কোনো এক পর্যটক হয়তো ঘুরতে ঘুরতে এক অভিশপ্ত শহরে এসে পৌছেছেন থাকবেন বলে, দেখতে পেতেন শহরের প্রতিটি দরজা খোলা আর প্রতি ঘরেই আর্তনাদ। লাশ পঁচা গন্ধে বিষাক্ত হয়ে উঠতো শহরের বাতাস...

একটি ব্যাকটেরিয়ার কারণে কালরাত্রি নেমে এসেছিলো পৃথিবীজুড়ে। ছাড়খার হয়ে গিয়েছিলো সমগ্র ইউরোপ, বিলীন হয়েছিলো সারা বিশ্বের পাঁচ ভাগের এক ভাগ জনসংখ্যা। সেই ভয়াবহ দুর্যোগের নাম ব্ল্যাক ডেথ, ওরফে কালোমৃত্যু। যার সূত্রপাত ঘটেছিলো নিতান্তই সাধারণ এক গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার হাত ধরে। 

ইয়েরসিনিয়া পেস্টিস (Yersinia pestis)- একটি গ্রাম নেগেটিভ দন্ডাকৃতির কক্কোব্যাসিলাস। আপাতদৃষ্টিতে খুব সাধাসিধে হলেও এই ব্যাকটেরিয়ার কাজকর্ম তাকে দিয়েছে মানব ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ভিলেনের স্বীকৃতি। ই.পেস্টিস ছিলো প্রাণঘাতী প্লেগের বাহক। তিন ধরণের প্লেগ- নিউমোনিক, সেপ্টিসেনিক আর বুবোনিক। এর মাঝে বুবোনিক প্লেগ ছিলো সবচেয়ে ভয়ানক। 

ঘটনার সূত্রপাত চতুর্দশ শতাব্দীতে, মধ্য এশিয়ায়। কিন্তু তখনো সেটা ভয়াবহ রূপ নেয়নি। ক'জন ব্যবসায়ী কাজের উদ্দেশ্যে গাড়ি আর লটবহর নিয়ে রওনা দিলেন ইউরোপে। সিল্ক রোড দিয়ে চলতে চলতে একসময় তারা পৌঁছে গেলেন ক্রিমিয়ায়। রাশিয়া, মিডল ইস্ট আর ইউরোপের সংযোগস্থল এই ক্রিমিয়া। আর এখানেই ছড়ালো মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মহামারী।

চতুর্দশ শতাব্দীতে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মহামারিটি হয়েছিল  

ব্যবসায়ীদের কাফেলায় লুকিয়ে থাকা কালো ইঁদুরের দল ছড়িয়ে পড়লো সারা শহরজুড়ে। সাথে ইঁদুরের শরীরে থাকা অজস্র ছোট ছোট মাছি। কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি কী ঘটতে চলেছে আগামীতে। মাছির শরীরে আশ্রয় নেয়া পেস্টিস ব্যাকটেরিয়ারা দু-চার দিনের মাঝেই ছড়িয়ে পড়লো শহরের আনাচেকানাচে। এর ওর শরীর বেয়ে প্লেগের জীবাণু ছড়াতে লাগলো এক স্থান থেকে আরেক স্থান। 

প্রথম হতভাগা ছিলো হয়তো ক্রিমিয়ারই কোনো এক অধিবাসী। সারা শরীর জুড়ে ফুটে উঠলো তার অজস্র কালো ফোসকা, দুদিনেই প্রবল জ্বরে ছটফটিয়ে মারা গেলো সে। এরপরই শুরু হলো দুর্যোগ, শয়ে শয়ে মারা যেতে লাগলো মানুষ। যেন মানসভ্যতার বিলুপ্তির জন্য স্বয়ং ঈশ্বর যমকে পাঠিয়েছেন। অল্প কমাসের মাঝে সারা ক্রিমিয়া শ্মশান হয়ে গেলো। আর সাথে সাথে প্লেগ এগোতে থাকলো বলকান হয়ে উত্তর পূ্র্বে, প্রুশিয়া কিংবা ফ্রান্স। 

বলা হয়ে থাকে প্লেগের ভয়াবহতা এতো বেশি ছিলো যে একজন শহরবাসী হয়তো কোনো কাজে বেড়িয়েছেন সকালে, সকলকে হাসিখুশি দেখে৷ পরদিন সকালে শহরে ঢুকতেই ঢুকতেই তিনি দেখতেন পুরো শহরে কেউ বেঁচে নেই! মাত্র চব্বিশ ঘন্টার মাঝেই হাজার লোকের একটা শহরকে শুনশান করে দিতো প্লেগ- এমনটাই ছিলো জনশ্রুতি। কোনো এক পর্যটক হয়তো ঘুরতে ঘুরতে এক অভিশপ্ত শহরে এসে পৌছেছেন থাকবেন বলে, দেখতে পেতেন শহরের প্রতিটি দরজা খোলা আর প্রতি ঘরেই আর্তনাদ। লাশ পঁচা গন্ধে বিষাক্ত হয়ে উঠতো শহরের বাতাস৷ মাইলের পর মাইল খালি এই মৃত্যুর মিছিলই  চলতো। 

ইতালি, স্পেন ও দক্ষিণ ফ্রান্স এই তিন অঞ্চলে শতকরা আশিজন মানুষই মৃত্যুর কবলে পড়ে। অর্থাৎ প্রতি চারজনে তিনজন। মিশর আর মধ্যপ্রাচ্য মিলিয়ে মারা যায় পুরো জনসংখ্যার প্রায় চল্লিশ ভাগ। ভাগ্যবান ছিলো ব্রিটিশ আর জার্মানরা। প্রতি পাঁচজনে মারা যায় একজন। ১৩৪৭-৫৩, এই ছয় বছরে প্রায় এক তৃতীয়াংশ ইউরোপিয়ান জনসংখ্যাই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো। পরিমাণে যা ছিলো মতভেদে প্রায় আট থেকে দশ কোটি।

পুরো দুই বিশ্বযুদ্ধ মিলিয়েও এত মানুষ মারা যায়নি। জায়গায় জায়গায় গড়ে উঠেছিলো মাস গ্রেভ, অর্থাৎ গণকবর। লাশ রাখার জায়গা ছিল না। এমনকি কবর দেয়ার জন্য লোক পাওয়া ছিলো মুশকিল, মন্ত্রপাঠের জন্য ছিলো না পাদ্রী। প্লেগ ছাড়েনি গীর্জাকেও। সবটাই হয়েছে সেই ইয়েরসিনিয়া পেসটিসের কারণে।

১৮৯৪ সালে আলেক্সান্ডার ইয়েরসিন যাকে আবিষ্কার করে সব রহস্যের অবসান ঘটান। কিন্তু তখন লোকে ছিলো অজ্ঞ। রোগের কারণ হিসেবে দায়ী করে অনেককে পুড়িয়ে মারা হয়। যার মাঝে ছিলো স্ট্রেসবুর্গে পুড়ে মারা যাওয়া দুই হাজার ইহুদী। চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৪৫ কোটি থেকে হ্রাস পেয়ে ৩৫ কোটিতে চলে আসে। প্রায় দুইশো বছর লেগেছিলো সেই হ্রাসকে কভার দিতে। 

আলেক্সান্ডার ইয়ারসিন 

আমরা সবসময় ভাবি মানবজাতির ধ্বংস হয়তো আসবে মহাবিশ্ব থেকে আসা কোনো গ্রহাণুর আঘাতে, কিংবা এলিয়েনদের হাতে। অথচ খুবই নগণ্য এক জীবাণুই যে আমাদের সবংশে নাশ করে ফেলতে সক্ষম, সেটা আমরা কয়জনে জানি? হয়তো প্লেগেরই আরেক ভাই ভেতরে ভেতরে তৈরী হচ্ছে, হয়তো লুকিয়ে আছে সুযোগের অপেক্ষায়। হয়তোবা। কেউ জানে না। কেউ না।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা