দুই দিন আগেই ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে পিটিয়ে-পুড়িয়ে মারা হলো একজনকে। বাংলাদেশে ধর্ম অবমাননার জন্যে কোনো আইন আছে? যদি থাকে, তাহলে মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে কেন? সেই আইনের শাস্তিই বা কেমন?

ফ্রান্সের বিরুদ্ধে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইসলামপন্থী মানুষজন সরব আন্দোলন করছে। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম না। জোরদার আন্দোলন চলছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও উঠে এসেছে বাংলাদেশের বিক্ষোভের খবর। এবং ঠিক তখনই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সেই পুরোনো প্রশ্ন- বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ধর্মীয় অবমাননার ক্ষেত্রে কোন কোন বিধিনিষেধ রয়েছে? কী করলে ধর্মীয় অবমাননা হয়? সেক্ষেত্রে শাস্তির বিধানও বা কি? যদিও বাংলাদেশে ধর্মীয় অবমাননার ক্ষেত্রে মানুষজন আইনের গণ্ডিতে না ঢুকে নিজেদের মত করেই শাস্তিদানে পটু, সে হিসেবে এ লেখা হয়তো উলুবনে মুক্তা ছড়ানো। তাও অরণ্যে রোদন করার ব্যর্থ চেষ্টা এখানকার শব্দেরা। আগ্রহী গুটিকয়েক পাঠকও যদি ধর্ম অবমাননা সংক্রান্ত আইন নিয়ে জানে, খারাপ তো নেই কিছু।

প্রথম কথা, বাংলাদেশে বিশেষ কোনো ধর্মের অবমাননার জন্যে বিশেষ আইনের কথা বলা হয়নি। অর্থাৎ পৃথিবীর অনেক দেশেই যেমন দেখি, ইসলাম ধর্ম অবমাননা করলে কঠোর শাস্তির বিধান আছে, সেরকমটা বাংলাদেশে নেই। বাংলাদেশে সব ধর্ম অবমাননার বিষয়ে  বিধিনিষেধ ও শাস্তির ধারা একই। তবে এটাও সে সাথে বলে রাখা ভালো, বিশেষজ্ঞদের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ বেশি এসেছে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছ থেকেই। আইনজীবীরা বলেন- বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী  ধর্মানুভূতি আঘাত করার অভিযোগে মামলা করার বা বিচার প্রক্রিয়ায় শাস্তির উদাহরণ বেশি নেই। তবে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ তুলে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ বা পিটিয়ে হত্যার ঘটনা অনেকবার ঘটেছে। কিছুদিন আগেই যেমন লালমনিরহাটে এক ব্যক্তিকে।পিটিয়ে এরপর আগুনে পুড়িয়ে মারা হলো। 

যাই হোক, আইনের প্রসঙ্গে আসি। ব্রিটিশদের সময়ে ১৮৬০ সালে প্রণীত দণ্ডবিধি, যেটি স্বাধীনতার পরে সামান্য পরিবর্তন করে বাংলাদেশে গ্রহন করা হয়, সেই দণ্ডবিধি (বাংলা সিনেমার শেষ দৃশ্যে আপনারা বহুবার বিচারকের মুখে 'বাংলাদেশ দণ্ডবিধি' শুনেছেন। 'বাংলাদেশ দণ্ডবিধি' বলে কোনো বস্তু নেই। এটি শুধু এবং শুধুই 'দণ্ডবিধি') এ ধর্মীয় অবমাননার জন্যে সুনির্দিষ্ট কিছু ধারা রয়েছে। দণ্ডবিধির ধারা ২৯৫ থেকে ২৯৮ এ ধর্মীয় অবমাননা ও  সংশ্লিষ্ট বিধানগুলো রয়েছে। 

দণ্ডবিধির ২৯৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ধর্মীয় স্থান বা সেই স্থানের কোনো জিনিসপত্রের ক্ষতি করলে বা অসম্মান করলে, তা ধর্মীয় অবমাননা হিসেবে গন্য হবে। এবং এরকম অবমাননার ক্ষেত্রে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

পরবর্তীতে একটি সংশোধনী আসে ১৯২৭ সালে। যেখানে ২৯৫(ক) ধারায় বলা হয়- মৌখিক বা লিখিতভাবে বা অন্য কোনোভাবে কোনো নাগরিকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হলে, তা, ধর্মীয় অবমাননা বলে গন্য হবে। এরকম অপরাধের ক্ষেত্রেও দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। 

দণ্ডবিধির ২৯৬ নম্বর ধারায় বলা আছে,  আইনের বিধিনিষেধ মেনে আয়োজিত ধর্মীয় কোন সমাবেশ বা অনুষ্ঠানে কেউ বাধা বা বিশৃঙ্খলা করতে চাইলে সেটি ধর্মীয় অবমাননা হিসেবে গন্য হবে। সেক্ষেত্রে অপরাধীর শাস্তি হিসেবে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। 

দণ্ডবিধির ২৯৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তির ধর্মানুভূতিতে আঘাত করার উদ্দেশ্যে ধর্মীয় কোন স্থানে অনধিকার প্রবেশ করা, মৃতদেহের অসম্মান অথবা শেষকৃত্যানুষ্ঠানে সমস্যা তৈরি করা হলে সেটাও ধর্মীয় অবমাননার অন্তর্ভুক্ত বলে ধরে নেয়া হবে। এরকম অপরাধের ক্ষেত্রেও এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

দণ্ডবিধির ২৯৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ধর্মানুভূতিতে আঘাত করার উদ্দেশ্যে কোন বাক্য বা শব্দ বিকৃত করা, এমন অঙ্গভঙ্গি করা যাতে তার ধর্মবিশ্বাস আহত হতে পারে, এমন আচরণ করা হলে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। সেই সঙ্গে জরিমানারও বিধানও রয়েছে।

এছাড়াও ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট- ২০১৮ অনুযায়ী সেখানেও ধর্মীয় অবমাননার বিষয়টি এসেছে। এই আইনের ধারা-২৮ অনুযায়ী প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইচ্ছাকৃতভাবে যদি কেউ অন্যের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করে, তবে তা' ধর্মীয় অবমাননা' বলে বিবেচিত হবে। এসব ক্ষেত্রে অপরাধীর অনূর্ধ্ব সাত বছরের কারাদণ্ড এবং অনূর্ধ্ব ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে। তবে কেউ যদি দ্বিতীয়বার একই ধরণের অপরাধ করেন, তাহলে তার অনূর্ধ্ব ১০ বছরের কারাদণ্ড, ২০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে। 

কঠোর বিধিনিষেধের মাধ্যমে এভাবেই ধর্মীয় অবমাননার প্রতিকার বিধানের কথা বলা হয়েছে বাংলাদেশে। তবে অনেক ধর্মভিত্তিক সংগঠনের দাবী, ব্লাসফেমি আইনের মতন করে বাংলাদেশে কঠোরভাবে ধর্মীয় অবমাননার বিরুদ্ধে আইন প্রনয়ন করা উচিত। যদিও সরকারের ব্লাসফেমি আইনের আদলে কোনো আইন করার আপাতত কোনো পরিকল্পনা নেই। সরকার দণ্ডবিধি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমেই ধর্মীয় অবমাননা দমনের চেষ্টা করতেই বেশি মনোযোগী। 

বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন বিদ্যমান আইনে খুশি নন মোটেও! 

বাংলাদেশে ধর্মীয় অবমাননার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট আইন থাকলেও খুব কম মানুষই এই বিষয়ে আইনের আশ্রয় নিয়েছেন। আইনের বদলে নিজেরাই আইনকে তুলে নিয়েছেন নিজের হাতে৷ আইন ও বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ও 'ধর্মীয় অনুভূতি' অত্যন্ত সংবেদনশীল হওয়ার কারণেই অনেক মানুষ এই নির্দিষ্ট বিষয়ে আইনের উপর থেকে আস্থা হারাচ্ছেন, এমনটাও মতামত অনেকের। তবে এভাবে আস্থাহীনতার খেসারত যে কত মারাত্মক হতে পারে সামনে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। 

তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতা- বিবিসি বাংলা

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা