যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে মন্তব্য করে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করেছিলেন এরদোয়ান, প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন রাষ্ট্রদূতকেও! এখন সেই তুরস্কই তাদের দেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে, এরদোয়ান নিজেও বাংলাদেশ সফরে আসবেন শিগগিরই...

আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নাকি চিরস্থায়ী শত্রু বা চিরস্থায়ী বন্ধু বলে কোন কথা নেই। প্রয়োজনের তাগিদে সম্পর্ক বদলায় বারবার। এই দেখুন না, কিছুদিন আগেই কি কেউ ভাবতে পারতো, ইজরাইলের সঙ্গে আরব আমিরাত বা বাহরাইনের মতো দেশগুলো বন্ধুত্ব পাতাবে? সেরকমই কেউ কি ভাবতে পেরেছিল যে ভারতীয় বলয় ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে চীনের হাত ধরবে নেপাল? কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুতে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীন বিষয়ে নাক গলানোর চেষ্টা করায় যে তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়েছিল বাংলাদেশের, এখন সেই সম্পর্কই আবার স্বাভাবিক বন্ধুত্বে রূপ নিয়েছে! 

মাস দুয়েক আগে ভারত যখন পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ রেখেছে, এই দুর্দিনে তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ এসেছে, ভাস্কর্য বিতর্কের মাঝখানেই তুরস্ক ঘোষণা দিয়েছে তারা আঙ্কারায় বঙ্গবন্ধুর স্মরণ্র ভাস্কর্য নির্মাণ করবে। তুরস্কের জাতির জনক মোস্তফা কামাল পাশার স্মরণে ঢাকায় নির্মাণ করা হবে ভাস্কর্য, সেটার খরচও বহন করবে তুরস্কই। মুজিব বর্ষের বিশেষ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আগামী বছরের শুরুর দিকে তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানও আসবেন বাংলাদেশে! আর এরদোয়ানকে বাংলাদেশ সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন খোদ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে একসময় ইন্টারন্যাশনাল ফোরামে বিদ্বেষাগার করেছিলেন এরদোয়ান। ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘ কয়েক বছরের টানাপোড়েন শেষ হয়ে গেছে বলেই মনে করা হচ্ছে।

এমনিতে বাংলাদেশের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক ভালো ছিল বরাবরই। ঢাকা আর আঙ্কারার মধ্যে বিরোধের সূত্রপাত শুরু হয় ২০১০ সালে। নির্বাচনে বিজয়ের পর ইশতেহারে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শুরু করে আওয়ামী লিগ সরকার। একের পর এক জামায়াত নেতারা আটক হতে থাকে, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করেছিল, বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিল। পাকিস্তান বা সৌদি আরবের মতো তুরস্কের সাথেও জামায়াতে ইসলামীর একটা ঘনিষ্ঠতা আছে, তাই বন্ধুকে বিপদে পড়তে দেখে কুটনৈতিক শিষ্টাচার ভেঙে যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন এরদোয়ান। 

রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে এরদোয়ান

শুধু তাই নয়, যুদ্ধাপরাধের দায়ে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর করার পর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট মি. এরদোয়ান ক্ষুব্ধ হয়ে ঢাকায় নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। এমনকি যুদ্ধাপরাধের কার্যক্রম তদারকি করতে বাংলাদেশে গোপনে প্রতিনিধিও পাঠিয়েছিলেন এরদোয়ান! অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের ক্ষমা প্রদর্শন করতে ২০১২ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের কাছে চিঠি দিয়েছিলেন তুরস্কের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির কাছে লেখা ওই চিঠিতে তুরস্কের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লিখেছিলেন, জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের ফাঁসি হলে বাংলাদেশের উপর এর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। 

বাংলাদেশও বরাবরই তুরস্ককে মুখের ওপর বলে এসেছে যে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি বাংলাদেশের আভ্যন্তরীর ব্যাপার, এটা নিয়ে মন্তব্য করার অধিকার তুরস্ক বা অন্য কোন দেশের নেই। সব ধরণের আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করেই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ। আর তাতে আঁতে ঘা লেগেছিল তুরস্ক সহ আরও কিছু মুসলিম দেশের। তারা এই যুদ্ধাপরাধীর বিচারকে বরাবরই 'ইসলামী নেতৃত্বের ওপর বাংলাদেশ সরকারের নির্যাতন' টাইপের একটা বস্তু হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছে, তবে সেই চেষ্টায় সফল হয়নি তারা। 

কিন্ত ২০১৬ সাল থেকেই পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। সেবছর এরদোয়ানকে উৎখাতের জন্যে একটা সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছিল তুরস্কে, যদিও সেটা ব্যর্থ হয়। সেই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিন্দা জানিয়ে এরদোয়ানকে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। নিজের দেশে জনপ্রিয়তা প্রমাণের জন্য এরদোয়ানের তখন আন্তর্জাতিক সমর্থন খুব জরুরী, শেখ হাসিনার সেই বার্তা তার জন্য আশীর্বার হয়েই এসেছিল। কৃতজ্ঞ এরদোয়ান সেই ঘটনার পর ঢাকায় তুরস্কের রাষ্ট্রদূতকে ফেরত পাঠিয়েছিলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে দূরত্ব কমানোর উদ্যোগও নিয়েছিলেন। 

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে এরদোয়ানের বৈঠক

গত কয়েক বছরে তুরস্ক কখনোই আগের মতো অনভিপ্রেত আচরণ বা মন্তব্য করেনি বাংলাদেশের ব্যাপারে। উল্টো ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি তুরস্কে গেছেন, তুরস্কের প্রধানমন্ত্রীও বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। রোহিঙ্গা ক্রাইসিস শুরু হবার পরে এরদোয়ান জাহাজ ভর্তি ত্রাণ পাঠিয়েছেন শরণার্থীদের জন্য, মেডিকেল টিম পাঠিয়েছেন, এরদোয়ানের স্ত্রী এবং তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এমিনি এরদোয়ান বাংলাদেশে এসেছেন রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে। তুরস্কও এরপর থেকে ইন্টারন্যাশনাল ফোরামে রোহিঙ্গাদের হয়ে কথা বলেছে, বাংলাদেশের প্রশংসাও শোনা গেছে দেশটির প্রতিনিধিদের মুখে।

বৈরুত বিস্ফোরণে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটা জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তুরস্ক সেটা নিজেদের উদ্যোগে সারিয়ে দিতে চাইছে। কিছুদিন আগেই আঙ্কারায় বাংলাদেশ দূতাবাসের নতুন ভবনের উদ্বোধন করা হলো, সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন। শেখ হাসিনা এবং এরদোয়ান দুজনেই ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উপস্থিত ছিলেন সেসময়। তখনই এরদোয়ানকে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন শেখ হাসিনা, পরে তুরস্কের প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে জানানো হয়েছে, ডি-৮ সম্মেলনে যোগ দিতে আগামী বছরের গোড়ার দিকে বাংলাদেশে আসবেন এরদোয়ান। 

রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে তুরস্কের ফার্স্ট লেডি। ছবি- Getty Image

তবে তুরস্কের সঙ্গে এই বন্ধুত্বটা বাংলাদেশের আরেক বন্ধু ভারত যে ভালোভাবে নেবে না, সেটা নিশ্চিত। কারন কাশ্মীর ইস্যুতে এরদোয়ানের মন্তব্য এবং অবস্থানের কারনে ভারতের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক এখন চরম অবনতির দিকে। আবার সৌদি আরবের সঙ্গেও তুরস্কের সম্পর্ক ভালো নয়। সৌদিকে কোণঠাসা করে ইরানের সঙ্গে একটা আলাদা বলয় গড়ে তুলছে তুরস্ক, তাদের পেছনে চীন আর রাশিয়ার সমর্থনও আছে। সেটা সৌদি বা তার মিত্র আমেরিকা ভালোভাবে নিচ্ছে না মোটেও। কাজেই তুরস্কের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে হলে অনেক কিছু বিচার বিশ্লেষণ করেই সামনে এগিয়ে যেতে হবে বাংলাদেশকে। 

তবে দিনশেষে কূটনীতি নির্ভর করে পারস্পরিক স্বার্থ আর আদান-প্রদানের ওপর। বন্ধুত্বের নামে যদি কেউ দেয়ার বদলে শুধু নিয়েই যায়, সেই বন্ধুত্বে মূল্য নেই। তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের নতুন সম্পর্কের আঁচ যে উপমহাদেশের ভূরাজনীতিতে পড়বে, তাতে অবশ্য কোন সন্দেহ নেই... 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা