একাত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারি কী ঘটেছিল উন্মত্ত বিহারীদের আস্তানা মিরপুরে?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
![](https://media.egiyecholo.com/contents/posts/images/2020/2/21/uq6G83SUCIQLynf9MN8x5Ci6MfGkWBB3uAbaPcqk.jpeg)
ঢাকার দুর্গম অঞ্চল মিরপুরে একাত্তরে আসলে কী করেছিল বিহারী অবাঙ্গালীরা?
ঢাকায় মিরপুর ছিল একাত্তরে অবাঙ্গালী বিহারীদের আখড়া। বিশেষত ১০নং সেকশনের পার্শ্ববর্তী ১১ নং সেকশন এবং ১২ নং সেকশনের শতকরা আশি ভাগ বাসিন্দাই ছিল বিহারী। মিরপুর ছিল বিহারীদের দুর্গম দুর্গ। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের নিরংকুশ বিজয়ের পর থেকেই প্রতিশোধ নেবার জন্য বিহারীরা অগ্নিমুর্তি ধারন করে আছে। প্রায় প্রতিদিনই তুচ্ছ অজুহাতে বাঙ্গালীদের, বিশেষ করে জয় বাঙলার কর্মীদের বাড়ি ঘরে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে, অত্যাচার করছে, জবাই করে ফেলে রেখে যাচ্ছে বিহারীরা।
১৯৭১ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সকাল দশটার সময় মিরপুর ১০ নম্বরের আদর্শ স্কুলের সামনে থেকে দশম শ্রেণীর ছাত্রদের নেতৃত্বে মিছিল বের হল। খুব অল্প সময়েই বাঙলা ভাষার দাবিতে শ্লোগানগুলো "জাগো জাগো, বাঙ্গালী জাগো", ''বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর", তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা" "তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ" চিৎকারে বদলে গেল।
গত কদিন ধরেই বাঙ্গালীদের উপর অত্যাচার বহুগুনে বেড়ে গেছে, দিনেদুপুরেই প্রকাশ্যে সবার সামনে বিহারীরা জবাই করে কুপিয়ে ফালা ফালা করে ফেলছে বাঙ্গালীদের। তাই বাঙ্গালীদের ক্ষোভটা অনেক বেশি তাজা। রাস্তার দু'পাশে বিহারীরা জড়ো হচ্ছে, তাদের সাপের মতো ঠাণ্ডা দৃষ্টির সামনেই অসম সাহসে অসংখ্য আবালবৃদ্ধ-বনিতা হাতের কাছে যা পেয়েছে, বাঁশ, ঝাড়ু, লাঠি, গাছের ডাল, তাই নিয়েই গগনবিদারেই চিৎকারে মিছিলে যোগ দিচ্ছে।
ঝড়ের পুর্বাভাস... মিরপুর দুই নম্বর সেকশন ধরে আজকে যেখানে সনি সিনেমাহল, সেদিক দিয়ে মিছিলটা চিড়িয়াখানার দিকে কিছুটা এগোতেই জনতার বাঁধ ভেঙ্গে গেল। বিহারীদের বেশ কিছু ছবি তোলার স্টুডিও, দোকানপাট ছিল এখানে, মিছিল থেকে কেউ একজন চিৎকার করে বললো, "এই যে এইখানে উর্দু সাইনবোর্ড, ভাঙ্গো শালারে ভাঙ্গো।" মুহূর্তের মধ্যে অসংখ্য বাঁশ আর লাঠির আঘাতে সাইনবোর্ডটা দুমড়েমুচড়ে গেল। ক্ষুব্ধ জনতা আগুনের স্ফুলিঙ্গটুকু পেয়ে যেন জ্বলে উঠলো, মুহূর্তের মধ্যে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আশেপাশে যত উর্দু সাইনবোর্ড ছিল, হাতের কাছে যে যা পেল তা নিয়েই সব পিটিয়ে দুমড়েমুচড়ে ফেলতে লাগলো।
উত্তেজিত বাঙ্গালীদের রুদ্ররূপের সামনে প্রথমে পালিয়ে গেলেও একটু পরেই লাঠি-সোটা নিয়ে ফিরে এল ওরা, প্রচণ্ড সংঘর্ষ বেধে গেল। ভীতু বাঙ্গালীরা এইভাবে রুখে দাঁড়াতে পারে, এটা বিহারীদের ভাবনারও বাইরে ছিল। কারণ মিরপুরে বিহারীরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, যত অত্যাচারই করুক না কেন, সংখ্যায় অল্প বাঙ্গালিরা কখনো এভাবে তার প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নেমে আসেনি। একাত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারি মিরপুরে এক অন্য বার্তা নিয়ে এসেছিল। যদিও এর জন্য চরমতম মূল্য দিতে হয়েছিল বাঙ্গালীদের..."
কী ছিল সেই মূল্য? ঢাকার দুর্গম অঞ্চল মিরপুরে একাত্তরে আসলে কী করেছিল বিহারী অবাঙ্গালীরা? "তোমলোগ হামারে ভাই হ্যায়, কুচ নেহি হোগা তুমলোগকি, কুচ নেহি হোনে দুংগা" তোমরা আমাদের ভাই, কিচ্ছু হবে না তোমাদের, দেশের পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, আমরা মিলেমিশে থাকবো, কোন ক্ষতি করব না। তোমরা এইখানেই থাকো"
ঠিক এই কথাগুলোই বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের পর থেকে নিয়মিত বলতো বিহারীরা। মুখে মিস্টি হাসি ঝুলিয়ে অভয় দিত বাঙ্গালিদের, বলতো কিচ্ছু হবে না। পাড়ায় পাড়ায় সভা ডেকে প্রতিদিনের সংঘর্ষগুলোকে বিছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দিয়ে তারা বাঙ্গালিদের আশ্বস্ত করতো। আর গভীর রাতে মিটিং বসিয়ে লিস্ট করতো যে কারা কারা মহল্লা ছেড়ে পালিয়ে যেতে চাইছে। ২৫শে মার্চের গণহত্যার পর মিরপুর থেকে বের হবার সব মুখে চেকপোস্ট বসিয়ে বাঙ্গালীদের পালাবার সব পথ বন্ধ করে দিল ওরা। মুখে তখনও মিস্টি হাসিটা ঝুলছেই। অমায়িক আচরণ। যারাই পালিয়ে যেতে চাইছে, তাদেরই চেকপোস্ট থেকে "হাম লোগ মুসলমান হ্যায়, তুম হামারে ভাই হ্যায়, কোয়ি কুচ নেহি বিগার সাকতে, কিধার যাওগে তুমলোগ? কুচ নেহি হোনে দুংগা।" বলে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
আসলেই কি তাই হয়েছিল? একাত্তরের নয় মাস বাঙালিরা সুখে শান্তিতে বিহারীদের ভাই হয়েই কাটিয়ে দিয়েছিল? নাকি তাদের বিহারীরা যত্ন করে আটকে রেখেছিল একজন একজন করে গরুর মতো জবাই করবে বলে? জল্লাদখানা, কালাপানি, আলোকদি, রাইনখোলা, শিয়ালবাড়ি, মুসলিম বাজার, সারেংবাড়ি বধ্যভূমিগুলোর নাম শুনেছেন? জল্লাদখানা বধ্যভূমির বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশনের সেফটি ট্যাংকের মুখের কাছে একজন বিহারী কসাই আসন পেতে বসতো, গরুর মাংশের দোকানের মতো তার সামনে বাঙ্গালীদের হাত পিছমোড়া চোখ কালো কাপড়ে বেঁধে ফেলা হত, সে আল্লাহু আকবর বলে জবাই করতো, মাথাটা ট্যাংকের ভেতর পড়ে যাবার পর দেহটা লাথি দিয়ে ফেলে দিত ওরা। একাত্তরের পুরো সময়টায় জল্লাদখানা পানির পাম্পের সেফটি ট্যাংকে কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫০০০, মুসলিম বাজার বধ্যভূমিতে ২০০০০ বাঙ্গালীকে জবাই করে ফেলে দিয়েছিল বিহারীরা।
শিয়ালবাড়ি-রূপনগর এলাকাটায় একাত্তরের পর কোথাও নিরেট মাটি ছিল না। যতদূর দৃষ্টি যায় পায়ের তলায় কেবল হাড় আর হাড়, মাথার খুলি, সাইজে ছয় ইঞ্চির কম এই হাড়গুলো সাক্ষ্য দিচ্ছিল যে বিহারীরা কেবল জবাই করেই ক্ষান্ত হয়নি, কুপিয়ে কুপিয়ে টুকরো টুকরো করেছিল হাড়গুলো। কুয়া, ডোবা, ঝোপঝাড়, মাঠ, গাছতলা, নির্জন জায়গা, জঙ্গল, বাড়ির উঠোন সর্বত্র কেবল পচা-আধপচা লাশ আর হাড়গোড়। সৈয়দ আলী জামে মসজিদের ভেতর এবং বারান্দায় অসংখ্য পচা লাশ, ছোট ছোট হাড় পড়ে ছিল।
সাচ্চা মুসলমান পরিচয় দেওয়া এই বিহারীরা মসজিদটাকেও বানিয়ে নিয়েছিল কসাইখানা, বাঙ্গালীদের টুকরো টুকরো করতে হবে না! কি, খুব অবিশ্বাস্য লাগছে শুনতে? এগুলো আমার কথা না, এক প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দী। মিরপুরের বাসিন্দা বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার সেখ ইসমাইল হোসেন তার একাত্তরের বীভৎস স্মৃতিকথা লিখেছেন তার "একাত্তরের মিরপুর" বইতে।
ওপরের তথ্যগুলো তার বই থেকে নেওয়া। জগতের নিকৃষ্টতম কীট বিহারীদের অদ্ভুত মনোজগৎ এবং তাদের অকল্পনীয় নৃশংসতা এতো গুছিয়ে আর হয়তো কেউ তুলে আনতে পারেনি। সাংবাদিক মেহেরুননিসা, শহীদ সাংবাদিক আবু তালেবের নৃশংস মৃত্যুর বর্ণনা দিয়েছেন তিনি এই বইতে, তুলে এনেছেন আলবদর শকুনদের চক্রান্তে বিহারী ও পাকিস্তানি সেনাদের হাতে পরিচালক জহির রায়হানের শহীদ হবার পুরো ঘটনাটা। একাত্তরের মিরপুরের অনেক বিস্মৃত ইতিহাস উঠে এসেছে এ তথ্যবহুল বইটিতে, একজন প্রতক্ষদর্শীর জবানে...