ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটা অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটেছে। অনার কিলিং বস্তুটা আগে পাকিস্তান আর ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। তো বাংলাদেশিরা ভাবলো আমরাই বা পিছিয়ে থাকবো কেন? তাই এরাও শুরু করে দিয়েছে।
নাসিরনগর উপজেলায় ষোল বছরের এক কিশোরীকে তার বাবা, বড়ভাই আর মামা মিলে হত্যা করেছে। ওই তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ বলছে, ওই কিশোরী ধরমণ্ডল গ্রামে তার মামার বাড়িতে থাকতো। গত ২২ জুন দুপুরে তাকে বাড়ির পাশে পাটক্ষেতে এক যুবকের সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলে তার মামা। উনি তখন সেটা কিশোরীর বাবা মাকে জানায়। পরদিন সকালে বাবা ও মামা মিলে ওই মেয়েটাকে হত্যার পরিকল্পনা করে এবং রাত সাড়ে ১০টার দিকে মেয়ের বাবা, মামা আর বড়ভাই মিলে মেয়েটাকে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। লাশ একটা ডোবায় ফেলে দেয়। অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
পাটক্ষেতে প্রেম নতুন কোন জিনিস না। শহরের ছেলে মেয়েরা ফাস্টফুড ক্যাফেতে প্রেম করে, লিটনের ফ্ল্যাটে যায়। গ্রামের প্রেমিক প্রেমিকারা বটতলা, বেলতলা, বৈশাখী মেলা কিংবা ধানক্ষেত পাটক্ষেতে ডেটিং করে, চুমু খায়। তারা সেখানে কোন ড্রাগ নিতে যায় নাই, কাউকে খুন করতেও যায় নাই। ভালবাসাবাসির তাগিদে সবাইকে লুকিয়ে দেখা করেছিল।
যদি সমাজ এরকম অসভ্য বর্বর না হতো, তাহলে তারা গ্রামের রাস্তায় হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটতে পারতো, গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে চুমু খেতে পারতো। সেটা এই সমাজ পারমিট করে না বলেই দেশজুড়ে ছেলেমেয়েরা লুকিয়ে ভালবাসে, প্রেম করে, চুমু খায়, শরীর বিনিময় করে। অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া, সমাজের অসভ্যতামির ধারায় যাকে নোংরা কাজ বলে প্রচার করা হয়।
এই সমাজে পাটক্ষেতে ধর্ষণ হলে সেটা সবাই মিলে চুপচাপ চেপে যায়, এমনকি পুলিশের কাছেও যায় না। কিন্তু কেউ ভালবাসলে, প্রেম করলে সমাজের মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়ে। তার আফটার ইফেক্ট হিসেবে মেয়েটাকেই শায়েস্তা করা হয়। কারণ মেয়েকে শায়েস্তা করা সহজ। কারণ মেয়েকে শায়েস্তা করার বিধান সমাজ দিয়ে রেখেছে।
অনার কিলিং আসলে সব কালেই ছিল। পরিবারের সম্মান রক্ষার জন্য মেয়েকে আদব লেহাজ ধর্মকর্ম পর্দাপুশিদার মধ্যে থাকতে হবে, পড়ালেখা বাদ দিতে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছা ভুলে যেতে হবে, তার সকল ইচ্ছা, রুচি, চাহিদা বিসর্জন দিতে হবে, পরিবারের মাথা যাতে উঁচু হয় এজন্য মেয়ের পছন্দের তোয়াক্কা না করে পরিবারের পছন্দ করা পুরুষকে বিয়ে করতে হবে এবং সেই পুরুষের সাথে চরম অসুখি ও অত্যাচারিত হতে থাকলেও পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে সেই পুরুষকেই মৃত্যু অবধি সঙ্গী হিসাবে মেনে নিতে হবে।
পরিবারের জন্য জন্মমুহুর্ত থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একটা মেয়ে নিজেকে নিঃশেষিত করে, করতে দেয়। করতে বাধ্য হয়। কারণ এসবের ভেতরেই পরিবারের সম্মান আর সমাজের রীতিনীতি ঘাপটি মেরে আছে। এসবের কাছে একটা মেয়ের প্রাণ কিংবা গোটা জীবন এত তুচ্ছ যে তা নিয়ে কোন আলোচনাই চলতে পারে না!
যে কিশোরীকে আজকে মেরে ফেলা হলো, সে কিশোরীর কথা কেউ ভাবে নাই। তার বয়ঃসন্ধিকাল, তার আবেগ, তার ইচ্ছা, তার টানাপোড়েন, তার যৌনশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, তার জন্য সুস্থ একটা পরিবেশ- কিছুই না। এর কিছুই তাকে দিতে পারে নাই এই রাষ্ট্র, এই সমাজ। তারা তাকে একমাত্র যা দিতে পারে তা হল- মৃত্যু। খুন হয়ে যাওয়া।
এই অসভ্য সমাজে খুন হওয়ার জন্য একটা মেয়ে জন্মায়, কিশোরী থেকে নারী ও বৃদ্ধা হয়ে ওঠে, এবং প্রতিদিন প্রতি মুহুর্তে মানসিক ও শারীরিকভাবে খুন হয়।
নারীর খুন হয়ে যাওয়াটাই এখানে সত্য ও স্বাভাবিক, মানুষের মতো বেঁচে থাকাটা না।
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন
আরও পড়ুন-