'বিকিনি কিলার': দ্য আনবিলিভেবল সাইকোপ্যাথ!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
তার নাম শোভরাজ, চার্লস শোভরাজ, দ্যা মোস্ট ইভিল সাইকোপ্যাথ বিকিনি কিলার ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড! তাকে নিয়ে হয়েছে বেশ কিছু ডকুমেন্টারি, লেখা হয়েছে অনেক বই। এমনকি সিনেমাও নির্মিত হয়েছে তাকে উপজীব্য করেই। কিন্তু কী এমন কুখ্যাত কীর্তি করেছে সে?
সাইকোপ্যাথ নিয়ে জন র্যানসনের একটি বিখ্যাত বই আছে। বইটির নাম 'দ্যা সাইকোপ্যাথ টেস্ট (The Psychopath Test)'। সাইকোপ্যাথদের বৈশিষ্ট্য, আচরণ নিয়ে এই বইটিতে কিছু চেকলিস্ট আছে। চেকলিস্ট দেখে বোঝা যায়, কোন কোন বৈশিষ্ট্য একজন সাইকোপ্যাথের মধ্যে থাকতে পারে। -ধূর্ত, ফন্দিবাজ -স্বার্থপর -আবেগপ্রবণ -প্রতারক, বিশ্বাসঘাতক -মুগ্ধতা তৈরিতে পারদর্শী -সহমর্মিতা না থাকা সাইকোপ্যাথরা এমনিতে বেশ আকর্ষণীয়, আপনি তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যেতে পারেন খুব সহজে, হতে পারেন তাদের প্রতি দূর্বল। তারা আবেগ দ্বারা সিদ্ধান্ত নিবে, আপনাকে ব্যবহার করবে চূড়ান্ত স্বার্থপর হয়ে, তারপর ফন্দি করবে, বিশ্বাসঘাতকতা করবে।
অপরাধবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞানে সাইকোপ্যাথদের নিয়ে অনেক গবেষণা, পড়াশোনা করা হয় শুধু তাদের মানসিক অবস্থা বুঝতেই। বেশিরভাগ সিরিয়াল কিলারের মধ্যেই সাইকোপ্যাথ হওয়ার বৈশিষ্ট্যগুলো খুঁজে পাওয়া যায়। তেমনই এক সাইকোপ্যাথ কিলারের গল্প বলবো আজ, যাকে বলা হয় সবচেয়ে বুদ্ধিমান এবং কমপ্লিট সাইকোপ্যাথ সিরিয়াল কিলার। কারণ, সাইকোপ্যাথ হওয়ার সবগুলো বৈশিষ্ট্যই এই লোকের মধ্যে প্রবলভাবে উপস্থিত। তার নাম শোবরাজ, চার্লস শোবরাজ, দ্যা মোস্ট ইভিল সাইকোপ্যাথ বিকিনি কিলার ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড! তাকে নিয়ে হয়েছে বেশ কিছু ডকুমেন্টারি, লেখা হয়েছে অনেক বই। এমনকি সিনেমাও নির্মিত হয়েছে তাকে উপজীব্য করেই। কিন্তু কী এমন কুখ্যাত কীর্তি করেছে সে?
শোভরাজ দেখতে ছিল ভীষণরকম সুদর্শন। তার চেহারায় একটা অন্যরকমের আকর্ষণ ছিল যা অল্পবয়সী তরুণীদের কাছে বেশ মোহনীয় ঠেকতো। ফলে দেখা গেল অল্প বয়সেই শোভরাজের জীবনে বৃষ্টিধারার মতো নারীর প্রেম আসছে। সে প্রেমে পড়ছে, তার প্রেমেও পড়ছে মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে। অনেক ক্ষেত্রেই অল্পবয়সী মেয়েদের প্রথম ভালবাসাগুলো এমন হয় যে, তারা কোনো একটা মোহের বশে ঘোরের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কগুলো করে ফেলে। কিন্তু, ধীরে ধীরে প্রেমের গভীর স্তরে যখন তারা পৌঁছে যায়, তখন তারা এই সম্পর্কের ঘোর থেকে বের হতে পারে না। বরং এই প্রেমবোধ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে সময়ের সাথে সাথে।
শোভরাজের প্রেমে যারা পড়েছে তারাও খুব ভালভাবেই তার প্রেমে মজে যেত, কেউ কেউ হয়ত নিজেকে ভাগ্যবানও ভাবত শোভরাজের মতো সুদর্শন এক যুবক তার প্রেমিক এই ভেবে! ফলে এই প্রেমে মেয়েরা একরকম নিজের অজান্তেই হয়ে যেত শোভরাজের পুতুল। শোভরাজেরও ছিল মুগ্ধ করার অসীম ক্ষমতা, আবেগের ব্যবহারে তার জুড়ি ছিল না। কিন্তু, সে তো প্রেম মজনু হওয়ার জন্য করেনি। তার কাছে বোধহয় প্রেমিকার চেয়ে লাশ দেখাই বেশি আরামদায়ক।
জেনি বলিভার হত্যা
আমেরিকান কন্যা জেনি বলিভার প্রেমে পড়েছিলেন শোভরাজের। সেটা ১৯৭৫ সালের ঘটনা। শোভরাজ তখন বিভিন্ন ক্রাইমের সাথে জড়িয়ে গেছে ইতোমধ্যে। শোভরাজ ভাবলেন মেয়েটাকে নিজের অপরাধজগতে নিয়ে আসতে হবে। হয়ত নিজের প্রতি তার এত অগাধ বিশ্বাস ছিল, সে যা বলবে সেটাই মেয়েটি মেনে নিবে। কিন্তু, শোভরাজকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটি জানালো, সে অন্ধকার জগতে প্রবেশ করতে চায় না। ফলে শোভরাজ বাধ্যই হলেন মেয়েটাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতে, কে চায় নিজের পাপের খবরের স্বাক্ষী রেখে যেতে। জেনির লাশ যখন থাইল্যান্ডে পাওয়া গেল, তখন দেখা গেল লাশের গায়ে কোনো বস্ত্র নেই, শুধু বিকিনি ছাড়া! শোভরাজ জেনিকে হত্যা করার পর সুন্দর করে আবার লাশের উপর ফুল ছড়িয়ে রেখে এসেছিল। জেনিকে হত্যা করা হয়েছিল পানিতে জোর করে মাথা ডুবিয়ে রেখে, যতক্ষণ না মারা যায় ততক্ষণ।
আগুনে পুড়িয়ে হত্যা
শোভরাজ কখন কাকে মারবে সেটা বোঝা কঠিন। এ কারণেই অন্যসব সিরিয়াল কিলারের সাথে তার পার্থক্য আছে। যেখানে বেশিরভাগ সিরিয়াল কিলাররা একই ধারায়, একই স্টাইলে একের পর এক খুন করে, সেখানে শোভরাজ খুন করে বিচিত্র সব স্টাইলে। হাতের কাছে যখন যা থাকে, মাথায় যখন যে বুদ্ধি থাকে সেই মতনই হয় তার কিলিং প্ল্যান। যেমন ১৯৭৫ এই সে এক ইহুদীকে হত্যা করে। এই খুনের ধরণ ছিল বেশ নির্মম। লোকটার নাম ছিল ভিটালি হাকিম।
হাকিম ছিল আন্ডারওয়ার্ল্ডে শোভরাজের প্রতিদ্বন্দ্বী। তাকে প্রথমে 'উড়াধুড়া মাইর' দেয়া হয়, যে মারের কোনো মা বাপ নেই এমন। শোভরাজ যা মেরেছে, সেটাই যথেষ্ট ছিল লোকটার মৃত্যুর জন্য। কিন্তু, শোভরাজ চাইলো ব্যাপারটাতে আরো নির্মমতা আনবে। তাই সে হাকিমের গায়ে পেট্রোল ঢেলে দিল। তারপর দিল আগুণ জ্বালিয়ে! পরের খুনটাও একই বছরে। ভিক্টিম হাকিমেরই বন্ধু এক নারী। হাকিমের মৃত্যুর পর তাকে খুঁজতে গিয়েই সে হুমকি হয়ে যায় শোভরাজের জন্য। এই মেয়েটিকেও যখন খুন করা হয়, পাওয়া যায় পরণে শুধু একটুকরো বিকিনি। মেয়েটিকে এমন ভয়ংকরভাবে গলা টিপে মারা হয় তার গলার হাড্ডি পর্যন্ত স্থানচ্যুত হয়ে সরে যায়। এই খুনের পর চার্লস শোভরাজের নাম 'বিকিনি কিলার' হিসেবে প্রচার পেতে শুরু করে।
পাসপোর্টের জন্য হত্যা
শোভরাজের কোনো পাসপোর্ট ছিল না। সে বিভিন্ন মানুষের পাসপোর্ট ব্যবহার করে ছদ্মজীবন, ফেরারি জীবন পালন করত। এই পাসপোর্ট সে কাজে লাগাতো বিভিন্ন অপরাধের কাজে। তাই তার প্রয়োজন পড়তো পাসপোর্ট ছিনতাই করার। এ কারণেই খেয়াল করলে দেখা যাবে সে যাদের খুন করেছে তারা বেশিরভাগই ট্যুরিস্ট। ভারতে শোভরাজ খুন করেছিল এক ইসরাইলি ছাত্রকে। তার নাম এভনি জ্যাকব। পাসপোর্ট এর জন্যই তাকে খুন করা হয়।
বিষ প্রয়োগ করে হত্যা
শোভরাজের বিভিন্ন স্টাইলে খুনের মধ্যে এটাও একটা ধরণ। এই খুনটিও ১৯৭৫ সালেই ঘটে, ডিসেম্বর মাসে। দুইজন ডাচ তরুণ-তরুণী বের হয়েছিল বিশ্বভ্রমণে। শোভরাজের সাথে তাদের দেখা হয় হংকংয়ে। শোভরাজের ব্যক্তিত্ব তাদের মুগ্ধ করে। ফলে একটা ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় তাদের মধ্যে। শোভরাজ চেয়েছিলেন তাদেরকে তার ক্রাইম রিং এর মধ্যে নিয়ে আসতে। কিন্তু, তারা রাজি হয়নি। যেহেতু রাজি না, সেহেতু তাদের মারতে হবে এটাই চাচ্ছিল শোভরাজ। সে বিষপ্রয়োগ করেন এই দুই ডাচের উপর। তারা যখন অসুস্থ হয়ে যায়, শোভরাজ বলে সে তাদের সুস্থ করতে পারবে। এ কথা বলে তাদের এপার্টমেন্ট থেকে বের করে। তার সাথে ছিল আরেক সহযোগী। এপার্টমেন্ট থেকে বের করে বিষ খেয়ে অসুস্থ হয়ে যাওয়া ডাচ কাপলকে সে শ্বাসরোধ করে মারে এবং এদের শরীরেও আগুণ জ্বালিয়ে দেয়!
শোভরাজ দ্যা সারপেন্ট
শোভরাজের খুনগুলো বেশিরভাগই হয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে। ফলে এসব দেশের আইন অনুযায়ী তার নামে অনেক খুন টুনসহ আরো বিভিন্ন অভিযোগে মামলা হয়েছে। কিন্তু, শোভরাজ জেলের ভাত খাওয়ার জন্য বেছে নেয় ভারতকে। কারণ, ভারতে সে সাজাপ্রাপ্ত হয় চুরির অভিযোগে! ১৯৭৬ সালের কথা সেটা। তার জেল হয় ১২ বছরের। কেন বললাম ভারতকে বেছে নিয়েছিল সেই উত্তর তার জেল থেকে পালিয়ে যাওয়ার গল্পেই আছে।
১৯৮৫ সালের তার সাজা যখন শেষের দিকে, আর অল্প কয়দিন বাকি সেসময় শোভরাজ সিদ্ধান্ত নিলো, জেল থেকে পালাবে। পাগলামি মনে হচ্ছে না? যে কয়দিন পর এমনিই জেল থেকে ছাড়া পাবে সে কেন আবার জেল পালানোর চেষ্টা করছে! যা হোক, শোভরাজ ভারত জেলে তার শাস্তির দশ বছরের দিনে একটা বিশাল পার্টির আয়োজন করলো জেলের প্রহরী আর জেলে থাকা আশেপাশের অন্যান্য আসামীদের জন্যে। একইসময় তার দশ বছর উপলক্ষ্যে তার ক্রাইম পার্টনার সাগরেদরা বিভিন্ন উপহার নিয়ে আসছিল। সাগরেদরা তার জন্য ব্যবস্থা করেছে ঘুমের ট্যাবলেট আর অজ্ঞান করে দেওয়ার ড্রাগস। শোভরাজ যে বিশাল পার্টি দিয়েছে সে সেই পার্টির খাবারে মিশিয়ে দিয়েছিল ঘুমের ঔষধ আর ড্রাগস। এবং তারপর জেল থেকে নিজে এমনভাবে হেঁটে বের হলো যেন কিছুই হয়নি।
দশ বছর জেলে থাকা একজন আসামী এভাবে জেল থেকে পালাচ্ছে, এত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে যেনো এটা কোনো ব্যাপারই না। সে যখন জেল থেকে বের হয়ে রাজস্থানের দিকে রওনা দিয়েছে ততক্ষণে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে জেলের সবাই। কিন্তু, ভারতের পুলিশ তাকে আবার ধরে ফেললো। এবার তাকে আরো দশ বছরের কারাবাস দেয়া হলো জেল পালানোর জন্য। কি আশ্চর্য! শোভরাজ রেগে না গিয়ে বরং খুশিই হলো। কারণ, তার মাস্টারপ্ল্যান খুব ভালভাবে কাজ করেছে।
সে যদি জেল না পালাতো তাহলে এখান থেকে ছাড়া পেলেও তাকে তুলে দেয়া হতো থাইল্যান্ডের পুলিশের হাতে। কারণ, থাইল্যান্ডে তার নামে একাধিক খুনের মামলায় মৃত্যুদণ্ডের রায় আছে! তাই সে জেল পালিয়েছে ইচ্ছা করেই, ধরাও খেয়েছে ইচ্ছা করেই যেনো আবার শাস্তির মেয়াদ বাড়ে!
একারণেই তাকে বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসের অন্যতম চতুর, বুদ্ধিমান সিরিয়াল কিলার বলা হয়। তবে জেল পালানোর কাহিনী এটাই প্রথম নয়। শোভরাজ এর আগেও জেল খেটেছিল, জেল পালিয়েছিলও। একারণেই তাকে 'দ্যা সারপেন্ট' বা বিশ্বাসঘাতক চতুর বলে ডাকা হয়। শোভরাজ কতটি খুন করেছে তার হিসাব নেই। তবে কমপক্ষে ১২ থেকে ২৪ টি খুন করেছে বলে ধারণা করা হয়। বাকিগুলো সম্পর্কে বিশদ জানা যায় না। আর বেশিরভাগ খুনগুলোই সে করেছে সত্তুরের দশকে।
সোভরাজের জন্ম ভিয়েতনামে, ১৯৪৪ সালে। বাবা একজন ইন্ডিয়ান, মা ভিয়েতনামিজ। শৈশবের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো তার কেটেছে ফুটপাতে, রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়িয়ে। কারণ, তার বাবা তাকে আর তার মাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল ওই বয়সেই। ফলে দুর্দশার মধ্যে পড়তে হয় শোভরাজকে। এইসময় তার মা এক ফরাসি ব্যাক্তিকে বিয়ে করে ফ্রান্সে চলে আসেন। শোভরাজ কৈশোর থেকেই জড়িয়ে পড়ে অপরাধজগতে। গাড়ি চুরির জন্য দুইবার ধরা পড়ে প্যারিসে। সেখান থেকেও সে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। আফগানিস্তান, গ্রীসের জেল থেকেও পালিয়ে আসার অভিজ্ঞতা আছে শোভরাজের। পরিস্থিতি বুঝে নিজের রঙ পালটে ফেলে সে। মাঝে মধ্যে ভয়ংকর নির্দয় হয়, মাঝে মধ্যে অভিনয় করে মুগ্ধতার আবেশ তৈরি করে, আবার কখনো কখনো নিজেই ভিক্টিম রোল প্লে করে!
যেমন একবার, তার এপেন্ডিসাইটিস হলো। সে ব্যাথায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। তাকে জেল থেকে বের করে হাসপাতালে নেয়ার পথে পালিয়ে যায় শোভরাজ। এই পুরো সময়টায় এপেন্ডিসাইটিসের ব্যাথায় অজ্ঞান হয়ে থাকার ভান করে অসুখের ভিক্টিম সেজেছেন! এমনই চতুর এক প্রাণী এই শোভরাজ। শোভরাজ কতটা প্রলুব্ধ করার ক্ষমতা রাখে সেটা বোঝা যায় ভারতের তিহার জেলে থাকার সময়কার এক ঘটনায়। সে তার আইনজীবী নারী স্নেহা সেনগাড়কে পটিয়ে ফেলেন। তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করে। এছাড়া জেলে আরো দুই নারীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেছে বলে জানা যায়। এসব কাজে তাকে সাহায্য করেছে জেলের অভ্যন্তরের লোকেরাই, টাকার লোভে।
ব্যাক টু দ্যা প্যারিস
ভারতের তিহার জেল থেকে শোভরাজ ছাড়া পায় ১৯৯৭ সালে। সে ফিরে যায় প্যারিসে। সেখানে সে রাজকীয় জীবন শুরু করে। তার ব্যাপারে ইতিমধ্যে অনেক আগ্রহ তৈরি হয়। কেউ তাকে নিয়ে বই লিখছে, কেউ ডকুমেন্টারি করতে চায়, কেউ আসে সাক্ষাৎকার নিতে। শোভরাজ টাকার বিনিময়ে সাক্ষাৎকার দেয়া শুরু করলো। লোকে টাকা দিয়ে তার খুনের গল্প, জেল জীবনের গল্প শুনতে আসে। কেউ তাকে নিয়ে ছবি করতে চায়। সে টাকার বিনিময়ে তার গল্প বলে। রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে গেল কুখ্যাত শোভরাজ দ্যা চার্লস। সে নিজেও বিষয়টা উপভোগ করছিল!
সে নিজে অবশ্য খুনগুলো করার পরেও নিজের কাছে পরিষ্কার। তার দাবি সে নিজে কখনোই কোনো ভালো মানুষকে খুন করেনি। তার বক্তব্য- “I can justify the murders to myself, I never killed good people.” ২০১৫ সালে বলিউডে চার্লস শোভরাজকে নিয়ে সিনেমা হয়। প্রাওয়াল রামন ‘ম্যায় অউর চার্লস’( Main Aur Charles) নামের এই সিনেমা পরিচালনা করেন। চার্লস শোবরাজের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন অভিনেতা রণদীপ হুদা। এই ছবি করে রনদীপকে অনেক প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল সেসময়। রণদীপ হুদা চার্লস শোভরাজের চরিত্রটিকে সাইলেন্স অব দি ল্যাম্বস সিনেমার হ্যানিবাল লেকটারের সাথে তুলনা করেছিলেন।
রণদীপ শোভরাজ চরিত্রটি নিয়ে বলেছিলেন, "আমি তার মতো অতো ম্যানিপুলেটিভ নই, কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে তাকে আমি অনেক চ্যালেঞ্জিং চরিত্র মনে করি। একটা ছদ্ম ও মিথ্যার জীবন কাটিয়েছেন তিনি। এই চরিত্রের সত্যটা আমি কোথায় বলব? আমি তার মহত্ত্ব ও জাঁকজমকের গল্প শুনেছি, নারীদের পছন্দ করার মতো একজন মানুষ যার কোনো আসল পাসপোর্ট বা পরিচয় ছিল না, তিনি অজ্ঞাত কিন্তু বিখ্যাত ছিলেন। তার বাবা ছিল ইন্ডিয়ান সিন্ধি এবং মা ছিল ভিয়েতনামিজ। তার শৈশব ছিল ঝামেলাপূর্ণ। তিনি একটা ছায়া, একটা রহস্য, একজন মোহাচ্ন্ন করার মত ব্যক্তিত্ব।"
এখন কোথায় আছে শোভরাজ?
শোভরাজের এত বেশি পরিমাণে ইন্টারভিউ ছাপা হয়েছে, তার এত প্রচার হয়েছে রীতিমতো নেতিবাচকভাবে তার নামটা ছড়িয়ে গেছে দেশ থেকে দেশে। তাই কোনো জায়গায় গেলেই কেউ না কেউ তাকে চিনে ফেলতো। সেটাই হয়েছে নেপালে। প্যারিস জীবনের পাঁচ বছর পর একদিন তাকে দেখা গেল নেপালের রাস্তায়। নেপালে গিয়েছিল এক চাইনিজ ডিলারের সাথে হিরোইন ড্রাগসের ডিল করতে। কিন্তু, এক সাংবাদিক তাকে চিনতে পেরে জানিয়ে দিলো পুলিশকে। পুলিশ গ্রেফতার করলো শোভরাজকে। তার বিরুদ্ধে এখানেও হলো খুনের মামলা। এখন শোভরাজ যাবজ্জীবন জেলের শাস্তিতে আছে।
অবশেষে একটা কি সত্যিকারের প্রেম আসলো?
শোভরাজ জনমভর মেয়েদের শুধু মুগ্ধ করেছে, তাদের সাথে সাময়িক সম্পর্ক করেছে, বন্ধুত্ব করেছে, প্রতারণা করে গেছে। প্রেমে তার একটুও আস্থা নেই। বয়স বেড়ে গেলেও শোভরাজকে এখনো সুদর্শনই দেখায়। এখনো সে কথা বললে মুগ্ধ হয়ে শুনে মানুষ। একটা মোহ তৈরি করে নিতে পারে সে খুব সহজেই। নেপালের আদালতে শোভরাজের পক্ষে যিনি আইনজীবি হয়ে লড়ছেন সেই ভদ্রলোকের মেয়ের সাথে শোভরাজের সম্পর্ক হয়ে যায়। মেয়েটির নাম নিহিতা।
নিহিতার বয়স শোভরাজের তিনভাগের একভাগ। মাত্র ২০ বছর বয়সী কন্যা প্রেমে পড়লো ৬৪ বছর বয়সী শোভরাজের। সেই শোভরাজ যার নামে এতগুলো দেশে এত খুনের মামলা, যে জেল খাটা, জেল পালানো দাগী আসামী, যে অপরাধজগতের তুখোড় স্মাগলার! সব জেনেও সেই লোকের প্রেমেই পড়লো নিহিতা। সেটাও প্রায় দশ বারো বছর আগের কথা!
শোভরাজও যেন নিহিতাকে একটু একটু করে ভালবেসে ফেলেছিল। জেলের ভেতরেই তাদের আংটি বদল হয়। কথা আছে, শোভরাজ জেল থেকে মুক্তি পেলে হবে বাকি লাল নীল বাতির আয়োজন।জেলেই তাদের পরিচয় হয়েছিল। শোভরাজ নেপাল জেলের বাসিন্দা। একদিন নিহিতা এসেছিল তার দোভাষী হয়ে। নিহিতার মনের গভীরে শোভরাজের কথাগুলো যেন আটকে যাচ্ছিলো। ওদিকে শোভরাজের চোখ আটকে গেল অনেকদিন পর সুন্দর এক তরুণীকে দেখে! দুইজন দুইজন চোখের ভাষা কি সেদিন বুঝতে পেরেছিল! হতেই পারে। হয়ত একেই বলে, লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। জেলরক্ষীদের কৌতূহলী চাহনি আর ভিজিটিং রুমে প্রবল চেঁচামেচির মধ্যেই তরতরিয়ে জীবন্ত হলো নিহিতা শোভরাজের প্রেম!
শোভরাজ যে এখন জেলে আছে ধারণা করা হয় এটিও তার ইচ্ছাতেই। হয়ত এখানে সে ভালই আছে। কারণ, শোভরাজ যে চাইলে জেল থেকে পালাতে পারে সেটা তো সে দেখিয়েছে এর আগে বেশ কবার। এমনকি তার নিজেরও হয়ত ধারণা সে চাইলেই পারে অদৃশ্য হয়ে যেতে। সে তো নিজেই বলেছে, “Always remember that their desire to keep me locked up is no match to my will to be free”