুকিয়ে যাওয়া এই খাতটি একসময়ে খটখটে মরুভূমি যায় কী না, সেটাও বিশাল এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন। 

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা