আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ডের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে আপনাদের? যারা আবরার হত্যার সাথে জড়িত ছিল, প্রত্যেকেই 'বাংলাদেশ প্রিজন এক্সপেরিমেন্ট' এর গিনিপিগ হয়ে আজ জেল খাটছে খুনের আসামী হয়ে...

শিরোনামের প্রথমাংশের স্বীকৃত কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। 'বাংলাদেশ প্রিজন এক্সপেরিমেন্ট' বলে আজও এই বঙ্গদেশে কোনো পরীক্ষা চালানো হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। দ্বিতীয় অংশটি সে তুলনায় বেশ পরিচিত একটি শব্দ আমাদের কাছে। বিশেষত যাদের পাবলিক ভার্সিটির সংস্পর্শে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে, তাদের অনেকেরই এর বাস্তব অভিজ্ঞতাও আছে। এই দুটি বিষয়কে একসাথে সংযুক্ত করে আমি কি বোঝাতে চেয়েছি তার একটা স্পষ্ট ধারণা পেতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৭১ সালে। 

এদিকটায় যখন বাংলাদেশের মানুষ তাদের দাসত্বমোচনের জন্য প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছে, ওদিকে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সাইকোলজির অধ্যাপক ড. ফিলিপ জর্জ জিম্বার্ডো আয়োজন করতে যাচ্ছেন এমন একটি পরীক্ষার যা পরবর্তীতে মানব ইতিহাসে পরিচিত হয়ে থাকবে অন্যতম জঘন্য পরীক্ষা নামে। আর সেই পরীক্ষার নাম 'স্ট্যানফোর্ড প্রিজন এক্সপেরিমেন্ট'।

১৯৭১ সালের ১৪ আগস্টে শুরু হয় এই পরীক্ষা। অর্পিত ক্ষমতা পাওয়ার পর মানুষের আচরণগত কী পরিবর্তন আসে এবং কয়েদী ও জেলারদের মাঝে বিভিন্ন সাইকোলজি সম্পর্কে ধারণা পেতে আয়োজিত এই পরীক্ষায় নেয়া হয় স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির এমন ২৪ জন শিক্ষার্থীকে যাদের চরিত্রে কোনো ক্রিমিনাল রেকর্ড ছিল না, ড্রাগসের সাথে যাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না এবং তারা ছিল মানবিক গুণাবলীতেও বেশ প্রগতিশীল। এবং তাদের প্রত্যেকের বয়স ছিল ১৮ এর আশেপাশে, মানে একেবারে টগবগে যুবক। 

ড. জিম্বার্ডো এই ২৪ জন থেকে ১২ জনকে কয়েদী বানালেন এবং ১২ জনকে গার্ড হিসেবে রাখলেন। কৃত্রিম একটা জেল তৈরী করা হল যেখানে কয়েদীদের ঢোকানো হল এবং গার্ডদের বলা হল তারা যেন কয়েদীদের সাথে বাস্তবের জেল গার্ডদের মতো ব্যবহার করেন এবং কয়েদীদের নিয়ন্ত্রনে রাখতে তারা যা ইচ্ছে তাই করতে পারবেন যার কোনো জবাবদিহি ভবিষ্যতে তাদের করতে হবে না। 

ড. ফিলিপ জর্জ জিম্বার্ডো

পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। জেল গার্ড ভলান্টিয়াররা কয়েদী ভলান্টিয়ারদের নিয়ন্ত্রণ করতে থাকলেন। কিন্তু হঠাতই কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটা শুরু করে। নিয়ন্ত্রন করতে গিয়ে জেল গার্ডরা ক্রমাগত কয়েদীদের উপড় চড়াও হতে থাকেন। শান্তশিষ্ট ছেলেগুলো যেন হঠাৎ প্রচন্ড উগ্রতায় মেতে উঠে। প্রথম দিকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ, এরপর বিভিন্ন মানসিক অত্যাচার এবং এক পর্যায়ে শারিরীক অত্যাচার চলতে থাকে কয়েদীদের উপর। অত্যাচারের মাত্রা এতোটাই সীমা ছাড়িয়ে ছিল যে দু সপ্তাহের পরীক্ষা থামিয়ে দিতে হয় কেবল মাত্র ষষ্ঠ দিনের মাথায়। 

পরীক্ষা শেষে জিম্বার্ডো মতামত দিয়েছিলেন অনেকটা এরকম- পাওয়ার অব অথোরিটি, ক্ষমতার অসম বন্টন এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ ভাল মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন একজন মানুষকেও মুহুর্তের মাঝে ভিলেনে পরিণত করতে পারে। এক্ষেত্রে মানুষ তার পরিবেশ দ্বারা অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। 

(২০১৫ সালে স্ট্যানফোর্ড প্রিজন এক্সপেরিমেন্টের উপর ভিত্তি করে হলিউডে সিনেমা তৈরী করা হয়) 

লেখার এই পর্যায়ে এসে হয়তো অনেকেই ভ্রু কুচকে ভাবতে শুরু করেছেন, এরকমটা কীভাবে সত্যি হয়? বিবেক বলে কি মানুষের আদৌ কিছু নেই? যদি কখনো এরকম সুযোগ পেতেন, তবে নিশ্চয়ই আপনি এতোটা নিষ্ঠুর হতেন না। এই ধরনের চিন্তা যদি আপনার মস্তিস্কে ঘুরপাক খেয়ে থাকে তবে জেনে রাখুন এই দলে আপনি একা নন। আমার-আপনার মতো আরও অনেকেই এরকমটি ভেবেছেন। অনেকেই এই পরীক্ষার বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ও কৌশলগত ত্রুটির কথা বলেছেন। সেগুলোর মাঝে সাম্প্রতিক সময়ে একটি পরীক্ষা করেন জনপ্রিয় ইউটিউবার মাইকেল স্টিভেন ও সাইকোলজিস্ট জেরার্ড বার্টেলস। এই পরীক্ষার মাধ্যমে তারা স্ট্যানফোর্ড প্রিজনার এক্সপেরিমেন্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার সামনে নিয়ে আসেন। 

স্ট্যানফোর্ড প্রিজন এক্সপেরিমেন্টে নির্মমভাবে অত্যাচার করা হয় কয়েদীদের    

স্ট্যানফোর্ড প্রিজনার এক্সপেরিমেন্টে ক্ষমতার অসম বন্টন ও পাওয়ার অব অথোরিটির পাশাপাশি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক ছিল, যা মূলত পরীক্ষাটির সমস্ত সময়জুড়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখার চেষ্টা চালানো হয়েছে। আর তা হচ্ছে আউট সাইড ইনফ্লুয়েন্স বা তৃতীয় কোনো ব্যক্তির প্রভাব। আরও সহজ করে বলতে গেলে জেলগার্ডদের উপর ডা. জিম্বার্ডো ও গবেষক দলের প্ররোচনা। বেশ কিছু ট্যাপ রেকর্ড ও ভলান্টিয়ারদের স্বীকারোক্তিতে এটা প্রমাণিত যে ড.জিম্বার্ডো নিজে থেকেই জেল গার্ডদের বলে দিয়েছিলেন কয়েদীদের সাথে নিষ্ঠুর ব্যবহার করতে, তিনি এমন কিছু নিয়ম তৈরী করে দিয়েছিলেন যেগুলোর সাহায্যে খুব সহজেই একজন মানুষের উপর মানসিক অত্যাচার চালানো যায়। এমনকি এগুলো যেন গার্ডদের বিবেককে নাড়া না দেয়, সেজন্য তিনি তাদের এও বলেছিলেন, যে তারা সবাই এখানে যাচ্ছেন একেকজন এক্টর হিসেবে এবং মানবজাতির স্বার্থে তাদের উচিত নিজের সর্বোচ্চটা দেয়া। এরকম তথ্যই দিয়েছেন গার্ডদের একজন ডেভ এশালম্যান, যিনি নিষ্ঠুরতার দিক দিয়ে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন বাকি সব গার্ডদের। 

২০১৮ সালে মাইকেল ও বার্টেলস দেখতে চেয়েছিলেন বাইরের এই প্রভাবটা ব্যতীত বাকি যেই তিনটি বিষয় আছে,  সেগুলো একজন ভাল মানুষকে সাক্ষাত নরপশুতে পরিণত করতে পারে কিনা। অবাক করা ব্যাপার এই যে, এবার তারা তাদের এই পরীক্ষায় এমন একজন নরপশুকেও খুঁজেই পেলেন না। বরং বেশ কিছু জায়গায় অনেকেই যথেষ্ট ধৈর্য্যের প্রমাণ দিয়েছেন। 

এ থেকে আমরা কী মতামতে আসতে পারি? তৃতীয় পক্ষের একটি ভুল প্রভাবের মাধ্যমে, ভাল মানুষও খারাপ মানুষে পরিণত হতে পারে। হয়ে উঠতে পারে অত্যাচারী। ১৯৭১ সালের সেই স্ট্যানফোর্ড প্রিজন এক্সপেরিমেন্টের তত্বাবধায়নে থাকা ড. জিম্বার্ডো হয়তো ভুলেও কখনো ভাবেননি সামনের পঞ্চাশ বছরের মাঝে তিনি নিজেও তার এই পরীক্ষার একটি অংশ হিসেবে বিবেচিত হবেন। 

যাই হোক, ড. জিম্বার্ডো এর অসামান্য কৃতিত্ব সহকারে সম্পূর্ন স্ট্যানফোর্ড প্রিজন এক্সপেরিমেন্টটাকে যদি আমরা একটি বাক্যে নিয়ে আসি, তাহলে যা দাঁড়াবে সেই মূল বক্তব্যটিই আমাদের নিয়ে আসে আজকের মূল আলোচনায়। যা কিনা বাংলাদেশ প্রিজন এক্সপেরিমেন্ট!

আমার এক অতি নিকট সহচরের কাছে মনে হয়, আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন বহু প্রিজন এক্সপেরিমেন্ট চলে আসছে বহুদিন ধরে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিটি হলে হলে, গনরুমে চলে এই এক্সপেরিমেন্ট, পলিটিকাল ব্লকগুলোতে চলে এই এক্সপেরিমেন্ট, ডিপার্টমেন্টে ক্লাস শেষে ফাঁকা ক্লাসরুমগুলোতে চলে এই এক্সপেরিমেন্ট। আমজনতার ভাষায় যদি একে বলতে চাই, তাহলে বলতেই হবে- হ্যাঁ, আমি র‍্যাগিং এর কথাই বলছি।

আমি যখন প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখন আমার কাছে ডিপার্টমেন্টের র‍্যাগিং সহজ সরল লাগতো, ডিপার্টমেন্টাল র‍্যাগিংটা আসলে র‍্যাগিং না, পরিচিতি পর্ব এমনটা ভাববেন না, আত্মসম্মান ও মর্যাদা বিনষ্টের জন্য সেই র‍্যাগিংও যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। কিন্তু হলের র‍্যাগের তীব্রতাটা এতোটাই মারাত্মক ছিল যে, তার সাথে দুনিয়ার অন্য কোনো অপমান বেলই পেত না। হলে যারা র‍্যাগ দিতো তারা মূলত ছিলেন পলিটিকাল ব্লকে থাকা শিক্ষার্থী। সমগ্র হলটা একটা জেলখানা আর তারা যেন তার জেলার। প্রথম দিকে আমার তাদেরকে কখনো মানুষ বলে মনে হতো না (হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া)। এতোটা নিকৃষ্ট ও জঘন্য স্বভাবের মানুষ পৃথিবীতে থাকতে পারে, সেটা পাবলিক ভার্সিটিতে না পড়লে হয়তো কখনো জানা হতো না। ওই সময়টায় ভাবতাম তারা বোধহয় জন্ম থেকেই এমন। 

কিন্তু এরপর থেকে ধারণাটা পাল্টাতে থাকে। র‍্যাগের জ্বালায় অতিষ্ঠ, সুবোধ, মেধাবী কিছু বন্ধুদের (যারা আমাদের মধ্যে থেকে নতুন জেলার হবার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন) যখন দেখলাম এক বছর ঘুরতেই প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের কাছে তারাও একেকজন হায়েনা হয়ে উঠেছেন, তখন যেন স্ট্যানফোর্ড প্রিজন এক্সপেরিমেন্টটা আমার কাছে দিব্য সত্যের মতোন দেখা দিতে থাকলো।
  
প্রিজনারের জায়গায় প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী, গার্ডের জায়গায় র‍্যাগ দেয়া ইমিডিয়েট সিনিয়র আর ড. জিম্বার্ডো ও তার সহযোগীদের স্থানে তাদের সিনিয়র ও তাদের সিনিয়রদের বসিয়ে দিন। তাহলেই দেখবেন অংকটা একেবারেই সহজ। কতো সহজে একজন প্রতিভাবান মেধাবী তরুণকে অত্যাচারী পিশাচে পরিণত করে ফেলা হচ্ছে। জিম্বার্ডো কিন্তু ছ'দিনের মাথায় তার ভুলটা ধরতে পেরেছিলেন, কিন্তু আমরা সেটা কবে টের পাব? 

যাই হোক, শেষ করি আমার সেই অতি নিকট সহচরের আরেকটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে। আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ডের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে আপনাদের? বুয়েটের মেধাবী একজন তরুণ খুন হলো তারই সহপাঠীদের দ্বারা। খুনীদের মাঝে যাদের নাম এসেছে, তাদের দুজনকে আমার সহচর ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। একই শহরে ছোট থেকে বড় হয়েছেন তারা। মনুষত্ব, ছাত্রত্ব, বুদ্ধিমত্তা সবদিক দিয়ে বিচারেই তারা তার থেকে কয়েকগুন এগিয়ে থাকতো হয়তো। অথচ এমন দুজন মানুষ বাংলাদেশ প্রিজন এক্সপেরিমেন্টের গিনিপিগ হয়ে আজ জেল খাটছে খুনের আসামী হয়ে। সমাজের চোখে এবং বাস্তবিক অর্থেই তারা দুনিয়ার নিকৃষ্ট মানুষদের মাঝে পরিগণিত। 

একটা জাতি তার বুদ্ধিজীবীদের ছাড়া মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে না। আর যে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে এরকম প্রিজন এক্সপেরিমেন্ট চলে সে দেশে কখনো বুদ্ধিজীবী জন্ম নেয় না।

-

* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন

* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা