“অন্যান্য দেশের দূতাবাস থেকে তাদের শিক্ষার্থীদের খোঁজ এবং দেশের ফিরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের দূতাবাস এখনো আমাদের কোনো খবর নেয়নি। আমরা চাইলেও এখন দেশে ফিরে আসতে পারছি না।’’

এ যেন হলিউডের সিনেমার মতোই অবস্থা। রহস্যময় চীনা ভাইরাস আতঙ্কে কাঁপছে বিশ্ব। যেখান থেকে ঐ ভাইরাসের উৎপত্তি সেই হুবেই প্রদেশের উহান শহরে এক কোটিরও বেশি মানুষের বসবাস। উহান থেকে বাস, ট্রেন ও বিমান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বেশিরভাগ মানুষ ঘরে থাকছেন। উহান শহরের বাইরে যাওয়ার প্রধান সড়কগুলো চেকপয়েন্টের মাধ্যমে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। গণপরিবহন ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় খাবার সংকটেরও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

তবে এখনও কোনো বাংলাদেশি আক্রন্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। অন্য দেশের দূতাবাস নিজ দেশের ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে কেউ খোঁজ-খবর নেয়নি বলেও অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা।

রাকিবিল তূর্যের ফেসবুক স্ট্যাটাস

রাকিবিল তূর্য (২৩) নামে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী মেকানিক্যাল অ্যান্ড অটোমেশন ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে হুবেই ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে পড়াশোনা করছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তিনি উহানে তাদের অবস্থা জানিয়ে পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন,

“সম্প্রতি চায়নাতে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শহর উহানে আমি বাস করছি। এখানে আমরা প্রায় ৫০০ জনেরও অধিক বাংলাদেশী উহানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর, মাস্টার্স ও পিএইচডি ও প্রোগ্রামে অধ্যায়নরত। উহান থেকে বহির্গামী সব বাস, ট্রেন এবং বিমান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত অন্তত ২৫ জন মারা গেছে এবং ৬০০-এরও বেশি মানুষ এতে আক্রান্ত হয়েছে। আমরা চাইলেও এখন নিজ দেশে ফিরে যেতে পারছি না। বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে আমাদের খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে এমন নিউজ বাংলাদেশের মিডিয়াতে প্রচার করা হলেও এ খবর ভিত্তিহীন। আমাদের এখন পর্যন্ত কোনো প্রকার কোনো খোজ নেওয়া হয়নি। আমরা সবাই এক কঠিন মূহুর্ত পার করছি। আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদের সবাইকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করেন।’’

বাংলাদেশি গণমাধ্যম থেকে যোগাযোগ করা হলে তূর্য আরো জানান, “এখানে আমাদেরকে অনেক বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে চলাফেরা করতে হচ্ছে। কোথায় যাচ্ছি, কেনো যাচ্ছি, এসব কিছু লিখে রেজিস্টার খাতায় স্বাক্ষর করে তবেই আমরা বাইরে যেতে পারছি। আবার সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। তাই আমরা কোনোভাবেই খাবার সংগ্রহ করতে পারছি না। এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি। কেউ যাতে আক্রান্ত না হতে পারে সেজন্য এমন কঠোর সর্তকতা জারি হয়েছে। শুধু তাই নয়, যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় আমাদের খাবারও ফুরিয়ে আসছে। শিক্ষার্থীরা সবাই আতঙ্কিত এবং চিন্তিত।’’  

তিনি আরও বলেন, “আমরা সবাই ভয়ে আছি। কারণ ভাইরাস খুব দ্রুত স্প্রেড হচ্ছে। আমাদের আশেপাশে ভারত, শ্রীলংকার যারা আছেন তারা জানিয়েছেন, উহানে তাদের যে নাগরিক রয়েছেন চেকআপ করিয়ে তাদের দেশে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু আমাদের দূতাবাস এখনো কোনো খবর নেয়নি। কোনও পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানতে পারিনি। আমরা চাইলেও এখন দেশে ফিরে যেতে পারছি না।’’

চীনে অবস্থানরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের একাংশ 

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ছাত্র হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সবাই খুব চিন্তায় আছি। পরিস্থিতি খুবই খারাপের দিকে যাচ্ছে। বলা যায় মৃত্যুপুরীতে আছি। সবাই উৎকণ্ঠায় আছি। দোকানপাট বন্ধ, ঘর থেকে বের হওয়া যায় না। দূতাবাস থেকে এখনো কেউ যোগাযোগ করেনি। আমরা দ্রুত দেশে ফিরতে চাই।’  

হুবেই ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির শিক্ষার্থী শাফায়াত উল্লাহ খান বলেন, ‘কিছু কিছু সংবাদে বলা হচ্ছে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে আমাদের খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দূতাবাস থেকে আমাদের কোনো খোঁজ নেয়া হয়নি। পরিস্থিতি খুব একটা ভালো না। আমরা সবাই আতঙ্কের মধ্যে আছি।’ 

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইলিয়াস আহমেদ বলেন, ‘বাজার, দোকান, সুপারশপ বন্ধ। ভ্যাকেশন টাইম, ক্যান্টিনও বন্ধ। আমরা বাঙালিরা রান্না করে খাই। যাদের যা মজুত আছে শেষ হয়ে গেলে খুবই খারাপ পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। খুব শঙ্কার মধ্যে সময় পার করছি। আমরা সবাই রুমে বন্দী।’ 

আরেক শিক্ষার্থী মাহিন ইসলাম বলেন, ‘এখানের অবস্থা খুব একটা ভালো না। একটু আতঙ্কের মধ্যে আছি। রাস্তাঘাটে কোনো মানুষ নেই। বাজারে খাবার-দাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। আমরা চাই বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে আমাদের খোঁজখবর নেয়া হোক। এখানের পরিস্থিতি বিবেচনা করে তারা একটা সিদ্ধান্ত নিলে আমাদের জন্য ভালো হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের প্রতি আমার অনুরোধ এখানে আমরা যারা বাংলাদেশিরা আছি তারা আক্রান্ত হওয়ার আগেই ব্যবস্থা নিলে ভালো হয়। আক্রান্ত হওয়ার পর ব্যবস্থা নিলে সেটা ভালো হবে না। সবাইকে নিরাপদে বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আবেদন জানাচ্ছি।’

আরেক শিক্ষার্থী আসিফ আহমেদ সৌরভ জানান, ভাইরাসটি যাতে অন্য কোথাও ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য উহানের আশেপাশের আরও ১০টি শহরেও একইভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। প্রায় ৫০০ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী এ শহরে আটকা পড়েছেন বলে জানান তিনি।

বাকী শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, বেইজিংয়ে বাংলাদেশি দূতাবাসের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করেছিলেন। তবে, দূতাবাস থেকে বলা হয়েছে কেবল কোনো সমস্যায় পড়লে যেনো তাদেরকে জানানো হয়। এদিকে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আটকে পড়া শিক্ষার্থীদের কারো সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়নি। চীনে বাংলাদেশি দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশন মাসুদুর রহমান টেলিফোনে বাংলাদেশি এক গণমাধ্যমকে বলেন, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশি কেউ আক্রান্ত হয়নি। পুরো উহান শহর লক ডাউন। যার কারণে আমরা চাইলেও তাদের কাছে যেতে পারছি না। তবে আমরা খোঁজ খবর রাখছি। শিক্ষার্থীদের অনেকের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হচ্ছে।

এই অসহায় শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে, অন্তত মানবিকতার জন্য হলেও বাংলাদেশ দূতাবাসের নিজ উদ্যোগে এগিয়ে আসা উচিত। চীনের ভাইরাসে কেউই নিরাপদ নয় সেখানে। সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থী এবং নাগরিকদের যথাযথ চেকাপ করিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা এখন সময়ের দাবী। আমরা এভাবে আমাদের দেশের নাগরিকদের পরিত্যাগ করতে পারিনা। এ দায় কোনোভাবেই এড়ানো সম্ভব নয়। 

করোনাভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে দেয়া নির্দেশনাসমূহ 

চীনে আটকে পড়া শিক্ষার্থীরা সাহায্যের জন্য 17801116005 এই হটলাইন নাম্বারে অথবা,   

https://www.bdembassybeijing.org/contact-us/ এই লিংকে যোগাযোগ করতে পারবেন বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

তথ্যসূত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন, ডেইলি স্টার। 

আরো পড়ুনঃ রহস্যময় প্রাণঘাতী ভাইরাস: ঝুঁকিতে বাংলাদেশও!

চীনে রহস্যময় ভাইরাস: আতঙ্কে পুরো বিশ্ব!

 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা