পুলিশকে যারা মানবিক একটা বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলছেন ধীরে ধীরে...
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

পুলিশ দারুণ কাজ করছে। কোয়ারেন্টিন থেকে শুরু করে মানুষকে ঘরে পাঠানো, ত্রাণ দেয়া, এমনকি করোনা আক্রান্ত লোকের দাফন সবখানেই পুলিশের সরব উপস্থিতি।
দুই বছর দুই মাস দায়িত্ব পালন করে আইজিপির পদ থেকে কাল বিদায় নেবেন জাবেদ পাটোয়ারী। মানুষ ক্ষমতায় যে আসে তাকে নিয়ে বেশি কথা বলতে পছন্দ করে। আমি না হয় জাবেদ পাটোয়ারীকে নিয়ে দুটো লাইন লিখি। ২০১৮ সালের ২৫ জানুয়ারি সরকার আপনাকে নতুন আইজিপি করার পর অভিনন্দন জানিয়ে ফেসবুকে খুব ছোট্ট করে লিখেছিলাম, মানবিক পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলুন- আপনার কাছে আমার এটাই চাওয়া। আমাকে যদি কেউ বলে গত দুই বছরে আপনার সবচেয়ে বড় অর্জন কী? আমি বলবো পুলিশ বাহিনীকে মানবিক করার জন্য আপনার নানা চেষ্টা ও পদক্ষেপগুলো ছিল চোখে পড়ার মতো। এর প্রমাণ দেখছি করোনাবিরোধী লড়াইয়ে।
জাবেদ পাটোয়ারীর সাথে ব্যক্তিগতভাবে আমার পরিচয় বা ঘনিষ্ঠতা নেই। সাংবাদিকতার করার সময়েই তার পেশাদারিত্বের কথা শুনেছি। ৬ষ্ঠ বিসিএসে (১৯৮৪) পুলিশ ক্যাডারে মেধা তালিকায় প্রথম হয়ে ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিসে যোগ দিয়েছিলেন জাবেদ পাটোয়ারী। আমার চোখে তিনি দারুণ পেশাদার একজন পুলিশ কর্মকর্তা। পুলিশ বাহিনীকে মানবিক করার জন্য তার নানা চেষ্টা ও পদক্ষেপগুলো ছিল চোখে পড়ার মতো। তার প্রমাণ দেখছি করোনাবিরোধী লড়াইয়ে।

আমি বলবো পুলিশ দারুণ কাজ করছে। কোয়ারেন্টিন থেকে শুরু করে মানুষকে ঘরে পাঠানো, ত্রাণ দেয়া, এমনকি করোনা আক্রান্ত লোকের দাফন সবখানেই পুলিশের সরব উপস্থিতি। এমনকি লকডাউন শুরুর কয়েকদিনের মধ্যেই আপনি কঠোর নির্দেশনা দিলেন কোথাও যেন মানুষ নিপীড়নের শিকার না হয়। আমি বলবো মানবিক পুলিশের অসাধারণ এক রূপ দেখে আপনি বিদায় নিচ্ছেন। আপনার জন্য শুভ কামনা।
নবনিযুক্ত আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদের জন্য শুভ কামনা। ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের জহরুল হক হলের বড় ভাই আপনি। আপনার সাথে ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও অ্যালামনাইতে কয়েকবার দেখেছি আপনাকে। সাংবাদিকতার কারণে কথাও বলেছি কয়েকবার। আপনার জন্য সময়টা চ্যালেঞ্জের। আপনাকে বলবো, মানবিক পুলিশ গড়ার জন্য জাবেদ পাটোয়ারী যেভাবে শুরু করেছিলেন, যেখানে শেষ করেছিলেন সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকুক। আর বজায় থাকুক পুলিশের পেশাদারিত্ব।
আগের আইজিপিকে অভিনন্দন জানানোর সময় শেষে যে কথাটা লিখেছিলাম নতুন আইজিপির কাছেও সেটাই চাওয়া। আমরা এমন পুলিশ দেখতে চাই না, যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে মানুষকে হয়রানি করবে। নিজের আখের গোছাবে। আপনার কাছে অনুরোধ অপরাধ করে কেউ যেন পার না পায়। এমনকি পুলিশ হলেও।

কথাটা বলছি কারণ দেশের সব মানুষ এখনো পুলিশকে বন্ধু হিসেবে পাবে না। সাংবাদিকতার সময় পুলিশের সংস্কার, পুলিশের নিয়োগ, পুলিশের দুর্নীতির মতো বিষয় নিয়ে আমি অনেক নিউজ করেছি। যদিও অন্য ক্যাডারেরর কোন কোন কর্মকর্তা আমাকে মাঝে মধ্যে বলেন, পুলিশের প্রতি আমার নাকি পক্ষপাত আছে। না সাংবাদিকতা বা লেখালেখির সময় সব ধরনের পক্ষপাত এড়িয়ে সত্যটা লেখার চেষ্টা করি । তবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেহেতু আমি বেশ কিছু কাজ করেছি এবং মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা ও পুলিশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নিয়ে কিছু কাজ করেছি,কাজেই এই বাহিনীর প্রতি আমার মনে সবসময় এক ধরনের গর্ব কাজ করে।
করোনার বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ের সময় সবাইকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাজারবাগের প্রতিরোধ যুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। ২য় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত বাতিল .৩০৩ রাইফেল দিয়ে সেদিন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল বাংলাদেশের পুলিশ। আত্মহত্যা ছাড়া আর কী বলবেন? আপনারা কী জানেন হানাদারদের বিরুদ্ধে শুধু প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়েই তুলেনি বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা বরং মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি শহীদ হয়েছেন এই পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা।
মুক্তিযুদ্ধে এক হাজার ২৬২ জন শহীদ পুলিশ সদস্যের তালিকা স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল পত্রে উল্লেখ পাওয়া যায়। এককভাবে আর কোন বাহিনী এভাবে আত্মত্যাগ করেনি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের হিসাব অনুযায়ী, পূর্ব পাকিস্তানে পুলিশের ৩৩ হাজার ৯৯৫ জন সদস্য কর্মরত ছিলেন। এর মধ্যে ১৪ হাজার পুলিশ সদস্য পাকিস্তান সরকারের আনুগত্য অস্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
আজকে যারা দেশ নিয়ে বহু বড় বড় কথা বলেন এমন অনেক বিভাগের লোকজন মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়টা মাস যেখানে নিজের চাকুরিটা করেছে, সেখানে পুলিশ করেছে মুক্তিযুদ্ধ। না শুধু সাধারণ পুলিশ সদস্যই নন, মুক্তিযুদ্ধের সময় পুলিশের আইজিপি আবদুল খালেক নিজে যুদ্ধ করেছেন। ২৫ মার্চ পুলিশ একাডেমী সারদায় কর্মরত থাকাকালে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন আবদুল খালেক। শহীদ পুলিশ সদস্যদের মধ্যে একজন ডিআইজি, চারজন পুলিশ সুপার, একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, একজন ডেপুটি পুলিশ সুপার (ডিএসপি), একজন সাব-ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার (এসডিপিও), ১২ জন পুলিশ পরিদর্শক ও ৮১ জন উপ-পুলিশ পরিদর্শকসহ প্রায় দেড় হাজার সদস্য শহীদ হন। বহু পুলিশ পঙ্গুত্ব বরণ করেন। নির্মম নির্যাতনের শিকার হন অনেকে।
পুলিশের মতো এমন গৌরব আর কোন বাহিনীর আছে? আর সে কারণেই যখন শুনি পুলিশ অপরাধ করছে, পুলিশ আরেকজনকে নির্যাতন করছে, দুর্নীতি করছে, মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করছে, আমার ভীষণ কষ্ট লাগে।
প্রিয় পুলিশ ভাইয়েরা! এই বাংলাদেশটা আমরা পেয়েছি আপনাদের মতো বহু পুলিশ সদস্যসহ সাধারণ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে। কাজেই এই দেশে আপনাদের কাছ থেকে কোন অন্যায় আশা করি না। পুলিশ কাউকে বিনা কারণে মারবে, জিম্মি করবে, সাধারণ মানুষ পুলিশের হাতে নিপীড়ত হবে কোনটাই কাম্য নয়।। বরং এই দেশের প্রতি সবচেয়ে বেশি দায়িত্ববোধ, এই দেশের মানুষের প্রতি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ আপনাদের কাছ থেকে আশা করি। অবশ্য শুধু পুলিশ কেন সবার কাছ থেকেই সেই প্রত্যাশা।
আমি বিশ্বাস করি একটা দেশের পুলিশ ভালো থাকলে সেই দেশে বহু খারাপ কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। এজন্য অবশ্য পুলিশকে দলীয় ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি দিতে হবে। বিদায়ী আইজিপির জন্য ভালোবাসা। আপনি দেখিয়েছেন একজন আইজিপি চাইলে একটা বাহিনীকে দারুণভাবে গড়তে পারেন। নতুন আইজিপির জন্য শুভকামনা। শুভকামনা পুরো বাহিনীর জন্য। ভালো থাকুক বাংলাদেশ-করোনার এই সংকটের সময় সেটাই একমাত্র চাওয়া।