করোনায় আক্রান্ত এক বৃদ্ধ অংশ নিয়েছিলেন দেওয়ানবাগীর ওরসে, সেখানে হাজির ছিল বিশ হাজার মানুষ! সেই লোক মরে গেছে, কিন্ত ভাইরাসটাকে ছড়িয়ে দিয়েছে এলাকায় এলাকায়, জেলা থেকে জেলায়...

মার্চের ১৭ তারিখে এগিয়ে চলোতেই আমরা মিনতি জানিয়েছিলাম, বাংলাদেশের রোগী নং ৩১ হবেন না প্লিজ! আজ এপ্রিলের ৮ তারিখ, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পেশেন্ট নম্বর থার্টিওয়ানকে পেয়ে গেছি আমরা ইতিমধ্যেই। লেখার ভেতরে ঢোকার আগে এই একত্রিশ নম্বর রোগী ব্যাপারটা কি- সেটা একটু জেনে নেয়া দরকার। রোগী মানে তো রোগীই, কিন্ত এই একত্রিশ নম্বর রোগীর বিশেষত্বটা কী?

এবছরের ১৭ই ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনা পজিটিভ রোগীর সংখ্যা ছিল ত্রিশ জন। ১৮ই ফেব্রুয়ারী এক নারীর করোনা ধরা পড়লো। তিনি ছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনা আক্রান্ত ৩১ নম্বর পেশেন্ট। তারপর সেদেশে হু হু করে করোনা পজিটিভ রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকলো।

অনুসন্ধানে জানা গেল, আক্রান্তদের বেশিরভাগই কোন না কোনভাবে সেই নারীর সংস্পর্শে এসেছিলেন। করোনায় আক্রান্ত অবস্থাতেই (পরীক্ষায় পজিটিভ প্রমাণিত হবার আগে) সেই নারী দুইবার চার্চে গিয়েছিলেন প্রার্থনার জন্য। ডাক্তারেরা তার শারীরিক অবস্থা দেখে তাকে বলেছিলেন আইসোলেশনে থাকার জন্যে, কিন্ত সেসব অমান্য করেই তিনি ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন, এমনকি এক বন্ধুর সঙ্গে রেস্টুরেন্টে ডিনারেও গিয়েছিলেন! প্রায় হাজারখানেক মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন শুধুমাত্র সেই নারীর অসতর্ক আচরণের কারণে!

এবার বাংলাদেশে ফেরা যাক। গত শনিবার নোভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে মারা যান ৯০ বছর বয়েসী এক বৃদ্ধ। আইইডিসিআর এর পক্ষ থেকে মৃত্যুর বিষয়টি জানানো হয়েছে, তবে তার পরিচয় জানানো হয়নি। মারা যাওয়া ব্যক্তির বাড়ি শরীয়তপুরে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা গেছেন, এটা ভয়ের ব্যাপার নয়। আতঙ্কের ঘটনা হচ্ছে, আক্রান্ত অবস্থাতেই তিনি মতিঝিলে দেওয়ানবাগীর ওরসে অংশ নিয়েছিলেন। ২০শে মার্চের সেই ওরসে উপস্থিত ছিল প্রায় হাজার বিশেক মানুষ। ভাবতেও ভয় লাগছে, সেখানে আসা কতগুলো মানুষ এখন করোনাভাইরাসের নীরব বাহক হয়ে আছে! 

বাংলাদেশেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে করোনাভাইরাস

ওই বৃদ্ধের কেস ফাইল থেকে জানা গেছে, মৃত্যুর আগে ১৬ দিন অসুস্থ ছিলেন ওই বৃদ্ধ। গত ১২ই মার্চ ঢাকায় এসেছিলেন তিনি, উঠেছিলেন মিরপুরে বড় মেয়ের বাসায়। তার মেয়ে, মেয়ের জামাই এবং নাতি এখন জ্বর-সর্দি-কাশিতে ভুগছেন, তবে তাদেরও করোনা হয়েছে কিনা জানা যায়নি এখনও।  এখানে ছোট্ট একটা টুইস্ট আছে। করোনায় মারা যাওয়া বৃদ্ধের ছেলে ইতালি থেকে দেশে এসেছেন জানুয়ারীর ৮ তারিখে। তবে ইতালি থেকে তিনি রোগের বীজ নিয়ে আসেননি, এটা নিশ্চিত। তার শ্বশুরবাড়ি মিরপুরের টোলারবাগে, এখানেই কিন্ত দেশের দ্বিতীয় করোনাভাইরাস রোগীর মৃত্যু হয়েছিল। আর যে ভবনে সেই রোগী মারা গিয়েছিলেন, সেই ভবনেই হচ্ছে আমাদের এই পেশেন্ট নম্বর ৩১ এর ছেলের শ্বশুরবাড়ি। পুরো ভবন এবং গোটা এলাকা এখন লকডাউন।

বৃদ্ধ লোকটি কীভাবে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, সেটার কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই এখনও। তবে তার পরিবারের সদস্যদের দাবী, মেয়ের বাসায় থাকার সময় তিনি স্থানীয় মসজিদে নামাজ পড়তে বেরিয়েছেন, এবং ২০শে মার্চ দেওয়ানবাগীর ওরসে অংশ নিয়েছেন। তবে ওরসে যাওয়ার আগে থেকেই তিনি জ্বর-কাশিতে ভুগছিলেন, অর্থাৎ ভাইরাস তার শরীরে প্রবেশ করেছে ২০শে মার্চের আগেই। ওরসে তার সংস্পর্শে নিশ্চয়ই আরও শত শত মানুষ এসেছেন, তাদের কী অবস্থা, ভেবে দেখুন এবার।

পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে

কমবেশি সারাদেশেই দেওয়ানবাগীর ভক্ত-মুরিদ ছড়িয়ে আছে। ঢাকার ভেতরে মতিঝিল, মুগদা, বাসাবো এবং মিরপুর এলাকায় এদের বসবাস বেশি। ঢাকার বাইরে শরীয়তপুর, জামালপুর, নারায়ণগঞ্জ এবং মাদারীপুরের অনেক মানুষ দেওয়ানবাগীর ভক্ত। এই জেলাগুলোতে ইতিমধ্যেই অন্যান্য জেলার তুলনায় করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। মাদারীপুরে তো কয়েকটা উপজেলা লকডাউন করে দেয়া হয়েছে, নারায়ণগঞ্জেও করোনার দাপট অব্যাহত, গতকাল রাত থেকে লকডাউন করা হয়েছে পুরো জেলা। শরীয়তপুরেও করোনার ব্যাপ্তি অন্য যে কোন জেলার তুলনায় অনেক বেশি। ঢাকার ভেতরে বাসাবো আর মিরপুরের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। আইইডিসিআর বলছে, শুধু বিদেশফেরতদের সংস্পর্শ নয়, এসব জায়গায় সংক্রমণ ইতিমধ্যেই ক্লাস্টার আকার ধারণ করেছে। এখন প্রশ্ন একটাই, এই এলাকাগুলো, বা জেলাগুলোতে করোনাভাইরাস ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ার পেছনে মৃত ওই ব্যক্তি আর দেওয়ানবাগীর ওরসের ভূমিকাই কী সবচেয়ে বেশি নয়? বাংলাদেশ কি তবে তার রোগী নং একত্রিশকে পেয়েই গেল?

১৭ই মার্চ থেকে স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে করোনাভাইরাসের কারণে, মুজিববর্ষের অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে, অথচ ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে বিশ হাজার মানুষের একটা জমায়েত হচ্ছে- এটা প্রশাসনের কেউ জানলো না? ঠেকানোর কোন ব্যবস্থা নেয়া হলো না? কতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন হলে এই সময়ে এমন একটা গণজমায়েত ঘটানো সম্ভব, মাথায় আসছে না একদমই। তার চেয়ে বিরক্ত লাগছে প্রশাসনের উদাসীনতা দেখে। তাদের নাকের ডগায় করোনার এই বিপজ্জনক সময়ে এরকম একটা মানবমেলা হলো, তারা সেটা প্রতিহত করতে পারলেন না? জেলায় জেলায় করোনা ছড়ানোর দায় দেওয়ানবাগের সেই ওরস যেমন অস্বীকার করতে পারবে না, সেটা ঠেকাতে না পারায় প্রশাসনের সামনেও কি দায় এড়ানোর কোন উপায় আছে? 

আরও পড়ুন- 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা