বর্ণবৈষম্যের শিকার থেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট: দ্য ইনক্রেডিবল জার্নি অফ বারাক ওবামা!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
প্রেসিডেন্টের গুরুদায়িত্ব পালন করেও পরিবারকে সময় দিতে ভুলতেন না তিনি, মানুষের স্নেহ, ভালোবাসা, আশীর্বাদ পেয়েছেন অকুন্ঠ। দেশ, পরিবার ও ব্যক্তিগত শখ-আহ্লাদকে ব্যালেন্স করে ওবামা উঠে গিয়েছেন এমন এক অনন্য উচ্চতায়, যা ভাবলেও অবাক হতে হয়...
দুই মেয়াদের দায়িত্বপালন শেষে সেই কৃষ্ণাঙ্গ ভদ্রলোক যখন 'ফেয়ারওয়েল স্পিচ' দিতে মঞ্চে উঠলেন, তখন তার চোখের কোনে চিকচিক করছে অশ্রুবিন্দু। তবে তা লুকোনোর কোনো চেষ্টাই নেই যেন। চোখে জল, মুখে হাসি। বলে গেলেন-
Yes, we can, we did.
আমেরিকার জন্যে কতদূর কী করেছেন বারাক ওবামা, সে পরিসংখ্যান তোলা রইলো গবেষক ও ইতিহাসবিদদের জন্যে। কিন্তু এ কথা স্বীকার করতেই হবে, এরকম গুড ইমেজ নিয়ে খুব কম প্রেসিডেন্টই ছেড়েছেন হোয়াইট হাউজ। বলছি না, তাকে নিয়ে বিতর্ক ছিলোনা। অবশ্যই ছিলো। কিন্তু সেই বিতর্কগুলোও কখনো তার নিপাট ব্যক্তিত্বে খুব বেশি দাগ ফেলতে পারেনি। এবং তার বক্তব্যগুলো, যেগুলো তিনি দিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে, সেগুলোর মধ্যে যে যুক্তিবোধ, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও হিউমার রয়েছে, তা মিলিয়েমিশিয়ে তৈরী হয়েছে মাস্টারপিস! যেগুলো রয়ে যাবে প্রাসঙ্গিক আলোচনার তালিকায়, বরাবর, সবসময়েই। বক্তৃতায় পারদর্শিতা বা রাজনৈতিক প্রজ্ঞা না হয় বাদই দিলাম, স্ত্রী মিশেল আর দুই কন্যা- মালিয়া ও শাশার সাথে তাঁর যে রসায়ন... তাও তো আমাদের মুগ্ধ করেছে প্রত্যেক সময়েই।
আজকের কথাবার্তা স্যুটেড ব্যুটেড কৃষ্ণাঙ্গ সেই মানুষটিকে নিয়ে, যার মুখে সবসময়েই লেগে থাকে ঝকঝকে এক হাসি। যিনিই প্রথমবার বলেছিলেন-
দেয়ার ইজ নো কনসারভেটিভ অ্যামেরিকা, দেয়ার ইজ নো লিবারেল অ্যামেরিকা, দেয়ার ইজ অনলি দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অব অ্যামেরিকা।'
২০০৪ সালে ইলিনয়ের এক অখ্যাত ডেমোক্রেটিক সিনেটর, বোস্টনে অনুষ্ঠিত 'ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কনভেনশন' এর কি-নোট স্পিচ দেয়ার জন্যে উঠে এলেন। তিনি জানতেন তাকে কেউ চেনেনা৷ তিনি এও জানতেন, যদি সবার আস্থা অর্জন করতেই হয়, তাহলে এই ভাষণটা হতে হবে অসাধারণের চেয়েও বেশি কিছু। মঞ্চে এলেন। শুরু করলেন গল্প দিয়ে। নিজের জীবনের গল্প। সেই গল্পের সাথে যুক্ত করলেন অডিয়েন্সকে। যেন বোঝাতে চাইলেন, তিনি অজ্ঞাত কেউ না। তিনি বাকি সবার মতই। তাদেরই লোক। আস্তে আস্তে সম্মোহনীবিদ্যার মতই কথার জালে জড়িয়ে নিলেন সবাইকে।
খুব বেশিক্ষণ কথা বলেননি। কিন্তু সেই অল্পসময়ের মধ্যেই বর্ণবাদ, অভিবাসী সমস্যা, এলজিবিটি... সবকিছুকেই টেনে নিয়ে এলেন। এবং এমনভাবে সেগুলোকে যুক্ত করলেন, মানুষের আসলে তখন তার বিরুদ্ধে যাওয়ার কোনো উপায়ও নেই আর। এভাবেই তিনি হয়ে গেলেন সবার ঘরের ছেলে। ২০০৪ সালে দেয়া বারাক ওবামার এই ভাষণটি নিয়ে গবেষণা আজও হয়। একজন মানুষ, যাকে কেউ চেনেনা জানেনা, সে কীভাবে একটা বক্তৃতা দিয়েই ঢুকে যেতে পারে মানুষের মনের ভেতরে... এ বিষয়টি আজও মানুষকে ভাবায়। কথাবার্তাও হয়। হবেও৷
এবং ঠিক এই ঘটনার মধ্য দিয়েই বারাক ওবামার 'মিঃ প্রেসিডেন্ট' হয়ে ওঠার পথে যাত্রা শুরু।
বারাক ওবামার বাবা ছিলেন অর্থনীতিবিদ, এসেছিলেন কেনিয়া থেকে এবং তার মা অ্যান ডানহ্যাম ছিলেন আমেরিকারই। ওবামার বাবা হাওয়াই-মানোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রাশিয়ান ভাষা পড়ার সময়ে অ্যান ডানহ্যামের সঙ্গে পরিচিত হন। কিছুদিন পরে তারা বিয়েও করে ফেলেন। এর কিছু বছর পরেই বারাক ওবামার জন্ম। ওবামার জন্ম আমেরিকার হাওয়াই অঙ্গরাজ্যের রাজধানী হনলুলুতে, আগস্ট ৪, ১৯৬১ এ। যদিও শৈশব খুব ভালো কাটেনি তার। দুই বছর বয়সে তার বাবা-মায়ের বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে।
ওবামার মা দ্বিতীয় বিয়ে করেন ইন্দোনেশিয়ান লোলো সুতোরোকে, ওবামা অনেকদিন ইন্দোনেশিয়াতেই থাকেন তার মা ও নতুন বাবার সাথে। এরপর আবার ফিরে আসেন হাওয়াইতে দাদা-দাদীর কাছে। এখানে এসে তিনি পুনাহো স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন। যেটা ছিলো খুব অভিজাত স্কুল। এবং এখানেই ওবামা সর্বপ্রথম বর্ণবাদের মারাত্মক ও ক্লেদাক্ত চেহারা দেখতে পান। এবং নিজে কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার কারণে বৈষম্যের কিছু তিক্ত স্বাদও উপলব্ধি করেন তিনি এখানে। বিচ্ছিরি সময়ের প্রভাবে হাই স্কুলে থাকতে কোকেইন ও মারিজুয়ানা নেয়া শুরু করেন ওবামা। যদিও একসময়ে এই নেশার প্রকোপ কাটিয়ে উঠতে পারেন তিনি।
এখানের পড়াশোনা শেষ করে তিনি যান কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে পড়াশোনা করার পরে যান হার্ভার্ড ল স্কুলে। হার্ভার্ড ল স্কুলের 'হার্ভার্ড ল রিভিউ' এর প্রেসিডেন্টও তিনি ছিলেন। এখান থেকেই আইনের ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। মজার ব্যাপার হলো, এখানে থাকাকালীন সময়ে তিনি একবার মডেলিং এর জন্যেও নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন একটি ম্যাগাজিনে। যদিও তাকে রিজেক্ট করা হয় সেখান থেকে।
পড়াশোনার মাঝামাঝি সময়ে শিকাগোর একটি ল ফার্মে কয়েকদিন এ্যাসোসিয়েট হিসেবেও থাকেন। এরপর শিক্ষাজীবন শেষের পর রাজনীতিতে ঢুকে পড়েন। ইলিনয়ের সিনেটর হিসেবে নির্বাচিত হন। তখনো তিনি রাজনীতিতে বেশ নতুন মুখ। তিনি ইলিনয়ের সিনেটর হিসেবে এলেও সেখানে তখন আধিপত্য ছিলো রিপাবলিকানদের। অপরিচিত হিসেবে খুব বেশিদিন থাকতে হয়না অবশ্য। ২০০৪ সালের সেই অতিমানবীয় ভাষণ তাকে পুরো আমেরিকাতেই জনপ্রিয় করে তোলে। ওবামা হয়ে ওঠেন রাইজিং স্টার।
২০০৭ সালে এসে ঘোষণা দেন, তিনি প্রেসিডেন্ট পদের জন্যে নির্বাচন করবেন। বাকিটা তো আমাদের সবারই জানা৷ রিপাবলিকান প্রার্থী জন ম্যাককেইন কে হারিয়ে তিনি হন আমেরিকার ৪৪তম এবং প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট। প্রথম মেয়াদে এসে তিনি শিশুস্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা, করের হার কমানোসহ বেশকিছু অসাধারণ উদ্যোগ নেন। এসব কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৯ এ তাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারও দেয়া হয়।
আমেরিকার 'যুদ্ধবাজ' হিসেবে যে ঐতিহাসিক নামডাক আছে, সেটা কমাতেও তিনি ভূমিকা রাখেন। ইরাক থেকে আংশিক সৈন্য প্রত্যাহার করেন, আমেরিকার কমব্যাট মিশনের উপরেও স্থগিতাদেশ দেন। ইরাক যুদ্ধ প্রায় একাহাতেই থামান তিনি। চারপাশের সবাই-ই বেশ ভূয়সী প্রশংসা করে তাঁর এই উদ্যোগগুলোর।
২০১২ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে অবশ্য খুব বেশি নামডাক হয়নি। রিপাবলিকানদের ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় খানিকটা চাপেই থাকতে হয় তার প্রশাসনকে এই দফায়৷ তবে তাও তিনি 'সমবয়সী বিয়ে'কে বৈধ করেন, দ্বিতীয় মেয়াদে এসে। পরিবেশ রক্ষায়ও বেশ কিছু পদক্ষেপ নেন। ইরানের সাথে নিউক্লিয়ার শক্তি বিষয়ক চুক্তিও করেন। এবং ১৯২৮ সালের পরে তিনিই একমাত্র আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যিনি কিউবাতেও সফরে যান।
রাজনৈতিক বাতাবরণের মধ্যেও যে বিষয়টি উল্লেখযোগ্য, তিনি পরিবারকে সময় দিতেন যখনই পারতেন। ওবামা ধূমপায়ী ছিলেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী মিশেল ওবামাকে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, ওয়াশিংটনে আসার পরে তিনি ধূমপান ছেড়ে দেবেন। শেষপর্যন্ত তিনি ধূমপান ছেড়েও দেন ২০১০ সালের দিকে। পরিবারকে নিয়ে ঘুরতে বেড়ানো তো আছেই, বড় মেয়ে মালিয়ার সাথে একত্রে হ্যারি পটারের বইগুলোও পড়তেন তিনি। কথা দিয়েছিলেন, প্রেসিডেন্ট ইলেকশনে জিতলে মেয়েদের ছোট কুকুরছানা কিনে দেবেন৷ রেখেছেন সে কথাও। সোশ্যাল মিডিয়ায় এদের সম্প্রীতির ছবি দেখে মন ভালো হয়নি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবেনা।
ওবামা লিখেছেন তিনটি বইও। ড্রিমস ফ্রম মাই ফাদার, দ্য অডাসিটি অব হোপ এবং অফ দি, আই সিং: এ লেটার টু মাই ডটারস... তিনটি বই-ই হয়েছে বিখ্যাত। এর মধ্যে প্রথম দুইটি বইয়ের অডিও ভার্সনের জন্যে পেয়েছেন গ্রামি এ্যাওয়ার্ড। টাইম ম্যাগাজিনের 'মোস্ট ইনফ্লুয়েন্সিয়াল হান্ড্রেড পিপল' এর তালিকায় এসেছে তার নামও। দুইবার টাইম ম্যাগাজিনের 'পার্সন অব দ্য ইয়ার'ও নমিনেটেড হন। রাজনৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক জীবনের পাশাপাশি বই লিখেছেন, তা তো আগেই বলা হলো। এছাড়া নিজের একটি ইউটিউব চ্যানেলও আছে তাঁর। প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন প্রত্যেক সপ্তাহে ভিডিও আপলোড করতেন সেখানে। এই বিবেচনায় ধরলে, তিনিই প্রথম ইউটিউবার প্রেসিডেন্ট! তাছাড়া রান্নাবান্নাও করতেন সময়-সুযোগ পেলেই।
'বারাক' শব্দের অর্থ যার উপরে আশীর্বাদ বর্ষিত হয়েছে৷ বারাক ওবামার জীবনের সাথেও যেন এটি মিলে যায়। নিজের দুই দফা মেয়াদে তিনি নিয়েছেন বেশ কিছু অসাধারণ উদ্যোগ। মানুষের স্নেহ, ভালোবাসা, আশীর্বাদ পেয়েছেন অকুন্ঠ। দেশ, পরিবার ও ব্যক্তিগত শখ-আহ্লাদকে ব্যালেন্স করে তিনি উঠে গিয়েছেন এমন এক অনন্য উচ্চতায়, যা ভাবলেও অবাক হতে হয়।
স্পেশাল 'ওবামা কাট', পরিপাটি পোশাক, মুখভর্তি উদার হাসির সাতান্ন বছরের এই তরুণের জন্মদিন আজ। আমেরিকাকে তিনি হয়তো আরও অনেক কিছুই দিতে পারতেন, সে আলাপ অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু যা দিয়ে গিয়েছেন, তাই বা কম কী! একারণেই রইলো তার প্রতি শুভকামনা ও শ্রদ্ধা।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন