শীর্ষ ধনী নয়, মহাকাল যাকে মনে রাখবে মানবতার কাণ্ডারি হিসেবে!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

বাংলাদেশ-ভারত বা পাকিস্তানেই নয়, তুরস্ক বা মিশরের মতো দেশ, যেখানে শিক্ষার হার অনেক বেশি, সেখানেও অজস্র মানুষ বিশ্বাস করে যে, বিল গেটস এসব কাজ করছেন আসলে মানুষকে খ্রিস্টান ধর্মে ডাইভার্ট করার জন্য...
কিছুদিন আগেও তিনি ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। শীর্ষ ধনীর আসনটা এখন অ্যামাজনের জেফ বেজোসের দখলে। তবে দানশীলতার দিক দিয়ে যদি মাপা হয়, তাহলে বিল গেটসের ধারেকাছে ঠাঁই পাবেন না কেউই। অনেক বছর ধরেই গরীব এবং অসহায় মানুষের জন্য অকাতরে দান করে চলেছেন বিল গেট, নিজের এবং স্ত্রীর নামে গড়ে তোলা গেটস-মেলিন্ডা ফাউন্ডেশন থেকে এ পর্যন্ত কয়েক বিলিয়ন ডলার দান করেছেন আফ্রিকা ও এশিয়ার অসহায় মানুষের জন্য, বিল গেটসের সাহায্যের মাধ্যমে লাখ লাখ অভাবী মানুষ সরাসরি উপকৃত হয়েছেন।
করোনার এই ক্রান্তিকালে বিল গেটস ঝাঁপিয়ে পড়েছেন করোনার ভ্যাক্সিন বা টিকার দিকে। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা দল ইতিমধ্যেই ভ্যাক্সিনের টেস্ট ট্রায়ালে সফলতাও পেয়েছে। চীন এবং আমেরিকা সহ সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরাই কাজ করছেন করোনার ভ্যাক্সিন আবিস্কারে, সেপ্টেম্বর নাগাদ সুসংবাদ পাওয়া যাবে হয়তো। কিন্ত এই ভ্যাক্সিনের দাম হবে ত্রিশ থেকে চল্লিশ ডলারের মধ্যে, বাংলাদেশী টাকায় যেটা তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা, বা তারও বেশি।
আফ্রিকা বা এশিয়ার অনেক দেশের কোটি কোটি মানুষের জন্য টাকার এই অংকটা যথেষ্ট বড়। বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক, নিম্নবিত্ত, বা নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেনীর একটা পরিবারের পক্ষে করোনার ভ্যাক্সিনের পেছনে জনপ্রতি চার-পাঁচ হাজার টাকা করে খরচ করাটা অসম্ভব একটা ব্যাপার। এখানেই বিল গেটস ভূমিকা রাখতে চাইছেন, ইতিমধ্যেই তিনি বলেছেন, দরিদ্র্য মানুষ যাতে টিকা পায়, এজন্য তিনি ভ্যাক্সিন আবিস্কারের সঙ্গে সঙ্গে পনেরো কোটি ডলার দান করবেন। টাকার এই অংকটা আরও বাড়বে ধীরে ধীরে।
বিল গেটসের অর্থায়নে প্রায় দশ কোটি ডোজ টিকা প্রস্তুত হবে। ভ্যাক্সিন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোও সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে, তারা শুধু টিকা প্রস্তুতের খরচটাই রাখবে, লাভের অংশটুকু নেয়া হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে তারা। এসব টিকার সবগুলোই পাঠিয়ে দেয়া এশিয়া এবং আফ্রিকার অনুন্নত বা স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে। সেখানকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে এসব ভ্যাক্সিন। এসব টিকা ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট তৈরি করবে এবং মোট ৯১টি স্বল্প ও মধ্য আয়ের দেশে দেওয়া হবে।
করোনাভাইরাসের আগমনের পর থেকে এপর্যন্ত বিল-মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে প্রায় চারশো কোটি ডলার দান করেছেন। এর মধ্যে অন্তত পঞ্চাশ কোটি ডলার ব্যয় করা হয়েছে ভ্যাক্সিন উদ্ভাবন সংক্রান্ত গবেষণার কাজে। শুধু করোনাই নয়, জনস্বাস্থ্য নিয়ে বিল গেটস কাজ করে চলেছেন বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে। গত দুই দশকে টিকা তৈরির ক্ষেত্রে শীর্ষ নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতার ধারেকাছেও নেই কেউ। দীর্ঘদিন ধরে বিল গেটস উদ্বেগ জানিয়ে বলে চলেছেন, ধনী দেশগুলো যদি অতিরিক্ত খরচ করে চিকিৎসা ব্যবস্থা নিজেরা হস্তগত করে, তবে গরিব দেশগুলো চিকিৎসার অভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে। আর তাই স্বাস্থ্যব্যবস্থায় একটা সাম্যবাদ আনার লক্ষ্যে কাজ করছেন তিনি।

বিল গেটসের লক্ষ্য এখন একটাই, যত কম খরচে ভ্যাক্সিন বাজারে আনা যায়। এখন পর্যন্ত ২৮টি সম্ভাব্য টিকা পরীক্ষার পর্যায়ে পৌঁছেছে। একেকটি টিকা একেক রকম এবং ভিন্ন ভিন্ন উপাদানে তৈরি হচ্ছে। মডার্না ও ফাইজারের মতো শীর্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী কয়েকটি টিকা বেশি খরুচে। মডার্নার টিকার দাম হতে পারে ৩২ থেকে ৩৭ মার্কিন ডলার আর ফাইজারের টিকার দাম পড়তে পারে প্রায় ২০ মার্কিন ডলার। এটা শুধু উৎপাদন খরচ, বাজারে আসতে আসতে এই দামটাই দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
কিন্ত বিল গেটসের পরিকল্পনা হচ্ছে তিন ডলারের মধ্যে প্রতিটা টিকা বাজারে আনা। যাতে হতদরিদ্র্য জনগোষ্ঠীর বাইরে যারা মধ্যবিত্ত মানুষজন আছে, তাদেরকে করোনার ভ্যাক্সিনের জন্য ভুগতে না হয়। এজন্য তিনি ভর্তুকি দিতেও রাজী আছেন। শুধু তাই নয়, আমেরিকার সরকারের কাছেও তিনি আহবান জানিয়েছেন, করোনার ভ্যাক্সিনের জাতীয়করণ যাতে করা না হয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনের পিছিয়ে পড়া মানুষদের কথাও যাতে ট্রাম্প প্রশাসন ভাবে।
এত কিছুর পরেও দেখবেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিল গেটসকে নিয়ে অজস্র গুজব প্রচলিত। শুধু বাংলাদেশ-ভারত বা পাকিস্তানের ধর্মান্ধরাই নয়, তুরস্ক বা মিশরের মতো দেশ, যেখানে শিক্ষার হার অনেক বেশি, সেখানেও অজস্র মানুষ বিশ্বাস করে যে, বিল গেটস এসব কাজ করছেন আসলে মানুষকে খ্রিস্টান ধর্মে ডাইভার্ট করার জন্য। করোনার ভ্যাক্সিন ট্যাক্সিন কিছুই না, সব হচ্ছে তার ব্যবসার ধান্ধা। চোখের সামনে এমন কাউকে দেখলে তাকে অবশ্যই নিকটস্থ জাদুঘর বা চিড়িয়াখানায় নিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে বুঝিয়ে দেবেন, এমন মানুষের ঠাঁই চিড়িয়াখানা বা জাদুঘরেই মানায়, টিকেট কেটে যাতে দর্শনার্থীরা তাকে দেখতে যেতে পারে।
পাঁচ বছর আগেই বিল গেটস একবার বিশ্বকে সতর্ক করেছিলেন, প্যান্ডেমিক বা অতিমারী মোকাবেলার কোন প্রস্তুতি।বিশ্ববাসীর নেই। করোনাভাইরাস বিল গেটসের সেই কথাটা প্রমাণ করে দিয়েছে, উন্নত দেশগুলোর চিকিৎসা ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে ক্ষুদ্র এক ভাইরাসের তাণ্ডবে। তবে বিচলিত না হয়ে বিল গেটস যেভাবে নিজের জায়গা থেকে লড়ে যাচ্ছেন, মানুষের জন্য কাজ করছেন, সেটা অবিশ্বাস্য। পৃথিবীর ইতিহাসে নিজের নামটা শুধু সেরা ধনী হিসেবে লেখা থাকুক- এটা বিল গেটস কখনোই চাননি, বরং চেয়েছেন, মানুষের জন্য অবদানের কারণেই বিশ্ববাসী তাকে মনে রাখুক। সেই মিশনে বিল গেটস লেটার মার্ক নিয়ে পাশ করে চলেছেন প্রতিবার, এটা তো প্রমাণীত সত্য...