তিনি মুগ্ধতা ছড়ান, বিরক্তিরও কারণ হন। খোদ মাদ্রিদের সমর্থকেরাই তার মুণ্ডুপাত করেন, আবার হুটহাট এমন কীর্তি গড়ে ফেলেন, বিস্ময়ে স্তব্ধ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। তিনি করিম বেনজেমা, দলের জন্য যিনি নিজের প্লেয়িং রোল স্যাক্রিফাইস করেছেন বারবার, যিনি কিছু না করেও অনেক কিছু করে ফেলেছেন...

ভারতীয় 'কালার্স' চ্যানেলের বেশ জনপ্রিয় ছিল 'দ্যা অনুপেম খের শো; 'কুচ ভি হো সাকতা হ্যায়'। সেই শোতে অতিথি হিসেবে বলিউডের কিংখান খ্যাত শাহরুখ খান একবার এসেছিলেন। তো শো-এর একপর্যায়ে নিজের বাবার সম্পর্কে বলতে গিয়ে শাহরুখ খান বলেছিলেন, 'আমার বাবা আমাকে বলতো কিছুই না করার জন্য। কেননা যারা নাকি কিছুই করে না, তারা চমৎকার করে!' হিন্দিতে যা এভাবে বলেছিলেন, 'যো লোক কুচ ন্যাহি কারতে, ও লোক কামাল কারতে হ্যায়!' হঠাৎ এমন কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে ছিলেন অনুপেম খের, নিশ্চয়ই অবাক হয়েছিল উপস্থিত এবং টিভি পর্দার অপরপাশের সকল দর্শকও। পরবর্তীতে শাহরুখের বাবার এই কথাটা নিয়ে বেশ চর্চা হয় এবং শাহরুখকেও সেটির ব্যাখ্যা দেয়া লাগে বিভিন্ন জায়গায়৷ সেগুলো লেখার মূললক্ষ্য বিষয় না। মূল বিষয় হলো, একজন ফুটবলের পাঁড়ভক্ত হিসেবে এই কথা শোনার পর আমার মাথায় প্রথমে যার কথা এসেছিলো তিনি হলেন রিয়াল মাদ্রিদ তারকা করিম বেনজেমা। জ্বি হ্যাঁ, যিনি কদিন আগেই রিয়ালে সফলভাবে নিজের এগারো তম বছর পূর্ণ করেছেন।

করিম বেনজেমা, একই সাথে রিয়াল সমর্থকদের মুগ্ধতা এবং বিরক্তির অন্যতম প্রধান বিষয়বস্তু। অবশ্য করিম বেনজেমা এমন এক নাম যাকে নিয়ে রিয়াল ভক্তকূলের অভিযোগ, অনুযোগ, বিরক্তি কোনোকিছুরই শেষ থাকে না। তবে একদমই ভালোবাসা পান না তা নয়, বরং হঠাৎ হঠাৎ এমন কিছু করে ফেলেন যা তাকে প্রশংসার শিখরে উঠিয়ে দেয়। কিন্তু সমস্যা হল, দৃষ্টিকটু ফুটবল খেলে আবারো মাটিতে নেমে আসতে একদমই সময় নেন না তিনি। মোটামুটি নিজের পারফর্ম্যান্স দিয়ে ভক্তদের সাইকোলজি নিয়ে খেলা তার রীতিমতো অভ্যাস। তবে এই মৌসুমে তিনি রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে সুবাতাস ছড়িয়েই চলেছেন। যার ফলে নিজেদের পালে হাওয়া দিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ গুটিগুটি পায়ে খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে রেকর্ড ৩৪তম লালীগা শিরোপা জয়ের দ্বারপ্রান্তে।

কাকা ও রোনালদোর সাথে ২০০৯ সালে ফ্রেঞ্চ ইয়াংস্টার হিসেবে তার আগমন ঘটে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে। পেলেগ্রেনি হয়ে, মরিনহো, আনচেলত্তি, জিদান- সব যুগেই তিনি ছিলেন কোচ ফেবারিট'স খেলোয়াড়ের তালিকার শীর্ষে! একদিকে শুনতেন সমর্থকদের দুয়োধ্বনি, অন্যদিকে ম্যানেজাররা যেন তাকে বিকল্পহীনভাবে প্রতি ম্যাচে একাদশের টিকিট ধরিয়ে দিতো। অবশ্য সমর্থকদের বিরক্তির উদ্রেকের কারণও আছে। তাদের এমনটাও দেখতে হয়েছে, ম্যাচে বেনজেমা ভীষণ খারাপ খেলছেন অথচ তাকে বদলি করা হচ্ছে না। পুরো নব্বই মিনিট খেলেই তিনি উঠেছেন, কি অদ্ভুত! এভাবেই বেনজেমা মৌসুমের পর মৌসুম পার করেছেন। বোর্ড ও ম্যানেজারদের অসংখ্যবার সমর্থকদের দ্বারা মুন্ডুপাত হওয়া সত্ত্বেও, হাজারো সমালোচনার ভীড়ে করিম বেনজেমা টিকে গেছেন বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্লাবে।

করিম বেনজেমা

২০০৯ সালে বেনজেমা, রিয়ালের স্কোয়াডে অন্তর্ভুক্ত হলেও আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড হিগুয়েনই ছিলেন রিয়ালের মূল স্ট্রাইকার। প্রথম মৌসুমে বেনজেমার নিজেকে মানিয়ে নিতে কষ্ট হলেও, পরের মৌসুম থেকেই তিনি দলের অপরিহার্য সদস্য হয়ে উঠেন। এমনকি ১১-১২ মৌসুমে বেনজেমার গোলসংখ্যা ছিল ৩২! ১৩ সালে বোর্ডের সাথে দ্বন্দ্বে হিগুয়েন যখন মাদ্রিদ ছেড়ে ইতালি পাড়ি জমায়, তখন একদম পাকাপাকিভাবে রিয়ালে নাম্বার নাইন পজিশনটা চলে আসে বেনজেমার দখলে। গঞ্জালো হিগুয়েন বিশ্বমানের স্ট্রাইকার ছিলেন, আজো আছেন। তার গোল স্কোরিং এবিলিটি কখনোই খারাপ ছিল না, তারপরেও হিগুয়েনকে বিশেষত যে কারণে দল ছাড়তে হয়েছিল সেটি হল রিয়াল মাদ্রিদের প্লেয়িং স্টাইলের সাথে তিনি ফিট ছিলেন না। কেননা পাক্কা নাম্বার নাইন হিসেবে খেললেও রিয়াল মাদ্রিদের প্লেয়িং স্টাইলে তাকে ডিস্ট্রিবিউটারের রোল প্লে করতে হয় এবং খেলা বিল্ডআপ এর সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে হয়।

রিয়াল মাদ্রিদ কাউন্টার অ্যাটাক বেসড ফুটবল খেলে। রিয়াল যখন কাউন্টার আক্রমণে উঠে তখন একজন মিডফিল্ডার বা উইঙ্গারকে যে রোল প্লে করতে হয়, একজন স্ট্রাইকারকেও সেই রোল প্লে করা লাগে। এভাবে ডি বক্সের কাছাকাছি গিয়ে শেষ পাসটা এমন কাউকে দেয়া হয় যে গোলটা করার মতো পজিশনে আছে, এখন সেটা রোনালদো বা বেনজেমা বা বেল বা ইস্কো যে কেউ হতে পারে। এই জায়গাতেই হিগুয়েন মানিয়ে নিতে পারছিলেন না, পেরেছিলেন করিম বেনজেমা। তিনি হয়ে উঠেছিলেন সত্যিকারের 'টিম প্লেয়ার', তাই টিকেও গেছেন তিনি। আনচেলত্তি বা জিদানের মাদ্রিদ স্কোয়াডে বেনজেমা ছিলেন গুরুত্বপূর্ন বা অপরিহার্য সদস্য। স্ট্রাইকার হয়েও মাঠে থাকে অনেকাংশে সেকেন্ড স্ট্রাইকার বা নাম্বার 'টেন' রোল প্লে করতে দেখা যেত। স্পেস ক্রিয়েট করায় ছিল বেনজেমার মূল লক্ষ্য। এভাবে মাদ্রিদের দলগত অসধারণ গোলগুলো বের হয়ে আসতো।

একজন নাম্বার নাইন হয়েও, একজন উইঙ্গার রোনালদোকে তিনি যেভাবে পুরোদমে গোলস্কোরার হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছেন তা তাকে ম্যানেজারদের বিবেচ্য তালিকায় সবসময় উপরের সারিতে রাখতে সাহায্য করে। রোনালদোকে ডি-বক্সে জায়গা করে দিয়ে, তিনি উঠেছেন উইং এ, খেলা বানিয়ে দিয়েছেন সেখান থেকেই। তাহলে কি এভাবে বলা যায়, বেনজেমা রোনালদোর জন্য নিজের মূল প্লেয়িং স্টাইল স্যাক্রিফাইস করেছেন? আসলে করেছেন, তবে শুধু রোনালদোর জন্য না বরং পুরো মাদ্রিদের জন্য।

বেনজেমা জ্বলছেন আপন আলোয়

জিনেদিন জিদানের প্রথম যুগে গ্যারেথ বেল তখনো উপেক্ষিত বা অনিয়মিত ছিলেন শুধুমাত্র বেনজেমার মতো খেলায় স্পেস ক্রিয়েট করতে পারতেন না বিধায়! জিজু তো সরাসরি বলেই দিয়েছিলেন, 'বেনজেমা ৫০ গোল করার মতো খেলোয়াড় নয়। কিন্তু তার এমন কিছু গুণ আছে যার জন্য আমার তাকে লাগবে।' অথচ জিদানের সময়ই নাম্বার নাইন হিসেবে সবচেয়ে বাজে সময় পার করেছেন বেনজেমা, ছিলেন অধারাবাহিক। গোলের দেখা পাননি সেভাবে, মিস করেছেন অনেক সহজ গোল। একের পর এক দৃষ্টিকটু শট নিয়েছেন। আমরা সাধারণ, স্বাভাবিক চিন্তা দিয়ে এসব দেখে বেনজেমা, জিদান দুইজনকেই একহাতে নিয়েছি। সমর্থক হয়েও 'ফ্রেঞ্চ কোটা' বলে বিরক্তিমাখা হাস্যরস করেছি। আর জিদান ডাগআউটে দাঁড়িয়ে বেনজেমাকে নিয়ে তার ফরমেশনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আদায় করে নিয়েছেন, এনেছেন একের পর এক সফলতা। এই মৌসুমও এর ব্যতিক্রম নয়। টানা দুই মৌসুম পর আবারো লালীগার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট রিয়ালের রাজকীয় শোকেসে উঠছে, পচা শামুকে পা না কাটলে সেটি একপ্রকার নিশ্চিত।

রোনালদোর ঘাটতি মেটাতে, গত মৌসুমে বেশ মোটা অর্থে ইডেন হাজার্ডকে দলে ভিড়িয়েছে রিয়াল ম্যানেজমেন্ট। কিন্তু কমাস পরেই গুরুতর ইঞ্জুরিতে পড়ে যান মাদ্রিদের নতুন 'পোস্টার বয়'। বেশ কয়েক মৌসুমের পর ধীরে ধীরে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠা যে এসেন্সিও থেকে সর্বোচ্চটা পাওয়ার তাগিদ জিদানের ছিল তিনিও মৌসুমের শুরুতে ইঞ্জুরিতে পড়ে রিয়ালকে ব্যাকফুটে ঠেলে দেন। তবে রিয়ালের সাদা পতাকা এগিয়ে নিতে এগিয়ে আসেন সিপাহিশালার পুরোনো সেনানী বেনজেমা। লীগের লম্বা দৌড়ে দলের হয়ে সর্বোচ্চ ১৮ গোল, ৮ টি এসিস্ট প্রোবাইড করে সকল রিয়াল খেলোয়াড়দের মধ্যে শীর্ষে আছেন। প্রতিটা গোল আদায়ে তিনি সময় নিয়েছেন ১৬৬ মিনিট। খুব আহামরি কি? না হয়তো, তবে এতেই যথেষ্ট হয়ে গেছে। লালীগার টেবিলের দিকে তাকিয়ে যে কেউ আজ সহজ শিরোনাম দিতে পারে, বেনজেমায় উড়ছে রিয়াল মাদ্রিদ!

ব্যাপারটা অনেকটা এমন দাঁড়িয়ে গিয়েছে যে, বেনজেমার ভূমিকা এমনে এমনে বোঝা যাবে না। এটার জন্য ডাগআউটে দাঁড়ানোর মতো রীতিমতো ফুটবল মস্তিষ্কের প্রয়োজন আছে। তবে যদি বোঝা যায় আরকি, করিম বেনজেমার মতো ফুটবলারকে কেন এতটা দরকার দলের জন্য! তারপরেও বলি, একজন সাধারণ সমর্থক হয়ে আমি আজো বুঝলাম না স্পেস ক্রিয়েট করেই কেমনে একজন এতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়, যেখানে তিনি এখনো বারবার মিস করেন সহজ সুযোগগুলো। খেই হারিয়ে ফেলেন বিপক্ষ দলের সীমানায়। তাকে ব্যাখ্যা করতে গেলে, নানান ট্যাকটিক্যাল রিপোর্ট পড়ে তারপর গিয়ে আলোচনায় বসা লাগে।

এই মৌসুমে আঠারো গোলের সংখ্যা দিয়ে কখনো রিয়ালে বেনজেমার মাহাত্ম্য হয়তো বোঝানো যাবে না। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর বিদায়ের পর, দলে একজন বিশ্বমানের স্কোরারের ঘাটতি হয়েছিলো। এজন্য সেই সুবিশাল ঘাটতি পূরণে নানা খেলোয়াড়ের নাম উঠে এসেছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, বর্তমান রিয়াল মাদ্রিদের প্লেয়িং স্টাইলে ক্রুস এবং বেনজেমার কোনো বিকল্প নেই। যেদিন বেনজেমা বিদায় নিবেন, সেদিন রিয়ালের খেলার ধাঁচেও বিশাল পরিবর্তন আনতে হবে। কারণ এটাই, বেনজেমা অধিকাংশ মাঠে কিছুই করতেন না, উলেখযোগ্যভাবে পজিশনিং চেঞ্জ এর বাইরে। রিয়াল মাদ্রিদের খেলার ছন্দ তাতেই তৈরি হয়। এজন্যই তিনি অনেক কিছু করে ফেলতেন!

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা