ব্যারিস্টার রফিকুল হক: ক্রান্তিকালের কাণ্ডারি!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
দলীয় আইনজীবীরা যখন ভয়ে সিঁটিয়ে ছিলেন, তখন তিনি এগিয়ে এসে দুই নেত্রীর হয়ে মামলা লড়েছেন একই সময়ে, জন্ম দিয়েছেন বিরল এক নজিরের! সততাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচা এই মানুষটার জেদের কারনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের 'মাইনাস-টু' ফর্মুলা বাস্তবায়ন হতে পারেনি...
শেখ হাসিনার নামে কোন মামলা হলে আওয়ামী লীগপন্থী সেরা আইনজীবীটিই সেই মামলা লড়বেন, খালেদা জিয়ার মামলা লড়বেন বিএনপিপন্থী সেরা আইনজ্ঞটি- এটাই অলিখিত নিয়ম। কিন্ত গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একটা ব্যতিক্রম দেখেছিল বাংলাদেশ। দুই নেত্রীকে যখন আলাদা আলাদা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তখন দলীয় আইনজীবীদের অনেকেই ভয়ে পিছিয়ে গিয়েছিলেন, সরকারের রোষানলে পড়ার আতঙ্কে মামলার কার্যক্রম পরিচালনায় অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
তখন দুই নেত্রীর হয়ে মামলা পরিচালনায় এগিয়ে এসেছিলেন প্রবীণ এক আইনজীবী, একই সময়ে শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া- দুজনেরই আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছিলেন এই ভদ্রলোক, বাংলাদেশের ইতিহাসে যেটা বিরলতম নজির। তার মিশনটা ছিল দুই নেত্রীকে কারামুক্ত করা। সেই মিশনে সফল হওয়া মানুষটা গতকাল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন, নাম তার ব্যারিস্টার রফিকুল হক, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে যিনি দায়িত্ব পালন করেছেন এক সময়ে, যার কাছে সততা আর নিষ্ঠা ছিল কাজের মূলমন্ত্র, জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত সেই সততাকে অবলম্বন করেই বেঁচেছিলেন তিনি।
রফিকুল হকের জন্ম অবিভক্ত ভারতের কলকাতায়, ১৯৩৫ সালে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৫ সালে স্নাতক, ১৯৫৭ সালে দর্শন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং ১৯৫৮ সালে এলএলবি অর্জন করেন। এরপর কলকাতা উচ্চ আদালতে আইনজীবী হিসেবে বারের সদস্য হন তিনি। ১৯৬১ সালে ব্যারিস্টার ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর বার অ্যাট ল করেন যুক্তরাজ্য থেকে। এরপর পরিবার নিয়ে চলে আসেন পূর্ব পাকিস্তানে, যোগ দেন ঢাকা উচ্চ আদালতে। ১৯৬৫ সালে তিনি পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে অ্যাডভোকেট হিসাবে কাজ শুরু করেন। এরপর ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে সিনিয়র আইনজীবী হিসাবে যোগ দেন। ১৯৯০ সালের ৭ এপ্রিল থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় আট মাস তিনি বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
তবে ব্যারিস্টার রফিকুল হককে বাংলাদেশের মানুষ ভালোভাবে চিনেছে ফখরুদ্দীন-মঈন ইউ আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। দুর্নীতির মামলায় প্রধান দুই নেত্রীকেই আটক করা হয়েছিল, পর্দার আড়ালে চলছিল মাইনাস-টু বাস্তবায়নের চক্রান্ত। আজীবন নির্দলীয় এবং নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি বজায় রাখা ব্যারিস্টার রফিকুল হক তখন ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দুই নেত্রীকে মুক্ত করার জন্য। একই সময়ে দুই নেত্রীর জন্যেই পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি, নেননি এক পয়সা পারিশ্রমিকও। মাইনাস-টু ফর্মুলা বাস্তবায়ন হতে পারেনি একরোখা এই মানুষটার জেদের কারনে।
সেই সময়ে দুই নেত্রীর মামলা পরিচালনার মাধ্যমে ব্যারিস্টার রফিকুল হক একটা বিরল কীর্তি স্থাপন করেছিলেন, যে কীর্তি বাংলাদেশ না এর আগে দেখেছে, না ভবিষ্যতে কখনও দেখবে। দলীয় পরিচয়ে থাকা আইনজীবীরাও যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রোষানলে পড়ার ভয়ে সিঁটিয়ে ছিলেন, নিজেদেরকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন বা আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন, তখন রফিকুল হক এগিয়ে এসেছিলেন মামলা পরিচালনা করতে। না, দুই নেত্রীর প্রতি তার আলাদা কোন টান ছিল না, কোন দলের প্রতি আনুগত্যও ছিল না, তিনু শুধু জানতেন, দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হলে হাসিনা-খালেদার মুক্তির কোন বিকল্প নেই, আর সেই মিশনেই তিনি লড়েছেন, সফলও হয়েছেন।
সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবীরা যখন রাজনীতির পঙ্কিলতায় গা ভাসিয়েছে, ব্যারিস্টার রফিকুল হক তখন সেসব থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন সযতনে। কোন দলের ট্যাগ লাগতে দেননি নামের পাশে, সবার সাথেই তার সুসম্পর্ক ছিল, অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করতেও ছাড়তেন না। স্পষ্টভাষী ছিলেন, মুখের ওপর কথা শুনিয়ে দিতেন। আত্মীয়-স্বজনদের কাছে তিনি ছিলেন ত্রাতা, অনেক শিক্ষিত আত্মীয়কে চাকরি জোগাড় করে দিয়েছেন। তারা ধন্যবাদ দিতে এলে শুধু বলেছেন সৎ থাকতে, মাথা ঠিক রাখতে। সততাটা তার কাছে সবচেয়ে বড় ব্যাপার ছিল। নিজে সততাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচেছেন, তাই তো দল-মত নির্বিশেষে সবার কাছে সম্মানও পেয়েছেন।
দুই নেত্রীর মামলা পরিচালনার সময় অনেকেই তাকে বলতেন 'সেলিব্রেটি'। বলতেন, ক্ষমতায় যেই আসুক, দিন তো আপনার! ব্যারিস্টার রফিকুল হক হাসতেন, পরিচিতজনদের বলতেন- “জানিস, আমি ভাবছি দুই ম্যাডামকে আমার বাড়িতে এনে একটা ঘরে বন্ধ করে দিয়ে বলবো, দেশের প্রশ্নে আপনারা একমত না হওয়া পর্যন্ত দরজা খুলবো না। কিন্ত সমস্যা আসলে ওদের মধ্যে না, আমি বললেই ওরা এক মত হবেন, আমার কথায় না করতে পারবেন না, কিন্তু সমস্যা ওদের নিচের নেতাগুলোকে নিয়ে।”
শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী হিসেবে প্রফেশনাল ক্যারিয়ারে প্রচুর টাকা আয় করেছেন ব্যারিস্টার রফিকুল হক, সেই টাকার একটা বড় অংশ ব্যয় করেছেন সমাজসেবায়, মানুষের কাজে। নানা জায়গায় হাসপাতাল, এতিমখানা, মসজিদ ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন, দিয়েছেন বড় বড় অঙ্কের অনুদানও। তার কাছে সাহায্য চাইতে এসে কেউ ফিরে গেছে- এমন নজির নেই বললেই চলে।
তিনি নিজে ক্যান্সার সারভাইভার ছিলেন, ক্যান্সার আক্রান্তদের জন্য ১৯৯৫ সালে নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেন সুবর্ণ ক্লিনিক। ঢাকা শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায়ও তিনি অবদান রেখেছিলেন। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে একটি ১০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন। সে কাজ এখনো চলছে। পাশাপাশি বারডেম হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ ও নূরজাহান ওয়ার্ড, আহছানিয়া মিশন ক্যানসার হাসপাতাল এবং আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চেয়ারম্যান হিসেবেও ছিলেন এই আইনজীবী। এর বাইরেও অন্তত ২৫টিরও বেশি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে তার সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল।
একটা ছোট্ট ঘটনা শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারছি না। ঘটনাটি ফেসবুকে লিখেছেন একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবী এবং 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গানের সুরকার আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন মাহমুদ। কোন একটা আইনি পরামর্শের জন্য তিনি গিয়েছিলেন ব্যারিস্টার রফিকের কাছে। তার কথা শুনে ব্যারিস্টার রফিক বলেছিলেন, 'আলতাফ মাহমুদের মেয়ের সমস্যা মানে আমারও সমস্যা। সব ঠিক করে দিব।' সেই সমস্যার সমাধানে এক টাকাও পারিশ্রমিক নেননি তিনি, উল্টো শাওন মাহমুদকে একটা শাড়ি উপহার দিয়েছিলেন তিনি। আর বলেছিলেন, 'সত্যিই কিছু দিতে চাইলে একদিন রান্না করে নিয়ে এসো, সাথে পায়েশ আনবে।' শাওন মাহমুদের রান্নার প্রশংসাও ঝরেছিল তার মুখে। এমনই সরল আর সাদামাটা জীবন ছিল তার, পরার্থে নিজেকে উৎসর্গ করাটা ছিল তার জীবনের ধর্ম।
শেষ জীবনটা বড্ড নিঃসঙ্গতায় কেটেছে তার, ২০১১ সালে স্ত্রীর বিদায়ের পর একদম একা হয়ে পড়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্টে খুব একটা যেতেন না। নতুন-পুরনো প্রায় সব মামলা পরিচালনার দায়িত্ব ছেড়েছিলেন ও জুনিয়র আইনজীবীদের কাঁধে। চার বছর আগে পায়ে অস্ত্রোপচারের পর স্বাভাবিক হাঁটাচলাও করতে পারতেন না, পাশাপাশি রক্তশূন্যতাসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায়ও ভুগছিলেন। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় গত ২১ অক্টোবর থেকে তাকে ওই হাসপাতালের আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। সেখানেই গতকাল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন ত্রিকালদর্শী এই মহীরুহ।
গত বছরের শেষ ভাগে স্যার ফজলে হাসান আবেদকে হারিয়েছি আমরা, এবছর মারা গেছেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, সরকারী কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান সা'দত হোসাইনের মতো কিংবদন্তিরা। সেই মিছিলে যুক্ত হলো ব্যারিস্টার রফিকুল হকের নামটাও। আফসোস শুধু এটাই, জাতির এই নায়ককে তার জীবিদ্দশায় সম্মানিত করতে পারিনি আমরা, তাকে একুশে পদকে ভূষিত করার পরিকল্পনাটাও কারো মাথায় আসেনি। কে জানে, রাজনৈতিক পরিচয় থাকলে অনেক আগেই হয়তো এই সম্মান পেয়ে যেতেন ব্যারিস্টার রফিক। কিন্ত সততা যার মূলমন্ত্র, তাকে কি আর পুরস্কার বা সম্মাননা দিয়ে বিচার করা যায়?
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন