বোকো হারাম: পৃথিবীর বুকে টিকে থাকা একদল পিশাচের গল্প!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
জঙ্গী সংগঠন বলতে আইএস আর আল কায়েদাকে বোঝে সবাই, অথচ হিংস্রতার দিক থেকে বোকো হারাম এদের গুরুতুল্য! গত দশ বছরে বোকো হারামের হাতে শুধু নাইজেরিয়াতেই মারা গেছে ত্রিশ হাজার মানুষ, দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে আরো ত্রিশ লাখ...
যতই দিন গড়াচ্ছে, আমরা মানু্ষ হিসেবে তত বেশি 'অসহিষ্ণু' হয়ে যাচ্ছি। প্রতিদিনই নানা শাখা, দল, উপদলে বিভক্ত হয়ে আক্রমণ করছি একে অন্যকে। কেউ লিখছি, কেউ গান গাইছি আবার কেউ অস্ত্র দিয়ে মানুষ খুন করছি। হিসেব করলে দেখা যাবে, শেষ দলের মানুষই ক্রমশ বাড়ছে এই চ্যাপ্টা পৃথিবীতে৷ 'ধর্ম' আজকাল স্রষ্টার হাতে নেই আর। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আল কায়েদা, আইসিস, আরএসএস, তালেবান... কট্টরপন্থী হিংস্র সাম্প্রদায়িক দলগুলোই ধর্ম রক্ষার মহান ক্রুসেডে নেমেছে যেন। মানুষ মরছে, স্রেফ কচুকাটার মত শেষ হয়ে যাচ্ছে। জঙ্গিগোষ্ঠীরা নেমেছে ধ্বংসের আজব খেলায়। ক্রমশই তারা হয়ে উঠছে হিংস্র দানবের চেয়েও হিংস্র। আবার এই দানবদের মধ্যেও বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হবে এক গোষ্ঠীর নাম, যাদের কাজ নৃশংসতার মাত্রায় ক্রমশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে কাছেদূরের সবাইকে। নাইজেরিয়ার জঙ্গিগোষ্ঠী তারা। নাম- বোকো হারাম। যাদের হিংস্রতার মাত্রার ধারেকাছেও নেই কেউ এখন আর।
নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বোকো হারামের জন্ম ২০০২ সালের দিকে। সে ইতিহাসে পরে আসবো। বোকো হারামের আরো দুইটি নাম থাকলেও বহুল প্রচলিত হিসেবে টিকে আছে 'বোকো হারাম' নামটিই। এই শব্দকে বিশ্লেষণ করলে দুটি অংশ পাওয়া যায়- বোকো আর হারাম। হাউসা ভাষায় 'বোকো' অর্থ নকল। এই 'বোকো' শব্দ সাধারণত পশ্চিমা শিক্ষার অসারতা প্রকাশ করতে ব্যবহার করেন জঙ্গিরা। এবং আরবি 'হারাম' মানে নিষিদ্ধ । 'বোকো হারাম' শব্দের মানে দাঁড়ায়, পশ্চিমা শিক্ষা নিষিদ্ধ। এই জঙ্গি-সংগঠনের শুরু থেকেই তারা পশ্চিমা শিক্ষা-সংস্কৃতি, অনুশাসন, নিয়মনীতির ঘোর বিরোধী৷ সেটারই প্রতিফলন আমরা দেখি তাদের কর্মকাণ্ডে।
শরীয়াহ আইন প্রবর্তনের ইচ্ছে থেকেই এই গোষ্ঠীর শুরুর দিকের কাজকর্ম চলছিলো। কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে তারা ক্রমশ পরিণত হওয়া শুরু করে জঙ্গিগোষ্ঠীতে। তারা এতটাই কট্টরপন্থী হয়ে উঠতে শুরু করে, ইসলাম ধর্মের অন্যান্য শাখার এবং মতাদর্শের মানুষদেরও তারা 'বিধর্মী' বলে ডাকা শুরু করে। তাদের লক্ষ্য ছিলো একটাই- যেভাবে হোক, নাইজেরিয়াকে একটি ইসলামি-রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সময়ের ফেরে নাইজেরিয়া ক্রমশ পাশ্চাত্য ধ্যানধারণার দিকে মনোযোগী হচ্ছিলো, যেটা ছিলো 'বোকো হারাম' এর কপালে ভাঁজের বিশেষ কারণ। তাছাড়া নাইজেরিয়ার বিত্তশালী মানুষদের অধিকাংশই ছিলেন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী, যে বিষয়টিও 'বোকো হারাম' এর জঙ্গিগোষ্ঠী মেনে নিতে পারে নি। অসন্তোষের চাপান-উতোরের মধ্য দিয়েই আস্তে আস্তে তারা পরিণত হতে থাকেন দেশের মধ্যে আরেক দেশে।
ইতিহাসের দিকে যদি তাকাই তাহলে বোকো হারামের উত্থানের পেছনে আরো কিছু প্রভাবকের ভূমিকা পাবো আমরা। নাইজেরিয়া তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে। লালমুখো শাসকেরা নাইজেরিয়ায় এসে মুসলিম ধর্মাবলম্বী অনেককে তখন খ্রিস্টানধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন। যে ঘটনা স্থানীয় মুসলানদের মনে চিরস্তায়ী এক অসন্তোষ তৈরী করে। পরবর্তীতে আফ্রিকা স্বাধীন হয় ব্রিটিশদের শাসনযন্ত্রের নিষ্পেষণ থেকে। কিন্তু নাইজেরিয়ায় তবু শান্তি ফেরে না৷ দূর্বল রাজনৈতিক শাসনের কারণে নাইজেরিয়াতে বেশ ক'বারই এসেছে মিলিটারির রাজত্ব। যে কয়বারই সামরিক শক্তি এসেছে ক্ষমতায়, সে কয়বারেই দেশ দেখেছে ধ্বংসযজ্ঞের তুমুল তোড়জোড়। তাছাড়াও গৃহযুদ্ধ, রক্তাক্ত দাঙ্গা, সহিংসতা হয়েছে। হাজারে হাজারে মানুষ মারা গিয়েছে। সামাজিক বিশৃঙখলা আর দারিদ্র্যে নাইজেরিয়া ক্রমশই ধুঁকেছে। আর এসব অরাজকতা আর অস্থিরতার মাঝখান দিয়ে 'বোকো হারাম' নামের একটি জঙ্গিগোষ্ঠী করেছে আত্মপ্রকাশ।
মোহাম্মদ ইউসুফ ২০০২ সালের দিকে নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মাইদুগুরিতে সর্বপ্রথম 'বোকো হারাম' এর কার্যক্রম শুরু করেন। প্রথমদিকে এটি ছিলো অনেকটা মাদরাসার মত একটি বিষয়৷ যেখানে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হতো। নাইজেরিয়ার দরিদ্র পরিবারের মুসলমান ছেলেমেয়েরা অথবা নাইজেরিয়ার আশেপাশের বিভিন্ন জায়গা থেকেও ছেলেমেয়ে এখানে এসে পড়াশোনা করতে পারতো। ইউসুফ এখানে ছেলেমেয়েদের ধর্মীয় পড়াশোনা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদেরকে 'জিহাদি' বানানোরও প্রশিক্ষণ দিতেন৷ শুধুমাত্র শিশুকিশোর না, নাইজেরিয়ার বেকার-হতাশাগ্রস্ত যুবসমাজকেও ইউসুফ 'বোকো হারাম' এর সদস্য বানানো শুরু করেন ক্রমশ। আস্তে আস্তে বোকো হারামের কলেবর বাড়তে শুরু করে। প্রথম দিকে শান্তিপূর্ণভাবে তারা তাদের কাজকর্ম করতেন৷ সরকারকে ঘাঁটাতেন না। সরকারও তাদের ঘাঁটাতো না। দুয়েকটা বিক্ষিপ্ত সহিংসতা যে এই সংগঠনের ছিলো না, তা না। তবে সেগুলো নাইজেরিয়ার দেশব্যাপী সংঘর্ষের তুলনায় খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিলো না। এভাবেই কেটে যায় সাত বছর।
বোকো হারামের স্বরূপ উন্মোচিত হয় ২০০৯ সালের দিকে এসে। নাইজেরিয়ান সরকার বোকো হারামের কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতার করে, যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলো- এই জঙ্গিসংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা মোহম্মদ ইউসুফ। এছাড়াও বোকো হারামের বেশ কিছু জিনিসপত্র জব্দ করা হয়। ইউসুফকে আটকের পর থেকেই বোকো হারামের হিংস্রতার স্বরূপ উন্মোচনের পালা শুরু হয়। মাইদুগুড়িতে দাঙ্গা হয়, পুলিশ ও মিলিটারির সাথে সংঘর্ষ হয়, সাতশো পুলিশকে খুন করে বোকো হারাম। পুলিশ স্টেশন, কারাগার, সরকারি অফিস, স্কুল, গীর্জা ধ্বংস করে তারা। এরইমধ্যে জেল থেকে পালানোর সময়ে ইউসুফ মারা যান৷ ইউসুফের স্থলাভিষিক্ত হন তার সেকেন্ড ইন কমান্ড- আবুবকর শেকাউ। নবনিযুক্ত আবুবকরের নেতৃত্বে পরবর্তী বছরে গিয়ে বোকো হারাম নাইজেরিয়ার বাউচি অঞ্চলের জেলখানা ভেঙ্গে তাদের জঙ্গিগোষ্ঠীর একশো পাঁচ জন সদস্য সহ সাতশোরও বেশি অপরাধীকে বের করে আনে। মিসাইল, কামান, রকেট লঞ্চার দিয়ে হত্যাযজ্ঞও অব্যাহত থাকে তাদের। বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে দফায় দফায় বোমা বিস্ফোরনও করে তারা এ বছরে।
সামনের সময়ে এসে বোকো হারাম হয়ে যায় আরো হিংস্র। ২০১১ সালে তারা প্রথমবারের মতন আন্তজার্তিক কোনো স্থাপনায় হামলা করে। ইউনাইটেড ন্যাশনস এর হেডকোয়ার্টারে আক্রমণ করে তারা, শতাধিক মানুষ আক্রান্ত হয়, চব্বিশ জনের মত মানুষ প্রয়াত হয়৷ পুলিশ হেডকোয়ার্টার, ধর্মীয় নেতা, রাজনৈতিক কর্মী, সাধারণ মানুষ... কেউই তাদের প্রকোপ থেকে রক্ষা পায় না। 'সুইসাইড বোম্বিং'কেও বেশ কার্যকরভাবে প্রয়োগ করে বোকো হারামের সদস্যেরা। মানুষ মরতে থাকে খোলামকুচির মতন। সামনের বছরগুলোতে এসেও তাদের তাণ্ডবলীলা তো কমেইনা বরং নাইজেরিয়া ছাড়াও তারা শাখা বিস্তার করতে থাকে পৃথিবীর আরো বেশ কিছু দেশে। নাইজার, চাদ ও ক্যামেরনে তারা দফায় দফায় হামলা চালায়। এসব দেশে 'বোকো হারাম' এর শাখাও স্থাপন করে তারা। তাদের আক্রমণের তালিকায় যুক্ত হয় মসজিদের নামও।
মানুষকে কিডন্যাপ করে মুক্তিপণ আদায় সহ নানারকম অপরাধই তারা করতো। এছাড়াও ২০১৭ সালে ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়- নাইজেরিয়ার ছোট ছোট শিশুদের 'সুইসাইড বোম্বিং' এ বেশি ব্যবহার করতো বোকো হারাম। এ ঘটনায় আলোড়ন হয় সারা পৃথিবীতে। ২০১৮ সালে তারা ২৭৬ জন কিশোরীকে অপহরণ করে নিয়ে আসে তাদের ডেরায়। বছরব্যাপী তাদের উপর যৌন নির্যাতন সহ নানা রকম নির্যাতন চালিয়ে কয়েকজনকে ছেড়ে দেয় তারা। কয়েকজন পালিয়ে যায়। বাকিদের আর খোঁজ পাওয়া যায় না। এ ঘটনা পরবর্তীতে প্রকাশ পাওয়ার পরে পুরো বিশ্ব শিউরে ওঠে ঘটনার তীব্রতায়।
সময়ের ব্যবধানে বোকো হারামের ধ্বংসযজ্ঞ বহাল তবিয়তেই চলছে। ২০২০ এ এখন পর্যন্ত তারা বারো-তেরোটি ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে নাইজেরিয়ায়। মেরেছে হাজার হাজার মানুষকে। গত কয়েকদিন আগেই যেমন বোর্নো অঞ্চলের মাইদুগুড়ির জাবারমারির এক কৃষিজমিতে কাজ করা অবস্থায় তেতাল্লিশ জন কৃষককে ধরে এক জায়গায় জড়ো করার পরে শিরচ্ছেদ করে হত্যা করেছে বোকো হারামের সদ্যসেরা। এছাড়া তারা সেখানে আহতও করেছে বেশ কিছু কৃষককে।
জাতিসংঘের এক রিপোর্টে জানা যায়, ২০০৯ সাল থেকে শুরু করে বোকো হারামের এক যুগের তান্ডবলীলায় শুধু নাইজেরিয়াতেই মারা গিয়েছে ত্রিশ হাজার মানুষ। বোকো হারামের সহিংসতায় দেশ ছেড়েছে আরো ত্রিশ লাখ মানুষ। নাইজেরিয়ার সত্তর লাখ মানুষ বেঁচে আছে জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানের 'নো ম্যানস' ল্যান্ড' এ। এগুলো কাগজে-কলমে পরিসংখ্যানের হিসেব। হিসেবের বাইরে কত যে ক্ষয়ক্ষতি, কত মৃত্যু সে হিসেব জানা নেই কারো। অথচ বোকো হারামের জন্ম নাইজেরিয়াতে ইসলামি শরীয়াহ শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্যে। এভাবেই ধর্মকে বাঁচাচ্ছে তারা। মানুষকে মেরে। নিজেদেরকে মেরে।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন