বছর পেরোয়, ঘড়ির কাঁটা ঘুরে ফিরে আসে পঁচিশে ফেব্রুয়ারী। ১১ বছর হয়ে গেলো, এই মানুষগুলো যারা হারিয়ে গেলেন, বেঘোরে প্রাণ দিতে হলো যে নিরপরাধ মানুষগুলোকে, ওরা তো ফিরে আসবেন না কোনদিন। সন্তান তার বাবার দেখা পাবে না, স্ত্রী তার স্বামীকে স্পর্শ করতে পারবেন না কোনদিন। স্মৃতিতে অম্লান হয়ে রয়ে যাবেন শুধু ওরা, চিরদিন... 

বৃদ্ধ ভদ্রলোকের নাম হাবিবুর রহমান। বনানীর সামরিক কবরস্থানে এসেছেন তিনি, ছেলের কবরে ফুল দিতে। হাবিবুর রহমানের অন্য একটা পরিচয় আছে, তিনি বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় নিহত কর্ণেল কুদরত এলাহী রহমানে’র পিতা। সাংবাদিকেরা সেই পরিচয় পেয়ে ঘিরে ধরলেন, কেউ একজন বোধহয় তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছেন? বন্ধ একটা কপাট হুট করে খুলে গেল যেন, অনেকদিনের রুদ্ধদ্বার ঠেলে হাজারো অবশ অনুভূতির দল ভীড় জমালো চারপাশে।

মানুষটা বলতে থাকেন- “আমি তো ওর বাবা ছিলাম না, ও’ই ছিল আমার বাবা। আমি ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করেছি কিনা, ঘুম ভালো হয়েছে কিনা, ওষুধ খেয়েছি কিনা, প্রতিটা জিনিস ফোন দিয়ে জানতে চাইতো। আমার কেমন লাগে তা বলে বোঝাতে পারব না। আমার বুক চিড়ে দেখলে হয়ত আপনারা বুঝতে পারতেন। কেমন আছি ছেলেকে হারিয়ে!” বছর পেরোয়, ঘড়ির কাঁটা ঘুরে ফিরে আসে পঁচিশে ফেব্রুয়ারী।

এই দিনটায় ওলট পালট হয়ে গিয়েছিল অনেকগুলো পরিবার। সেনাবাহিনীর ৫৭ জন চৌকস অফিসার আর তাদের পরিবারের সদস্য সহ প্রায় চুয়াত্তরজন মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন তিনদিন ধরে চলা বিডিআর বিদ্রোহে। জাতির শ্রেষ্ট সন্তানদের মধ্যে অন্যতম তারা, কত পরিশ্রম আর ত্যাগের ফসল হিসেবে সেনাবাহিনীর র‍্যাংক আর ব্যাজগুলো যুক্ত হয়েছিল নামের পাশে। দেশমাতৃকার জন্যে জীবন উতসর্গ করার শপথ নিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন যারা, সেই মানুষগুলোকে নির্মমভাবে হত্যা করে তাদের লাশ ফেলে রাখা হয়েছিল রাস্তার ওপরে। কারো লাশ ফেলে দেয়া হয়েছিল ড্রেনে, কারোটা আবার তাড়াহুড়ো করে মাটিচাপা দেয়া হয়েছিল প্রমাণ লোপাটের উদ্দেশ্যে। এমন মৃত্যু তো ওদের কাম্য ছিল না।

বিডিআর সপ্তাহের জন্যে সেজে থাকা পিলখানায় মৃত্যুর ভয়াল বিভীষিকা হুট করে ঢুকে পড়েছিল সেদিন সকালে। উৎসবমুখর অবস্থার মাঝে চাপা ষড়যন্ত্রের ফিসফাস আওয়াজটা বুঝতে পারেনি কেউই। ঘাতকের বুলেট হৃৎপিণ্ড এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়ার আগে বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিলও কল্পনা করতে পারেননি এমন কিছু ঘটতে পারে। মীরজাফরেরা থেমে ছিল না, সেটার প্রমাণ তো সেই ছোপ ছোপ রক্ত, বীভৎস মৃত্যু আর চুয়াত্তরটা মৃতদেহ জানে! তিনদিনের শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার সমাপ্তি ঘটেছিল বিদ্রোহী জওয়ানদের আত্মসমর্পণে, ততক্ষণে বাংলাদেশ হারিয়ে ফেলেছে তার সেরা আর চৌকস সন্তানদের মধ্যে সাতান্ন জনকে।

বিডিআর বিদ্রোহ / পিলখানা ট্রাজেডি

অপারেশন ডালভাত, বেতন ভাতা কিংবা বিডিআর থেকে সেনা কর্মকর্তাদের অপসারণ- অদ্ভুত সব ঠুনকো আর মনগড়া যুক্তি দিয়ে চালানো এই নির্মম হত্যাকাণ্ড তো স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ ঘটনাই। প্রতিবছর এই দিনটায় মেজর মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের কবরে ফুল দিতে আসেন তার বাবা-মা। সত্তরের বেশী বয়স দুজনেরই। সন্তানের কবরের কাছাকাছি এলেই কান্নার দমকটা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায় কোহিনূর বেগমের। মেজর মিজানুরের স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন পিলখানা ট্র্যাজেডির আটমাস আগে। দুই ছেলে রামী আর সামীর বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ছিল বাবা। সেই বাবাও হুট করে একদিন হারিয়ে গেলেন। জলপাই রঙের পোষাকটা পরে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলেন, তিনদিন পরে ফিরে এসেছিল তার নিথর শরীরটা। দাদা-দাদির কাছেই মানুষ হচ্ছে ওরা। কতটা সময় চলে গেছে সেই ঘটনার পরে, ওদের ক্ষতে প্রলেপ পড়েনি। প্রিয়জনের শূন্যতা তো কখনও পূরণ হবার নয়।

নিহত লে. কর্ণেল শামসুল আলমের স্ত্রী তার মৃত স্বামীর কবরের মাটিটুকু ছুঁয়ে দেখেন পরম মমতায়, যেন ভালোবাসার মানুষটিকে স্পর্শ করছেন তিনি। দু’গাল বেয়ে অশ্রুধারা নেমে আসে, সেগুলো মুছে দেয়ার কেউ নেই। আনমনেই স্বামীর সঙ্গে কথা বলেন তিনি- “এই যে আমরা তোমার কাছে এসেছি। দেখো, আমরা কেমন আছি। আমি এখন কার সঙ্গে কথা বলব বলো?” তার কথাগুলো প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে হয়তো কিন্ত সেগুলোর জবাব আসে না, আসবেও না কোনদিন। বাহিনীর নাম বদলে বিডিআর থেকে বিজিবি হয়েছে, দায়ীদের বিচার হয়েছে, এখনও চলছে, সাজাও হবে হয়তো। কিন্ত এই মানুষগুলো, যারা হারিয়ে গেলেন, বেঘোরে প্রাণ দিতে হলো যে নিরপরাধ মানুষগুলোকে, ওরা তো ফিরে আসবেন না কোনদিন। সন্তান তার বাবার দেখা পাবে না, স্ত্রী তার স্বামীকে স্পর্শ করতে পারবেন না কোনদিন। স্মৃতিতে অম্লান হয়ে রয়ে যাবেন শুধু ওরা, চিরদিন... 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা