মালদ্বীপে ত্রাণ পাঠানোর খবর ও আমাদের বর্বর আচরণ
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
মালদ্বীপে ত্রাণ এবং চিকিৎসা সামগ্রী পাঠানো হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে- এরকম একটা খবর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ামাত্রই বীর বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়েছে গালিগালাজে। কিন্ত এই ত্রাণ আসলে কাদের জন্য পাঠানো হচ্ছে- সেটা জানার চেষ্টা করেনি কেউ, সবাই হুজুগে মেতেছে...
মালদ্বীপে ত্রাণ এবং চিকিৎসা সামগ্রী পাঠানো হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে- এরকম একটা খবর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ামাত্রই বীর বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়েছে গালিগালাজে। কিন্ত একটু কষ্ট করে খবরের ভেতরে ঢুকে খুব বেশি মানুষ জানার চেষ্টা করেনি, কেন এসব ত্রাণ মালদ্বীপে পাঠানো হচ্ছে, কাদের জন্যে যাচ্ছে এগুলো। কিছু মিডিয়া আবার শিরোনাম দিয়েই খালাস, বিস্তারিত বর্ণনার ঝামেলাতেও যায়নি, ভাসাভাসা কিছু তথ্য দিয়ে রেখেছে। তাতেই ক্ষেপেছে অনেকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারকে গালাগালির মিছিল শুরু হয়েছে। সবার ভাষ্য একটাই- আমরা খেতে পাচ্ছি না, আর দেশ থেকে ত্রাণ যাচ্ছে মালদ্বীপে!
অথচ খবরটা একটু মন দিয়ে পড়লে, সেন্সিবল মানসিকতা নিয়ে একটু খোঁজ করে দেখলেই জানা যেতো, এই ত্রাণ আসলে বাংলাদেশীদের জন্যেই পাঠানো হচ্ছে। মালদ্বীপে আটকা পড়ে হাজার হাজার প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্যে জাহাজে করে পাঠানো হচ্ছে খাবার এবং চিকিৎসাসামগ্রী। বাংলাদেশ থেকে পাঠানো এসব পণ্য সেখানে থাকা বাংলাদেশীরাই পাবেন, তারাই ব্যবহার করবেন। চল্লিশ মেট্রিক টন চাল, বিশ মেট্রিক টন আলু, দশ মেট্রিক টন ডাল সহ আরও কয়েক রকমের খাদ্যপণ্য এবং ঔষধ আছে এই ত্রাণসামগ্রীর তালিকায়।
করোনাভাইরাসের কারণে পুরো বিশ্ব লকডাউনে, নিজ নিজ নাগরিকদের ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে প্রত্যেক দেশই। এই যে আমেরিকার অবস্থা এত খারাপ, প্রতিদিন দুই-আড়াই হাজার মানুষ মরছে সেখানে, তারাও তো জরুরী ফ্লাইটে বাংলাদেশ থেকে শত শত নাগরিককে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। মালদ্বীপে বাস করেপ্রায় চার লাখের মতো মানুষ, এর মধ্যে মালদ্বীপের নাগরিক আছেন দুই লাখের কিছু বেশি। বাকীরা অন্যান্য দেশ থেকে আসা প্রবাসী শ্রমিক। পেটের দায়ে মালদ্বীপে গিয়েছেন। এই শ্রমিকদের মধ্যে বাংলাদেশীদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি, প্রায় সত্তর হাজার। এর ভেতরে বিশ হাজার আছেন এমন, যারা অবৈধভাবে গিয়েছেন সেখানে। লকডাউনের এই সময়টাতে সবচেয়ে বেশি বিপদে আছেন তারাই।
মালদ্বীপের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনীতি পুরোপুরি নির্ভর করে ট্যুরিজমের ওপরে। প্রবাসী বাংলাদেশীদের বেশিরভাগও এখানে ট্যুরিজম সেক্টরের সঙ্গেই যুক্ত বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত। লকডাউন আর বিমান বন্ধের কারণে পর্যটন খাত থেকে এখন আয় শূন্য, বাঙালি যারা মালদ্বীপে আছেন, তারাও মোটামুটি বেকার অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। যারা বৈধভাবে গেছেন, তাদের তো তাও একটা গতি আছে, সরকারের তরফ থেকে সাহায্য পাচ্ছেন। যারা অবৈধ অভিবাসী, তারা একবেলা-আধবেলা খেয়ে কাটাচ্ছেন। বাইরে এলে পুলিশ গ্রেফতার করবে, এই আতঙ্কে বেরুতেও পারছেন না।
লকডাউন শুরু হবার সময় মালদ্বীপ সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে অনুরোধ করা হয়েছিল, আমরা যেন আমাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিয়ে আসি। মালদ্বীপ ছোট রাষ্ট্র, সক্ষমতা সীমিত, খাদ্যপণ্যের বেলায় আমদানীর ওপরেই নির্ভর তারা। সবাইকে বসিয়ে খাওয়ানোর অবস্থা তো তাদের নেই। কিন্ত ৭০ হাজার মানুষকে দেশে ফেরানোটাও মুখের কথা নয়। তাছাড়া বিমান চলাচলও ততদিনে বন্ধ হয়ে গেছে। এত মানুষের জন্যে স্পেশাল ফ্লাইটের ব্যবস্থা করাটা ভীষণ কঠিণ। বাংলাদেশ সরকার তাই তখন মালদ্বীপকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, করোনা মোকাবেলায় তাদের যথাসাধ্য সাহায্য করা হবে। সেখানে যারা বাংলাদেশী আছেন, তাদের জন্যে খাবার এবং ঔষধ পাঠানো হবে দেশ থেকেই।
সেই প্রতিশ্রুতিই রক্ষা করছে সরকার। বাংলাদেশীদের জন্যে জাহাজে করে পাঠানো হচ্ছে খাবার, ঔষধ। পরিমাণটা খুব আহামরি নয়। অন্তত ৭০ হাজার মানুষকে স্পেশাল ফ্লাইটে দেশে ফিরিয়ে আনার খরচের কথা ভাবুন, সেটার সঙ্গে তুলনা করলে অংকটাকে নগণ্যই মনে হবে। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশীদের জন্য কাজ করছে, বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য ত্রাণ পাঠাচ্ছে। যে মানুষগুলো রক্ত পানি করে দেশের রেমিট্যান্স খাতকে শক্তিশালী করছে বছরের পর বছর ধরে, তারা কি বাংলাদেশের কাছে এতটুকু অনুগ্রহ পাবার অধিকার রাখেন না?
অথচ আপনারা, জ্ঞানী-গুণী শিক্ষিত মানুষজন কি করলেন? বর্বরের মতো না জেনে, না বুঝে গণহারে শেয়ার দেয়া শুরু করলেন সেই খবর, ভেতরে কি লেখা আছে সেটা পড়ার কষ্ট করলেন না, তার আগেই শুরু হলো গালাগালি। মালদ্বীপ সরকার এতদিন ধরর বাংলাদেশীদের খাবার আর চিকিৎসা দিয়ে এসেছে, অথচ বাংলাদেশ থেকে যখন কিছু খাবার আর ঔষধ গেল, তখন দেশের মানুষ হয়ে আপনারা শুরু করলেন চিৎকার-চেঁচামেচি!
এই দেশটা কি শুধু আপনাদের সম্পত্তি? সতেরো কোটি মানুষের প্রত্যেকের অধিকার আছে এখানে। ত্রাণের চাল চোর তেল চোরেরা যেমন সব নিজেদের কাছে কুক্ষিগত করে রাখতে চায়, আপনাদের আচরণও ঠিক সেরকমই, কোন পার্থক্য নেই। মিডিয়াও রঙচং মিশিয়ে শিরোনাম বানালো, বাইরে থেকে দেখেই সবার মনে হয়েছে কি না কি ঘটে যাচ্ছে, দেশের মানুষ খেতে পাচ্ছে না, আত্মহত্যার খবর আসছে, আর এদিকে দেশের ত্রাণ যাচ্ছে বিদেশে! দেই গালি, উড়িয়ে ফেলি সমালোচনা করে!
সময়টা খারাপ, ভীষণ খারাপ। মনমেজাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না সসময়। তবুও সেন্সিবল মানুষের মতো আচরণ করুন, শিক্ষিত হয়ে থাকলে সেটার প্রমাণ দিন নিজের আচরণে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও নিজেকে জংলি আর অসভ্য হিসেবে প্রমাণ করার মিশনে নামা মানে আপনার মতো অধম দুনিয়াতে খুব বেশি নেই- এটা মাথায় রাখবেন প্লিজ।