রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় বিরিয়ানি বা তেহারির দোকান দেখে কি কখনো মনে প্রশ্ন জেগেছে, বিরিয়ানি বা তেহারির ডেকচিতে লাল কাপড় মোড়ানো থাকে কেন?
ঢাকার নামকরা পঞ্চায়েত সর্দারের গুণী সন্তান একদিন প্রশ্ন করেছিলেন, আচ্ছা ভাই, ঢাকা শহরের সব পোলাও এর ডেগে লাল কাপড় ব্যবহার করে কেন? অনেকের কাছে বিষয়টা 'আজাইরা' মনে হলেও ভোজনরসিক ঢাকাইয়াদের মনেই এই প্রশ্নটা ঘুরে ফিরে আসে। প্রত্যেকেই তারা তাদের মতো যুক্তি ও মতামত তুলে ধরেন।
লাল কাপড় ও তার ব্যবহার রহস্যটা খুঁজতে আমাদের কম গলদঘর্ম হতে হয়নি। জনে জনে আলোচনা আর তর্ক বিতর্কে লিপ্ত হয়েও সমাধানে পৌছানো সম্ভব হয় না। বয়োজ্যেষ্ঠরা বলেন,বাপ-দাদার আমল থাইক্কা দেইখা আইতাছি! নিচ্চয় কুনু না কুনু কারন তো হইবোই?
হাল আমলের বাবুর্চি ও নব্য বিরিয়ানি ওয়ালাদের কথা তো বাদই দিলাম। আসুন,একটু সহজভাবে চিন্তা করুন তো, বিদেশী অতিথি যখন আসেন তখন তাকে কেন লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়া হয়? নীল বা হলুদ নয় কেন? এই যে এত মাজার, ওরস হচ্ছে সেখানে বাঁশের মাথায় লালসালুর পতাকা ঝুুলে কেন?
বিরিয়ানি, হালিমের ডেগেই বা লাল কাপড় কেন?কালো বা চকমকে মখমল বা দামী কারুকাজ কাপড়ও তো ব্যবহার করা যায়? পান ও পনিরওয়ালারাও এই লালসালু ব্যবহার করে কেন? কারন, মানুষের ভাষার মত রঙেরও কিন্তু ভাষা আছে। আপনার চিন্তায় কিন্তু রঙ প্রভাব রাখে। তাই নয় কি?
তেমনি পৃথিবীর প্রত্যেক দেশেই রঙের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ ও ব্যবহার আছে। পতাকাগুলো দেখুন, বেশীর ভাগ ইসলামী রাষ্টগুলোর পতাকার রঙ সবুজ ও সাদা। কেন? কারণ সবুজকে শান্তি আর সাদাকে স্বচ্ছন্দতা ও শুদ্ধতার প্রতীক মানা হয়। তেমনি লাল রঙের ব্যাবহার একেকদেশে ভিন্ন ভিন্ন। কোন দেশে শৌষ, আক্রমন, বিপদ অর্থে ব্যবহার হয়।
যেমন: যুদ্ধে লাল নিশানা সৈন্যদের নির্দেশনা দান করত শত্রুর মোকাবেলায়। আবার দেখুন ট্রেনের বা রাস্তার সিগনাল। শুধু কি তাই! মাঠে ফুটবল রেফারীও কিন্তু প্রথমে সতর্কতা হিসাবে হলুদ পরে বিপদজনক আচরনের জন্য লাল কার্ড ব্যবহার করেন। এই লালই ইসলামী দৃষ্টিতে ভিন্ন নির্দেশনা দান করে এশিয়ার কিছু মানুষের কাছে। লাল রঙকে বলা হচ্ছে সৌভাগ্য,উষ্ণতার, আনন্দ-উৎসব ও ভালবাসার আবেগের রঙ হিসেবে।
৮০০ বছর আগে এই উপমহাদেশে আরব ও পারস্য থেকে সুফি সাধকরা এসেছিলেন ইসলামের বাণী নিয়ে প্রচারক হয়ে। তারা প্রচার করেন সুফিবাদের তত্ত্ব। সুফিবাদের মূল সুরই হল হৃদয় উৎসর্গ করে আল্লাহকে ভালবাসা। হৃদয়ের রঙ কি?
শুধু তাই নয়, উষ্ণ অভ্যর্থনা প্রকাশের ক্ষেত্রেও হৃদয়ের লাল রঙ সমার্থক হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। মোগল শাসকরা ছিল পারস্য সংস্কৃতির প্রভাবিত। তারা তাদের জীবনে এই ধারা অনুকরন করতেন। সম্রাট হুমায়ুন হলেন এর পথপ্রদর্শক। কারণ তিনি যখন রাজ্য হারিয়ে ইরানে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তখন তাকে পারস্য সম্রাট সেই লালগালিচার উষ্ণ অভ্যর্থনাই দিয়েছিলেন।
খাদ্য পরিবেশনে দরবারি রীতিগুলোতে বিশেষত্ব, রুপালী ডিসের খাবারগুলোর জন্য লাল কাপড় আর ধাতব ও চীনামাটির জন্য সাদা কাপড় দিয়ে ডেকে নিয়ে আসা হতো। যা মোগলরাও তার দরবারে চালু করে। শুধু তাই নয় সম্মানী ব্যক্তি বা আধ্যাত্মিক সাধকদের জন্য ছিল লাল পাগড়ীর ব্যবস্থা।
খাদ্য পরিবেশনে এই প্রথা ও রঙের ব্যবহার নবাবি শহর লাক্ষনৌর নবাবরাও অনুসরণ করতেন। আর কে না জানে ঢাকার নবাবরাও এই খাদ্যরসিকদের উত্তরসূরি। সমাজ জীবনে তাই অভিজাত্য, বনেদী, উষ্ণতা প্রকাশে লাল বা লালসালুর ব্যবহার চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। রঙের শহর ঢাকা ব্যতিক্রম হয় কীভাবে?
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন