এদেশের অজস্র বাবাকে সিনেমার এই দুই বাবার সঙ্গে একটু পরিচয় করিয়ে দিতে ইচ্ছে করে, তাদের দর্শনটা সব বাবার মাথায় ঢুকিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। তাহলে হয়তো এদেশের অনেক সন্তানের বেড়ে ওঠার কালটা আরও অনেকটা সহজ হতো বোধহয়...

এই জীবনে অল্প অল্প করে বেশকিছু সিনেমাই দেখা হয়েছে। তবে নায়ক-নায়িকার প্রথাগত প্রেম ছাপিয়ে বাবার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক মূর্ত হয়ে উঠতে দেখেছি একদম হাতেগোনা অল্প কয়েকটা সিনেমায়। এরমধ্যে একটা হচ্ছে থাপ্পড়। এবছর মুক্তি পাওয়া সিনেমাটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা থেকে শুরু করে প্রশংসা আর কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি, সবই হয়েছে। তবে নারীবাদ, আত্মসম্মানবোধ, থাপ্পড়, ডিভোর্স- সবকিছু ছাপিয়েও একটা জিনিস আলাভাবে দৃষ্টি কেড়েছে এই সিনেমায়, সেটা তাপসী পান্নু আর কুমুদ মিশ্র'র বাবা-মেয়ের সম্পর্কের রসায়নটা। 

ঘরোয়া পার্টির ভরা মজলিশে মেজাজ হারিয়ে তাপসীর পতিদেবতাটি আচমকা তার গায়ে হাত তুললেন, গালে বসিয়ে দিলেন এক থাপ্পড়। ঘরভর্তি লোকজন স্তব্ধ হয়ে গেল, শ্মশানের নিস্তব্ধতা নেমে এলো সেখানে। সেই রাতে কেউ যখন তাপসীকে ভালো-মন্দ একটা কথাও জিজ্ঞেস করতে আসেনি, তখন আমরা দেখলাম, বাড়িতে বসে মেয়ের অপমানের কথা ভাবতে গিয়ে রিল লাইফ ফাদার কুমুদ মিশ্র'র গায়ে জ্বর উঠে যাচ্ছে। এর আগে পর্যন্ত এই বাবা আলাদা কিছু ছিলেন না, মেয়ের নাচ দেখে তিনি মুগ্ধ হচ্ছেন, হাততালি দিচ্ছেন, মেয়ে থাপ্পড় হজম করার পরে তিনি মাথা নিচু করে ফেলছেন- ট্রেডিশনাল একটা ব্যপার, এরকমটাই সবসময় ঘটে। 

ধারাটা ভাঙলো খানিক বাদে। সেই থাপ্পড়ের জল গড়ালো অনেকদূর, স্বামীকে ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তাপসী। আমাদের সমাজে এমনটা ঘটলে কি হয়, বলুন তো? পরিবার, বন্ধু, প্রতিবেশী- সবাই এসে মেয়েটাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, যা হয়েছে হয়েছে, ভুলে যাও, ক্ষমা করে দাও, নতুন করে সব শুরু করো। কুমুদ মিশ্র সেই গৎবাঁধা পথে হাঁটেননি, মেয়ের স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে তিনি দৃঢ়ভাবে বলেছেন, যা হয়েছে তা তো বুঝলাম, কিন্ত কেন হয়েছে- সেটা জানা জরুরী না? এই প্রশ্নের জবাব কারো জানা ছিল না, আমার ধারণা, সিনেমার পরিচালক অনুভব সিনহাও জানতেন না এমন প্রশ্নের কি জবাব দেয়া হবে। সেখানেই আমি বুঝতে পারলাম, এই বাবা আর দশজনের মতো নন, ইনি আলাদা, অনেকটা আলাদা। 

থাপ্পড় সিনেমায় তাপসী পান্নু ও কুমুদ মিশ্র

সিনেমায় তাপসীর যে চরিত্রটা, তার কাছে নাচ ছিল ধ্যানজ্ঞান। সংসারী হবে বলে নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়েছিল মেয়েটা, বাবা তখন তাকে কিছু বলেননি। তাপসী যখন দশজনের সামনে থাপ্পড় হজম করলো, তখনও তিনি পুরো ব্যপারটা মেয়ের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। তাপসী যখন আত্মসম্মানটাকে সবচেয়ে দামী ভেবে ডিভোর্স নেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন সবাই তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেল, সেই প্র‍তিকূল সময়টাতে কুমুদ মিশ্র চুপ করে থাকতে পারলেন না আর, এসে দাঁড়ালেন মেয়ের পাশে। এই যে কঠিন সময়ে আগলে রাখা, পাশে দাঁড়ানো, পুরো দুনিয়ার বিরুদ্ধে গিয়ে মেয়েকে সাহস যোগানো, তার মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেয়া- এটাই তো একজন বাবার কাছে সন্তানের চাওয়া। বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, ক'জন বাবা এমনটা পারেন? 

কুমুদ মিশ্র'র চরিত্রটাতে নারীবাদের ছোঁয়া খুঁজে পেতে পারেন অনেকেই। আমার কাছে সেরকম কিছু মনে হয়নি কোথাও। তার নিজের ছেলে যখন হবু স্ত্রী'র সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে, তিনি তাকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেছেন, এমনই বাবা তিনি। মেয়েকে তিনি একবারও বলেননি ডিভোর্স দিতে, আবার তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতেও বলেননি। শুধু তাপসী যখন বাবাকে জিজ্ঞেস করেছে, বাবা আমি ভুল করছি না তো?- তখন কুমুদ মিশ্র মনে করিয়ে দিয়েছেন তাকে, 'দেখ বেটা, সবসময় ঠিক কাজের ফলাফল যে ভালো কিছু হবে, এরকম কোন কথা নেই। ঠিক কাজটা করেও সুখের সন্ধান পাওয়া যায় না, তাই বলে বেঠিক কাজ তো করা যাবে না।' এই বাক্যটার অন্তর্নিহিত অর্থটা অনেকেই ধরতে পারবে না। আর যারা পারবে, তারা বুঝবে, জীবনের ছোট-বড় সিদ্ধান্ত গ্রহনের ভার সন্তানের ওপর ছেড়ে দেয়াটা কেন জরুরী। 

বলিউডের আরেকজন বাবা আছেন, যিনি আমাকে মুগ্ধ করেছেন। বরেলি কি বরফি সিনেমার পঙ্কজ ত্রিপাঠি। বরেলি শহরের উড়নচন্ডি টাইপের এক তরুণী কৃতি শ্যানন, 'মেয়ে' ইমেজটা তার সঙ্গে যায় না মোটেও। বরং সমবয়সী ছেলেদের চেয়েও ডানপিটে সে। অশ্বিনী আইয়ার তিওয়ারী এই সিনেমায় বাবা-মেয়ের সম্পর্কটাকে খুব যত্ন করে পোর্ট্রে করেছেন। রক্তের সম্পর্কের চেয়েও দুজনের মধ্যে আত্মার সম্পর্কটা বেশি ঘনিষ্ঠ বলে মনে হয়েছে গোটা সিনেমায়। 

ছোট্ট একটা দৃশ্য মাথায় গেঁথে আছে এই সিনেমার। মায়ের বকুনি খেয়ে ছাদে বাবার সঙ্গে সিগারেট টানতে টানতে কৃতি প্রশ্ন করেছিলেন, মেয়ে হওয়াটা এত কঠিন কেন? কেন সবাই আমার দিকে আঙুল তোলে, অথচ একই কাজ একটা ছেলে করলে কেন তাকে কেউ কিছু বলে না? খানিকটা মন খারাপ করেই পঙ্কজ ত্রিপাঠি বলেছিলেন, সমাজ রে মা, সব সমাজের দোষ। তোর দোষ নেই। 

বরেলি কি বরফি-তে কৃতি শ্যানন ও পঙ্কজ ত্রিপাঠী

এই সিনেমায় পঙ্কজকে কোথাও প্রোট্যাগনিস্ট হিসেবে দেখানো হয়নি, সমাজ-সংসারের বিরুদ্ধে চলতে শুরু করেননি তিনি। কিন্ত আমরা দেখেছি, নিজের মেয়েকে স্বাধীন একটা জীবন দেয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন তিনি। কৃতির মায়ের চরিত্রটাকে আপনি সমাজ হিসেবে কল্পনা করুন, মেয়েকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখতে চান তিনি, চান 'মেয়ে' হিসেবেই সবার সামনে উপস্থাপন করতে, নইলে লোকে মন্দ বলবে। পঙ্কজ নিজের মেয়ে আর স্ত্রীর মধ্যে একটা সেতুবন্ধন হয়ে দাঁড়িয়েছেন, সমাজ আর মেয়ের মাঝখানে অবস্থান নিয়েছেন ঢাল হিসেবে। একদিকে মেয়েকে স্বাধীনতা দিয়েছেন, অন্যদিকে স্ত্রীর কাছে কৈফিয়ৎ দিচ্ছেন, তাকে মানানোর চেষ্টা করছেন। এই যে নিজের পায়ের তলা থেকে মাটি নিয়ে জড়ো করে মেয়ের পায়ের নিচের জমিটা শক্ত করার চেষ্টা- এটাই একজন বাবার কাজ। অথচ আমাদের বাবারা বরং পাখি হয়ে উড়তে চাওয়া মেয়ের ডানা কেটে দেয়ার কাজটাই খুব পারদর্শীতার সঙ্গে করেন। 

বন্ধুর বাইকে চড়ে কৃতি যখন বাবার দোকানে এসেছে, তখন তিনি মেয়েকে বলে দিচ্ছেন, বাইকের দুই পাশে দুই পা দিয়ে যাতে সে বসে। ছোট্ট একটা ব্যপার, নজরে পড়ার মতো কিছুও না হয়তো, কিন্ত বরেলি নামের ছোট্ট এক শহরের এক মিষ্টির দোকানদার ওই ছোট্ট একটা সংলাপের মাধ্যমেই জানান দিলেন, ছেলে-মেয়ের যে ভ্রান্ত পার্থক্যগুলো সমাজ তৈরী করে রেখেছে, সেগুলো আসলে খুবই ঠুনকো, ভেঙে ফেলার জন্য খুব বেশি শক্তির দরকার হয় না। 

পজেসিভ ওয়েতে না হেঁটেও যে বাবার রোল চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়, সেটাই দেখিয়েছেন কুমুদ মিশ্র এবং পঙ্কজ ত্রিপাঠি। অনুভব সিনহা এবং অশ্বিনী আইয়ার তিওয়ারীকে ধন্যবাদ, সেলুলয়েডে এমন দুজন চমৎকার বাবাকে তারা উপহার দিয়েছেন, ভীষণ যত্ন করে এই দুটো চরিত্রকে তৈরী করেছেন, স্ক্রিনটাইম দিয়েছেন। আমার খুব ইচ্ছে করে, এদেশের অজস্র বাবাকে এই দুই বাবার সঙ্গে একটু পরিচয় করিয়ে দিতে, তাদের দর্শনগুলো সব বাবার মাথায় ঢুকিয়ে দিতে। তাহলে হয়তো এদেশের অজস্র সন্তানের বেড়ে ওঠার কালটা আরও অনেক সহজ হতো...  


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা