এই মুভি মাফিয়ারা এমন একটা ন্যারেটিভ তৈরি করতে চাচ্ছে যে কোন স্বজনপ্রীতি ছাড়া চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে আসাটা একটা রেয়ার ঘটনা। প্রকৃতপক্ষে, ন্যারেটিভটা এমন হওয়া উচিত ছিল যে মেধাবী সেই কাজ করবে, দক্ষতার ভিত্তিতে অগ্রাধিকার পাবে অভিনেতা ও শিল্পীরা।

বলিউডের একটা অমূলক ও স্টুপিড সংস্কৃতি হলো ইনসাইডার-আউটসাইডার সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির মূলনীতি হচ্ছে যাদের বাবা-দাদা-চাচা-মামা বলিউডের সাথে জড়িত ছিল তারা 'ইনসাইডার' আর যারা স্ট্রাগল করে, নেপোটিজমের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে, বাধা অতিক্রম করে ইন্ডাস্ট্রিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে তারা 'আউটসাইডার'।

কিন্তু, ইনসাইডার ও আউটসাইডার বলতে আসলে কি বোঝায়? ইনসাইডার মানে হলো প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপের ভেতরকার লোকজন মানে যারা সরাসরি জড়িত এবং যাদের ঐ ব্যাপারে এক্সপার্টিজ আছে আর আউটসাইডার মানে হলো বাইরের লোকজন। সোজা কথায় যারা কোন শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত তারাই ইনসাইডার অার যারা ঐ শিল্পের থেকে বিযুক্ত তারা আউটসাইডার।

সে হিসাবে, শচীন টেন্ডুলকার, ভিরাট কোহলি বা সৌরভ গাঙ্গুলি ভারতের ক্রিকেট জগতের ইনসাইডার। কিন্তু, এখন যদি বলা হয় যে না, শচীন, সৌরভ এরা ইনসাইডার না, তারা আউটসাইডার আর শুধুই সুনীল গাভাস্কারের পুত্র রোহান গাভাস্কার হলো ইনসাইডার তাহলে নিশ্চয়ই কথাটা হাস্যকর শোনানো উচিত।

বাস্তবতা হলো ভারতের ক্রিকেটের কথা উঠলে গাঙ্গুলি, টেন্ডুলকার বা ভিরাট কোহলিদের কথা যতবার বলা হয় রোহান গাভাস্কারের নাম তার ১০০ ভাগের ১ ভাগও বলা হয় না। সেও যেহেতু ক্রিকেট খেলতো এক সময় সেও ইনসাইডার কিন্তু অবশ্য অত ভালো কোন খেলুড়ে সে না। তাই, শুধু তাকেই ইনসাইডার বলা যাবে আর শচীন, কপিল দেব, রোহিত শর্মাদের ইনসাইডার বলা যাবে না বরং আউটসাইডার বলতে হবে ব্যাপারটা ঠিক সুবিধার ঠেকে না।

সুশান্তের মৃত্যুর পর, নেপোটিজমের বিরুদ্ধে উঠেছে প্রশ্নের ঝড়! 

আউটসাইডার কেন বলতে হবে তাদের? তাহলে কি ক্রিকেট জগতের লোক না তারা? যে ঐ ইকো সিস্টেমের সাথে সরাসরি জড়িত সেই তো ইনসাইডার। তো এই যে কথায় কথায় আয়ুশমান খুরানা, রাজকুমার রাও, রাধিকা আপ্তে বা কঙ্গনা রানাওয়াতকে আউটসাইডার বলা হয় সেটা আসলে কতটা যথাযথ? তারা কি বলিউড ইন্ডাস্ট্রির অংশ না তবে?

আমরা সবাই এই মর্মে একমত হবো যে অনন্যা পাণ্ডে, টাইগার শ্রফ, সুরাজ পাঞ্চোলির চাইতে হাজার গুণ বেশি মেধাবী আয়ুশমান খুরানা, রাজ কুমার রাও, তাপসী পান্নু বা জিম সার্বরা এবং ইন্ডাস্ট্রির প্রত্যক্ষ অংশ তারা, তারা বলিউডের উল্লেখযোগ্য তারকা। এরপরেও কেন তারা আউটসাইডার?

কারন, তাদের কেউ ছিলো না আগে থেকে বলিউডে তাই? কারন, তারা নিজের পরিশ্রম ও মেধার জোরে জায়গা করে নিয়েছে তাই? কারন তারা কোন দেন-দরবার, তদবির, সুপারিশ ছাড়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাই? যদি তাই হয়ে থাকে তবে তো আউটসাউডার হওয়াই ভালো। তাহলে এই 'আউটসাইডার' শব্দটাকে নেতিবাচক, Derogatory টার্ম হিসেবে করন জোহরের মত মুভি মাফিয়ারা কেন ব্যবহার করছে এবং কেন 'ইনসাইডার' শব্দটাকে গ্লোরিফাই করছে?

কারন, তারা বলিউডে একটা স্যুডো সামন্তবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাই। তারা এটা এস্টাবলিশ করতে চায় যে মুচির ছেলে মুচি হবে, ডাক্তারের ছেলে ডাক্তার, অভিনেতার ছেলে অভিনেতা। এটাকে অামি ভারতের/বলিউডের Neo Casteism এর একটা সংস্করণ বলবো। এই নব্য-বর্ণপ্রথার মূল Cornerstone এথনিক আইডেন্টিটি না বরং আর্থ-সামাজিক ও পেশাগত আইডেন্টিটি এখানের মূল Catalyst.

এই মুভি মাফিয়ারা এমন একটা ন্যারেটিভ তৈরি করতে চাচ্ছে যে কোন স্বজনপ্রীতি ছাড়া চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে আসাটা একটা রেয়ার ঘটনা, এটা খুবই Unusual ব্যাপার এবং মামা-চাচা ধরে অভিনেতা হওয়াটাই স্বাভাবিক। প্রকৃতপক্ষে, ন্যারেটিভটা এমন হওয়া উচিত ছিল যে মেধাবী সেই কাজ করবে, দক্ষতার ভিত্তিতে অগ্রাধিকার পাবে অভিনেতা ও শিল্পীরা।

যার যোগ্যতা থাকবে তারই বলিউডে এন্ট্রি হবে। সেই হিসাবে আয়ুশমান খুরানা, রাধিকা আপ্তে কিংবা পঙ্কজ ত্রিপাঠির বলিউডে আসাটা একটা ভীষণই স্বাভাবিক ঘটনা, না আসাটাই অবাককর হতো বরং। অন্যদিকে, অনন্যা পাণ্ডে, টাইগার শ্রফ, সুরাজ পাঞ্চোলি, সোনম কাপুরদের অভিনয়ে আসাটাই একটা চরম আশ্চর্যজনক বিষয়।

বলিউডে নেপোটিজমের মাফিয়া বলা হয় হয় করন জোহরকে 

তো যখন রাজকুমার রাও বা রিচা চাড্ডাকে দেখে মুভি মাফিয়ারা হায় হায় করে এই বলে যে 'এই, তোমার কেউ ছিলো না বলিউডে, এরপরেও তুমি কি করে এলে' তখন প্রতিবাদ হওয়া উচিত এবং বরঞ্চ অমেধাবী স্টার কিডদের বলা উচিত 'আয় হায়, তোমার তো কোন মেধা ছিলো না, এরপরে তুমি কি করে আসলে বলিউডে'। বলিউডে আসার প্রি কার্সর হিসেবে যে তদবির ও স্বজনপ্রীতিকে মেইনস্ট্রিম/স্বাভাবিক বানিয়ে ফেলা হচ্ছে এবং মেধাকে, যোগ্যতাকে একটা সেকেন্ডারি ফ্যাক্টর হিসেবে ধরা হচ্ছে এটা ঠিক না।

এখন কেউ যদি নরেন্দ্র মোদীকে রাজনীতির আউটসাইডার বলে আর জাস্টিন ট্রুডো এবং রাহুল গান্ধিকে ইনসাইডার বলে তবে এর থেকে উজবুকীয় কথা আর কি হতে পারে? জাস্টিন ট্রুডো এবং রাহুল গান্ধী অবশ্যই ইনসাইডার যেহেতু তারা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত তার মানে তো এই না যে নরেন্দ্র মোদী রাজনীতির আউটসাইডার।

মজার ব্যাপার হলো, বলিউডকে ভারতের বাইরে যারা চেনে তারা শাহরুখ খানের জন্য বলিউডকে চেনে। করন জোহরের সমীকরণ মতে শাহরুখও আউটসাইডার। অমিতাভ বচ্চনের বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন, চলচ্চিত্রের লোক ছিলেন না। তার মানে অমিতাভও আউটসাইডার। কিন্তু, অভিষেক আবার ইনসাইডার।

কিন্তু, যাদের অবদানের কারনে একটা ইন্ডাস্ট্রি এই পর্যায়ে পৌঁছায় তাদেরকে কি করে আউটসাইডার বলে এটা মাথায় আসে না। তারা তো শুধু ইন্ডাস্ট্রির অংশই না বরং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তারা। তাদের চেয়ে বড় কোন ইনসাইডার হতে পারে? কিন্তু না যেহেতু তাদের পূর্বপুরুষ ভিন্ন পেশার তাই তাদেরকে 'আউটসাইডার' তকমা দেয়া হচ্ছে। নিতান্তই হাস্যকর! এই ব্যাপারগুলো নিয়ে ভারতে কথা হওয়া উচিত।

এতগুলো কথা বলার কারন, সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যু। জানি না সে বলিউডে উপেক্ষার, অবহেলার শিকার হবার জন্যও এই পথ বেছে নিয়েছে কি না। তবে, সে যে অবহেলিত হয়েছে এটা তারই মুখ থেকে শোনা গেছে এবং এটা একটা কারন হলেও হতে পারে। সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মত একজন অসাধারণ পারদর্শী ও স্বীয় দ্যুতিতে উজ্জ্বল অভিনেতাকে নাকি বিভিন্ন গেট টুগেদারে দাওয়াত করা হতো না সে 'আউটসাইডার' বলে। এটা তো 'শুদ্রের হাতের অন্ন খেলে জাত যাবে'-এর নয়া সংস্করণ। সুশান্ত সিংহ রাজপুত চলচিত্র জগতের উদীয়মান তারকা ও উল্লেখযোগ্য অংশ হয়েও কি করে আউটসাইডার হয়? তারা কি জানে না ইনসাইডার-আউটসাইডারের সংজ্ঞা?

আরও পড়ুন- 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা