এই যে এতগুলো মানুষকে ভোগান্তির মুখে ফেলা হলো, তাদের মৃত্যুকূপে ঠেলে দেয়া হলো, এসবের কি কোন শাস্তি হবে? জবাবদিহিতার মুখে পড়বেন কেউ?
হাজার হাজার মানুষ হাঁটছে। মাথার ওপর চড়া রোদ, রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া নেই, থাকার কথাও না। মাঝেমধ্যে সাইরেণ বাজিয়ে ছুটে যাচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স, হুটহাট দেখা মিলছে একটা-দুটো ট্রাকের; সেগুলোতে মানুষের ভীড়, তিল ধারণের জায়গা নেই। মানুষগুলো আসছে ঢাকার দিকে, লকডাউনের এই সময়টাতে তারা ছুটছে চাকরির তাগিদে, জীবিকার মায়ায়। ভয়ানক এই সময়টাতে, যখন দূরত্ব মেনে চলে সাবধানে ঘরের ভেতরে থাকতে বলা হয়েছে বাংলাদেশের সবাইকে, তখন এই মানুষগুলোকে বাড়ি থেকে ঢাকা অবদি এভাবেই টেনে এনেছে গার্মেন্টস মালিকরা।
২৪ তারিখ থেকে পুরো দেশ অঘোষিত লকডাউনে গেছে, অথচ গার্মেন্টস বন্ধ হয়েছে দু'দিন পর। লম্বা ছুটি পেয়ে শ্রমিকদের একটা বড় অংশও পাড়ি জমিয়েছেন বাড়িতে, ভেবেছেন সেখানেই নিরাপদে থাকবেন। অফিস আদালতে ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে, আগামী এগারো তারিখ পর্যন্ত বন্ধ থাকবে সব। অথচ গার্মেন্টস মালিকদের তর সইলো না, তারা আগের নোটিশের সঙ্গে নতুন করে কিছু যোগ করলেন না, কাজেই গার্মেন্টস শ্রমিকদের কাছে বার্তা গেল, ৫ তারিখে কাজে যোগ না দিলে চাকরী থাকবে না!
এই লোকগুলো করোনাভাইরাস কি, সেটা ঠিকমতো জানে না। সামাজিক দূরত্ব কি জিনিস, সেটা তাদের জানা নেই। হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, সেটাও হয়তো জানা নেই অনেকের। এরা করোনায় ভুগে মরে যাওয়াকে ভয় পায় না, তাদের ভয় চাকরি হারানোতে, তারা ভয় পায় না খেয়ে অভুক্ত থাকাকে। ওদের আতঙ্কের নাম অন্ধকার ভবিষ্যত, করোনাভাইরাস নয়। আর তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, শত শত মাইল পায়ে হেঁটে তারা ঢাকায় ফিরেছে গার্মেন্টস মালিকদের নির্মম কৌতুকের শিকার হয়ে। আর পুরো সময়টাতে সরকার আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বসে বসে তামাশাটা দেখেছে, থামানোর কোন চেষ্টা করেনি, সরকারের নীতিনির্ধারকেরাও গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতিটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেন না!
গার্মেন্টসের মালিকেরা সরকারের কাছে প্রণোদনা সুবিধা চেয়েছিলেন, পাঁচ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা পাবেন বলে আশ্বাসও মিলেছিল। কিন্ত এখন দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ঋণ সুবিধা দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা ঋণ চাননি, তাদের দাবী এককালীন প্রণোদনা দেয়া হবে, যেটি ফেরত দিতে হবে না। চাওয়ার সঙ্গে পাওয়া না মেলাতেই অধিকাংশ গার্মেন্টস মালিক বেঁকে বসেছেন, ডাক পাঠিয়েছেন শ্রমিকদের, বলা হয়েছে, আজ সকালের মধ্যে কাজে যোগ না দিলে চাকরি থাকবে না! এই মানুষগুলো শুধু চাকরি বাঁচানোর জন্যে দূর দূরান্ত থেকে ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় ফিরে এসেছে।
এরা না খেয়ে না দেয়ে, মাথায় ভারী কাপড়ের বোঝা চাপিয়ে ফিরে এসেছেন শহরে। কাজে যোগও দেবেন আজ। এদের মধ্যে কেউ যদি করোনা পজিটিভ থেকে থাকেন, তার মাধ্যমে যদি গোটা গার্মেন্টসের সব কর্মী সংক্রমিত হন, পুরো গার্মেন্টসটাকেই আইসোলেশন সেন্টারে পরিণত করতে হয়- কেমন দাঁড়াবে ব্যপারটা? সেরকম কিছু ঘটার সম্ভাবনা তো সবচেয়ে বেশি। ঘটলে কি হবে কারো কোন ভাবনা আছে? কি এমন অর্ডার পড়ে আছে, যেগুলো শেষ করার জন্যে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে এতগুলো মানুষকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় টেনে নিতে হবে?
আর ওদের আনা-নেয়ার জন্যে যদি সরকার বা গার্মেন্টসের কোন ব্যবস্থা করা থাকতো, তাহলেও ক্ষতে উপশম দেয়ার একটা যুক্তি পাওয়া যেতো। এক-দেড়দিন ধরে হেঁটে ঢাকায় এসেছে সবাই। যে মানবেতর পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের ঢাকায় ঢুকতে হয়েছে, সেটা অবর্ণনীয়। রাতেই আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, নতুন করে কেউ যাতে ঢাকায় ঢুকতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করার জন্যে। তাহলে যে মানুষটা পরিবার নিয়ে নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, জামালপুর বা এরকম কোন জায়গা থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে সাভার পর্যন্ত এসেছেন, তিনি কি করবেন? কোথায় যাবেন? তার আশ্রয় কোথায় হবে?
রাতে বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক গার্মেন্টস মালিকদের 'অনুরোধ' করেছেন, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তারা যাতে কারখানা বন্ধ রাখেন। আর ইউ কিডিং? লাখখানেক শ্রমিক আর তাদের পরিবারকে দিনমান হাঁটিয়ে ঢাকায় আনলেন, ভোগান্তির চূড়ান্ত করলেন, এখন মাথায় এসেছে গার্মেন্টস বন্ধ রাখার কথা? সরকারী-বেসরকারী অফিসের সাথে গার্মেন্টসেও ১১ তারিখ পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করা হলে কি এমন মহাভারতটা অশুদ্ধ হয়ে যেতো? এসব অর্ডার, রেমিট্যান্স, সবকিছুর চেয়ে মানুষের জীবনের দাম বেশি। এখানে অনুরোধের আসর বসিয়ে লাভ নেই, দিতে হবে আদেশ। অথচ এই জায়গাটাতে মেরুদণ্ডহীন একটা প্রতিষ্ঠানের মতো আচরণ করলো বিজিএমইএ।
এই যে এতগুলো মানুষকে ভোগান্তির মুখে ফেলা হলো, তাদের মৃত্যুকূপে ঠেলে দেয়া হলো, এসবের কি কোন শাস্তি হবে? জবাবদিহিতার মুখে পড়বেন কেউ? পড়বেন না। কারণ দিনশেষে শ্রমিকের ঘামের দাম দেয়া হয় না, গরীবের কষ্টের ভাগ কেউ নেয় না। দম দেয়া কলের পুতুলের মতোই তাদের সাথে ব্যবহার করা হয়, উঠতে বললে উঠবে, বসতে বললে বসবে- এটাই যেন তাদের নিয়তি!