ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে কালো সাফল্যের রঙ। কারণ, ব্যবসায়ীরা তাদের ক্ষতিগুলোর নির্দেশিকা রাখেন লাল কালি দিয়ে, আর লাভের হিসাবগুলো রাখেন কালো কালি দিয়ে। ১৮৬৯ সালে ঘটে এক ইতিহাস...

ব্ল্যাক ফ্রাইডে সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে ১৮৬৯ সালে। সেই সময় আমেরিকা জুড়ে প্রবল অর্থনৈতিক মন্দা চলছিল। ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছিলেন। বেচা বিক্রির অবস্থা তথৈবচ। তাই, ব্যবসায়ীরা ভাবলেন একটি বিশেষ দিন দেখে তারা নতুন কিছু পণ্য মারাত্মক মূল্য হ্রাস করে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করবেন। বিক্রি ভাল হলে যদি কেটে যায় অর্থনৈতিক মন্দা এই আশায়। এমনিতে কালো মানেই শোকের রঙ।

কিন্তু, ব্যবসায়ীক দৃষ্টিভঙ্গিতে কালো সাফল্যের রঙ। কারণ, ব্যবসায়ীরা তাদের ক্ষতিগুলোর নির্দেশিকা রাখেন লাল কালি দিয়ে, আর লাভের হিসাবগুলো রাখেন কালো কালি দিয়ে।

সেই হিসেবে কালো ব্যবসায়ীদের জন্য আকাংখিত রঙ। সেইসময় মন্দা কাটিয়ে লাল থেকে কালোতে ফিরতে ব্যবসায়ীরা তাই এমন একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তবে, এই ছাড় দিয়ে খুব বেশি লাভ হয় না ব্যবসায়ীদের। কিন্তু এই ঘটনা বিশেষ দিনকে টার্গেট করে যে বিক্রি বাড়ানো যায় কৌশলে সেই ধারণার বীজ বপন করেছে মূলত। তাহলে ব্ল্যাক ফ্রাইডে নামকরণ হলো কী করে?

১৯৬৬ সালের কথা। আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ার রাজ্য পুলিশ ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’র পরের দিনকে ব্ল্যাক ফ্রাইডে হিসেবে অভিহিত করে। কারণ, এইদিন আমেরিকায় বছরের সবচেয়ে উত্তেজনাকর ফুটবল খেলা অনুষ্ঠিত হয় ফিলাডেলফিয়ায়। এই খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আমেরিকার সেনাবাহিনী।

এই খেলাকে কেন্দ্র করে শহরে ভীষণ তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। রাস্তাঘাটে তৈরি হয় বড়সড় ট্রাফিক জ্যাম। এই দিনকে কেন্দ্র করে শহরে অনেক মানুষের জমায়েত হয়। ফুটপাতে লোকের ভীড় সামলাতে হিমশিম খেয়ে যায় পুলিশ। টাউন সার্ভিসের বাসও এতো মানুষকে পরিবহন সেবা দিতে গিয়ে ফ্যাকড়ায় পড়ে এদিন৷ ফলে পুলিশ এই দিনটিকে ব্ল্যাক ফ্রাইডে বলে অভিহিত করে।

ব্যবসায়ীরা খেয়াল করেছে মানুষের এই বিপুল সমাগম। তারা দিনটাকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়িক কৌশল সাজায়। এই দিনটাকে সামনে রেখে আমেরিকার রিটেইল স্টোরগুলো এবং আসবাবপত্রের দোকানগুলো বিভিন্ন ছাড় ও পুরস্কারের ঘোষণা দিয়ে থাকে। এছাড়া ছোট-বড় বিভিন্ন কোম্পানি দু’-তিন সপ্তাহ আগে থেকেই ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেল উপলক্ষে বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারণা চালাতে থাকে। টিভি-রেডিও এবং প্রতিদিনের সংবাদপত্রে প্রচার চালানোর পাশাপাশি প্রত্যেক বাড়ির মেইলবক্সে রঙিন সেল পেপার দেয় তারা। কে কী আইটেম নিয়ে বাজারে আসছে অথবা কে কত বেশি আকর্ষণীয় মূল্যে পণ্য ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেবে, এটা নিয়ে কোম্পানিগুলোর মধ্যে শুরু হয় প্রতিযোগিতা।

কেউ কেউ আশি, নব্বুই শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিয়ে থাকে! ফলে, ক্রেতারা বছরের এই সময়টাতে এই দিনটার জন্য বিশেষভাবে অপেক্ষা করে থাকে। তারা কয়েকদিন আগে থেকেই কেনাকাটার প্রস্তুতি নেয়। অন্য দিন যেটার দাম ১০০ টাকা সেটা এইদিন অর্ধেকেরও কম দামে কিনার সম্ভাবনা তৈরি হয়। ফলে, এই দিনে দোকানীরা খুব সকালে দোকান খুলে পসরা সাজিয়ে বসেন। ক্রেতারা সকাল থেকে লাইন ধরে পণ্য কেনার জন্যে।

এইদিনকে নিয়ে এতোটাই হাইপ তৈরি হয় আমেরিকায় যে কখনো কখনো দেখা যায়, আগের রাত থেকেই লোকজন লাইন ধরে অপেক্ষায় বসে থাকে। কতটা উত্তেজনার তৈরি হয় এই দিনকে ঘিরে তার একটা উদাহরণ দেয়া হয়, ২০০৭ সালের একটা ঘটনায়৷ সেইবছর ব্ল্যাক ফ্রাইডের সেলে ওয়ালমার্টে ঢোকার জন্য আগের রাত ৯টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়েছিল মানুষ। ভোর ৫টায় দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে সবাই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়তে থাকে ভেতরে।

তাদের ধাক্কায় ৩২ বছর বয়সী এক লোক মাটিতে পড়ে পদপিষ্ট হয়ে শেষ পর্যন্ত মারা যায়। এই ঘটনা ঘটে নিউইয়র্কে। কারো কারো মতে, যেহেতু মধ্যরাত থেকে ব্ল্যাক ফ্রাইডের কেনাকাটার তোড়জোড় শুরু হয় মধ্যরাতের অন্ধকার থাকতে থাকতে, তাই এইদিনটিকে ব্ল্যাক ফ্রাইডে বলা হয়।

সাধারণত প্রতিবছর নভেম্বর মাসের শেষ শুক্রবার ব্ল্যাক ফ্রাইডে দিবস পালিত হয়৷ এই দিনে এতটাই বেশি পরিমাণ বিক্রি হয় যে, আমেরিকার অর্থনীতি একদিনে একলাফে বেড়ে যায় বহুগুণ। কোনো কোনো দোকানী সারাবছর যা বিক্রি করেন, শুধু ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেল দিয়েই একদিনে তার চেয়ে বেশি বিক্রি করেন। আমেরিকায় আজকাল খৃষ্টানদের বড়দিনের কেনাকাটা শুরু হয় এই ব্ল্যাক ফ্রাইডে থেকেই। বিক্রেতারাও ভাল বেচাকেনা করে বড়দিন উৎসব পালনের প্রস্তুতি নেন।

প্রতিবছর নভেম্বর মাসের শেষ শুক্রবার ব্ল্যাক ফ্রাইডে দিবস পালিত হয়

আজকের দিনে অনলাইনেও এই শব্দটি বেশ জোরেশোরেই শুনা যায়। আমেরিকা থেকে ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেল ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপ এশিয়াতেও। আর এখনকার দিনে অনলাইন শপগুলোও বিশেষ ছাড় দেয় শুধু এই দিনকে উপলক্ষ্য করে। অনলাইনে ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেল নেতৃত্ব দিচ্ছে মূলত জায়ান্ট ই-কমার্স ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আমাজন ও আলিবাবা।

আপনি জেনে অবাক হতে পারেন, শুধু ২০১৭ সালে জেফ বেজোসের আমাজন ব্ল্যাক ফ্রাইডেতে এত বেশি পরিমাণ বিক্রি করে যে, জেফ বেজোসের ব্যক্তিগত সম্পদের মূল্য ১০০ বিলিয়ন (১০ হাজার কোটি) ডলার ছাড়িয়ে যায়! ব্ল্যাক ফ্রাইডের ছোঁয়া লেগেছে বাংলাদেশি অনলাইনভিত্তিক শপগুলোতেও। কিন্তু কেউ কেউ শুভঙ্করের ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছেন ক্রেতাদের বিজ্ঞাপনের জালে ফেলে।

ক্রেতাদের কারো কারো অভিযোগ আছে, বাংলাদেশি কিছু কিছু শপ নাকি, দুই টাকার পণ্য দশ টাকা বানিয়ে আশি পার্সেন্ট ছাড় দেয়ার প্রলোভন দেখায়। আবার সেল শুরু হওয়ার এক মিনিটের মধ্যে নাকি প্রোডাক্ট ‘সোল্ড আউট’ হয়ে যায়।

ক্রেতাদের ধারণা, অল্প কয়েক জনের কাছে বিক্রি করেই তারা ইচ্ছা করেই প্রোডাক্ট আনএভেইলেবল করে দেন। অথচ, এই সামান্য সময়ের সেলের জন্য ক্রেতাদের অসংখ্যবার মেইল, মেসেজ আর ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রলুব্ধ করে যান তারা। অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখার অনুরোধ থাকবে অনলাইন শপগুলোর প্রতি৷ কারণ, দীর্ঘসময় টিকে থাকতে এবং আন্তজার্তিক ইকমার্স সাইটের লেবেলে যেতে কাস্টমারদের প্রতি সৎ থাকার বিকল্প নেই।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা