কাঁটাতারের দেয়াল তুলে কি আর ভালোবাসা ভাগ করা যায়?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
"থ্যাঙ্কিউ বাংলাদেশ৷ নিজের দেশের ভীনরাজ্যের মানুষ যখন বাংলার বিপদে আনন্দিত, তখন নিজের ভাষার দেশের থেকে এমন উত্তর ভাল লাগে৷"
সাতচ্চল্লিশে ইংরেজরা দেশ ভাগ করেছিল ধর্মের ভিত্তিতে, বাংলার মাঝ বরাবর তুলে দিয়েছিল কাঁটাতারের দেয়াল। ঋত্বিক ঘটক আক্ষেপ নিয়ে বলেছিলেন, 'বাংলারে তো আলাদা করলা, হৃদয়টারে ভাগ করবা কেমনে?' মাঝখানে দেয়াল উঠলেও, সুখে-দুঃখে দুই বাংলা বরাবরই পরস্পরের পাশে থেকেছে, বিপদে-আপদে একসঙ্গে লড়েছে। ভাষা এক, সংস্কৃতি এক, জীবনযাত্রার মানও কাছাকাছি, একই লেখকের লেখা গল্প-কবিতা-উপন্যাস পড়ে বড় হয়েছে শিশুরা, একটা কাঁটাতার কিংবা পাসপোর্টের রঙের পার্থক্যে কি আর ভেদাভেদটা তৈরি করা সম্ভব?
এপার-ওইপারের এই অবিচ্ছেদ্য ভালোবাসার বন্ধনের ছোট্ট একটা নজিরের দেখা মিললো আবারও। বাংলাদেশের করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করার জন্যে দুই বাংলার ৮৩ জন লেখকের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে 'অত্রিক' নামের একটা অনলাইন ম্যাগাজিন, যার শুভেচ্ছা মূল্য ধরা হয়েছে পঞ্চাশ টাকা। এই মূহুর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক সাদাত হোসাইন বা ওবায়েদ হক যেমন অত্রিকের জন্য লিখেছেন, তেমনই লিখেছেন ওপার বাংলার জনপ্রিয় ইউটিউবার কিরণ দত্তও। ম্যাগাজিন বিক্রি করে পাওয়া পুরো টাকাটাই চলে যাবে অসহায় মানুষের সাহায্যে।
এদের কেউ একটা পয়সা সম্মানী নেননি এই ম্যাগাজিনে লেখার জন্যে, ম্যাগাজিনের বিপণনের সঙ্গে যারা জড়িত, সেই লাইটার ইউথ ফাউন্ডেশনও অলাভজনক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। খুব অল্প সময়ে ম্যাগাজিনের পুরো আয়োজনটা করা হয়েছে, লেখক থেকে শুরু করে স্বেচ্ছাসেবী- সবাই ঘরের খেয়ে একরকম বনের মোষ তাড়ানোর কাজ করেছেন, এখনও করছেন। কেউ প্রচারণা চালাচ্ছেন, কেউবা দিন-রাত এক করে অত্রিককে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজ করছেন।
মূল ঘটনায় আসা যাক। কলকাতার লেখক নির্মল্য সেনগুপ্তের লেখাও প্রকাশিত হয়েছে অত্রিকে। ম্যাগাজিনটা সংগ্রহের জন্য তিনি বার্তা পাঠিয়েছিলেন লাইটার ইউথ ফাউন্ডেশনের ফেসবুক পেজে, জিজ্ঞেস করেছিলেন, ভারত থেকে টাকা কীভাবে দেব? তাকে জবাব দেয়া হয়েছে-
"আপনি আপনার ইমেইল আইডিটি দিন। আমরা আপনাকে বইটি পাঠিয়ে দিবো। বইয়ের শুভেচ্ছা মূল্য বাবদ যে টাকাটা আপনি আমাদের দিতে চাইছিলেন সে টাকা, কলকাতায় ঘূর্ণিঝড়ে যারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সেইসব অসহায় মানুষদের জন্য যারা ত্রাণ দিচ্ছে এমন কোন ব্যক্তি বা সংগঠনকে দিয়েন, তাহলেই হবে। এটা দুই বাংলার যৌথ উদ্যোগ। আর মানুষের জন্যই কাজ করছি আমরা। তাই মানুষ উপকৃত হলেই হল।"
সেই বার্তালাপের স্ক্রিনশট সহ নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে পোস্ট করেছেন নির্মল্য, লিখেছেন- "থ্যাঙ্কিউ বাংলাদেশ৷ নিজের দেশের ভীনরাজ্যের মানুষ যখন বাংলার বিপদে আনন্দিত, তখন নিজের ভাষার দেশের থেকে এমন উত্তর ভাল লাগে৷"
ভালোবাসার কি চমৎকার এক উদাহরণের জন্ম হলো, তাই না? টাকার অংকটা এখানে খুবই সামান্য, হয়তো একটা মানুষের তিন বেলার খাবারের খরচও উঠতো না এতে- কিন্ত ভালোবাসার পরিমাণটা অসীম, সেটাকে টাকা দিয়ে পরিমাপ করা সম্ভব নয় কোনভাবেই। ভারতের অনেক রাজ্যের মানুষ যখন পশ্চিমবঙ্গের এই বিপদের দিনে ঠাট্টা তামাশায় মত্ত, তখন বাংলাদেশ চুপ করে থাকতে পারেনি, কারণ ওই বাংলার সাথে আমাদের আত্মার সম্পর্ক, সেই সম্পর্ক মুছে যাওয়ার নয়।
ঘূর্ণিঝড় আম্পানের করাল থাবায় বিধ্বস্ত হয়েছে গোটা পশ্চিমবঙ্গ, শহর কলকাতার অবস্থা ভয়াবহ, যেন ভয়ানক কোন দৈত্য এসে পায়ের তলায় পিষে ফেলেছে ভারতবর্ষের সাবেক রাজধানীকে। কলকাতার বাইরের অবস্থা আরও খারাপ, উত্তর-দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা ধ্বংস হয়ে গেছে, মারা গেছে প্রায় ৭৫ জন। রাজ্যজুড়ে শুরু হয়েছে হাহাকার, সরকার ত্রাণ দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছে না, করোনার প্রকোপের মধ্যেই এই ঘূর্ণিঝড়ের আক্রমণে বেসামাল হয়ে পড়েছে গোটা পশ্চিমবঙ্গ।
বাংলার এক প্রান্ত যখন অসহায়, দিশাহারা- তখন অন্য প্রান্ত তো চুপ করে বসে থাকতে পারে না। করোনার কারণে খুব বেশি কিছু করার উপায় নেই, কিন্ত ভালোবাসাটা তো জানানো যায়, সেটাই জানাচ্ছেন এপার বাংলার মানুষ। ক্রিকেটার, অভিনয় শিল্পী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ- সবাই পশ্চিমবঙ্গের এই বিপদে সহমর্মী, অজস্র মানুষের হৃদয় কাঁদছে বাংলারই আরেক অংশের এহেন বিপদে। ফেসবুকে অনেকেই লিখছেন কলকাতা নিয়ে, সাহস দিচ্ছেন তাদের ওপারের বন্ধুদের, প্রিয়জনের বিপদে বা স্বজনবিয়োগে আমরা যেভাবে পাশে দাঁড়াই, কাঁধে হাত রেখে স্বান্তনা দেই, ঠিক সেভাবেই পশ্চিমবঙ্গের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন বাংলাদেশের মানুষ।
কিছু মানুষের মধ্যে ভারত নিয়ে, কলকাতা নিয়ে অ্যালার্জি থাকে, আছে। আবার ওপারের অনেককেও দেখেছি বাংলাদেশকে নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে। কিন্ত এদের সংখ্যাটা কম, হাতে গুণে শেষ করে ফেলা যাবে। দিনশেষে আমরা যারা ভালোবাসা বিলিয়ে যাই, তারাই পাল্লায় ভারী। আমরা বাংলায় ভেদাভেদ দেখি না, কাঁটাতারের বেড়া আমাদের আলাদা করতে পারে না, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল বা সত্যজিত-ঋতিক ঘটক যতটা ওপারের, ঠিক ততটাই আমাদের। ধর্মের নামে বাংলার মাঝখানটা নাহয় চিরে ফেলেছিলেন র্যাডক্লিফ, এই অফুরান ভালোবাসাকে ভাগ করার ক্ষমতা তো তার ছিল না, কারো নেই...
অত্রিক অর্ডার করতে হবে এই লিংকে
কারো যদি ইনস্ট্রাকশন বুঝতে অসুবিধে হয়, সরাসরি লাইটারের ফেসবুক পেজের ইনবক্সে নক করলেই হবে।