কথায় নয়, বাংলাদেশ এখন কাজে প্রমাণের নীতিতে বিশ্বাসী
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
অমিত শাহ বাংলাদেশীদের বলেছিলেন উইপোকা। ভারতের আরেক মন্ত্রী জি কিষাণ রেড্ডি বলেছিলেন, ভারতীয় নাগরিকত্বের অফার দিলে নাকি অর্ধেক বাংলাদেশ খালি হয়ে যাবে! সেই বাংলাদেশ মাথাপিছু আয়, জিডিপির প্রবৃদ্ধি, হাঙ্গার ইনডেস্ক, জেন্ডার ইকুয়ালিটি, নারী শিক্ষা- সব মানদণ্ডে ভারতকে পেছনে ফেলে দিয়েছে!
ফেব্রুয়ারী ২০২০, ভারতে তখন নাগরিকত্ব সংশোধন আইন নিয়ে আন্দোলন চলছে। ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জি কিষাণ রেড্ডি তখন বলেছিলেন, "আমরা যদি বাংলাদেশীদের নাগরিকত্ব দেয়া শুরু করি, তাহলে অর্ধেক বাংলাদেশ খালি হয়ে যাবে!" তার কথার সঙ্গে সুর মিলিয়েছিলেন ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দল বিজেপির তৎকালীন অধ্যক্ষ অমিত শাহ। তিনি বলেছিলেন- "বাংলাদেশী অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা সারা ভারতে উইপোকার মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে।" আর পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয় তো কটুক্তি করেই বলেছিলেন, "সকালের নাস্তায় কে কি খাচ্ছে, সেটা দেখেই বাংলাদেশীদের চেনা যায়। গরীব না হলে কেউ চিড়ে খায়?" যে কোন কারনেই হোক, বিজয়বর্গীয়ের ধারনা হয়েছিল, বাংলাদেশের লোকজনের সকালের জাতীয় নাস্তা বোধহয় চিড়েভাজা।
এখন অক্টোবর চলছে, আট মাস কেটে গেছে সেসব আলটপকা মন্তব্যের পর। আট মাস পরে এসে দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় অনেক নাগরিকের চিড়ে খাওয়ার সামর্থ্যটাও বাকি রাখেনি ভারত সরকার, দেশটার অর্থনৈতিক অবস্থার এতই অবনতি হয়েছে যে, মাথাপিছু আয়, জিডিপির প্রবৃদ্ধি, গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেস্ক, জেন্ডার ইকুইলিটি ইনডেস্ক সহ প্রায় সব মানদণ্ডেই বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে তারা। করোনার এই দুঃসময়েও বাংলাদেশ যেখানে জিডিপিতে ধনাত্মক প্রবৃদ্ধির হার ধরে রেখেছে, ভারতের বেলায় সেটা নেমে গেছে তলানীতে।
জি কিষাণ রেড্ডিকে এখন আমরা চাইলে বলতেই পারি, বাংলাদেশ যদি ভারতীয়দের নাগরিকত্বের অফার দেয়, তাহলে অর্ধেক ভারত ফাঁকা হয়ে যেতে পারে। কিন্ত যেহেতু আমরা বয়ানবাজীতে বিশ্বাসী নই, তাই অর্জনের মাধ্যমে নিজেদের সামর্থ্যের প্রমাণ দেয়াটাই আমাদের কাজ।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিক আইএমএফের বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ পেয়েছে কয়েকদিন আগেই। সংস্থাটি জানিয়েছে, মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদনের দিক থেকে এবছর ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির দেশ ভারতকে ছাপিয়ে যাবে বাংলাদেশ। ২০২১ সালের মার্চ মাস নাগাদ ভারতের মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদন দাঁড়াবে ১৮৭৭ ডলার, আর বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদন হবে ১৮৮৮ ডলার। ২০১৫ সালেও ভারতের মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি ছিল। সেই অবস্থান থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে তাদেরকে পেছনে ফেলাটা চাট্টেখানি অর্জন নয়।
অনেকেই বলবেন, জিডিপির নম্বর দিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা পাওয়া সম্ভব নয়, হ্যাঁ, সেটা সত্যি কথা। আবার এটাও তো সত্যি যে, একটা দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পরিমাপের সবচেয়ে বড় এককগুলোর একটি হচ্ছে এই জিডিপি। আর সেই নিক্তিতে ভারতের মতো ট্রিলিয়ন ডলার ইকোনমির দেশকে পেছনে ফেলে দেয়াটা অবশ্যই বলার মতো অর্জন। বাংলাদেশ যে শুধু ভারতকে পেছনে ফেলেছে, তা তো নয়, এই বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির দিক দিয়ে শীর্ষ তিনে আছি আমরা, এটাকে অবজ্ঞা করার কিছু নেই। করোনার কারনে যখন পরাশক্তি দেশগুলোর অর্থনীতিও চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে, তখনও আমরা প্রবৃদ্ধির গতিশীলতা ধরে রাখতে পেরেছি।
ভারতকে দিয়েই যেহেতু লেখার শুরুটা করেছি, তাই বাংলাদেশ ও ভারতের তুলনাতেই থাকি। কিষাণ রেড্ডি যে বললেন তারা নাগরিকত্ব অফার করলে অর্ধেক বাংলাদেশী ভারতে চলে যাবেন, কিংবা অমিত শাহ জানালেন, 'বাংলাদেশী অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা' পুরো ভারতে উইপোকার মতো ছড়িয়ে আছে, সেই ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন মানদণ্ডে বাংলাদেশের পার্থক্য আসলে কতটা, সেটা এই লোকগুলো জানে না। রাজনৈতিক বয়ানবাজী শুরু করলে মুখে অনেক কিছুই চলে আসে, একারনে যা নয় তাই বলে ফেলা যায়। বিজেপির এই মন্ত্রী আর নেতাদের বেলায়ও একই ঘটনা ঘটেছে।
সরাসরি যদি তুলনা করতে যাই, তাহলে দেখা যাবে, নারী শিক্ষার হার ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে বেশি। নারীদের মধ্যে সন্তান গ্রহণের হারে আবার ভারতীয়রা এগিয়ে, যেটা নেগেটিভ পয়েন্ট। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে বেকারত্বের হার কম, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাও কম ঘটে। গ্লোবাল পিস ইনডেক্সে ভারতের অবস্থান যেখানে প্রায় দুইশো দেশের মধ্যে ১৩৯ তম, সেখানে বাংলাদেশ আছে ৯৭ নম্বর অবস্থানে। সম্প্রতি চীনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় চীনা বিনিয়োগকারীদের অনেকেই ভারত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, ফলে বিপাকে পড়েছে ভারতীয় অনেক প্রতিষ্ঠান। তাছাড়া মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতের অর্থনীতি ধুঁকছে। এসব ব্যাপার ভূমিকা রেখেছে ভারতের অবনমন আর বাংলাদেশের ঊর্ধ্বগমনে।
গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেস্কের র্যাংকিং প্রকাশিত হয়েছে দু'দিন আগে। সেখানে বাংলাদেশের অনেকটা নিচে অবস্থান করছে ভারত। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এই তালিকায় ভারতের নিচে আছে শুধু পাকিস্তান। এটা ভেবেই অবশ্য মোদি সরকার বগল বাজাতে পারে, পাকিস্তানকে তো অন্তত পেছনে ফেলা গেছে! শিশুমৃত্যুর হার ভারতে প্রতি হাজারে ৮৮, বাংলাদেশে ৮৪। মুসলিম প্রধান এবং স্বল্পোন্নত দেশ হবার পরেও জেন্ডার ইকুয়ালিটি ইনডেক্সে ভারতকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। ভারতের মানুষের গড় আয়ু ৬৯ বছর, বাংলাদেশের মানুষ গে ৭২ বছর বাঁচে।
বাংলাদেশ সরকার প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত সব শ্রেনীর শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে বই দেয়। ভারতে শুধু সরকারী স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা বই পায়, বাকিদের কিনে নিতে হয়। ৮ই মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী সনাক্ত হবার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চটজলদি মুজিববর্ষের প্রায় সব পরিকল্পনা স্থগিত করেছেন নিরাপত্তার কারনে। সেখানে ভারত সরকার সংখ্যাগুরুদের তুষ্ট করতে রামমন্দিরের ভূমিপূজার আয়োজন করছে। ভঙ্গুর অর্থনীতি উদ্ধারের উদ্যোগ না নিয়ে নরেন্দ্র মোদি গিয়ে মন্দিরের শিলাবিন্যাস স্থাপন করছেন, অর্থাৎ অর্থনীতির চাইতে ধর্মের নামে ভোটের রাজনীতিটা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ যে সব সমীক্ষায় ভারতকে পেছনে ফেলবে- এতে আর অবাক হবার কি আছে!
গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের অর্থনীতির সূচক ঊর্ধ্বমুখী। মাথাপিছু আয় এবং জিডিপি বাড়ছে ক্রমশ, বাড়ছে ধনীর সংখ্যাও। সেটার সুফল সাধারন মানুষের গায়ে পুরোপুরি না লাগলেও, অর্থনীতি পরিমাপের সূচকগুলোতে বাংলাদেশ ওপরের দিকেই উঠছে ধীরে ধীরে। এই করোনাকালে গোটা বিশ্ব যখন থমকে আছে, তখনও বাংলাদেশে বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ রেকর্ড করেছে প্রতি মাসেই।
গত ১০/১২ বছরে দেশের অর্থনীতি বেড়েছে কয়েকগুণ, নির্মাণ হয়েছে/হচ্ছে বড় বড় অবকাঠামো। রাজনৈতিক গোলযোগ বা হরতাল-অবরোধ না থাকায় ব্যবসা সম্প্রসারিত হচ্ছে, বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ছে। চীন এবং ভারত বড় অংকের টাকা বিনিয়োগ করেছে বিভিন্ন প্রকল্পে। এখনও দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, দুর্বল অবকাঠামো, বাজার নিয়ন্ত্রণের মতো অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তবুও বাংলাদেশ তার আপন গতিতে উন্নতি করে যাচ্ছে প্রত্যেকটি খাতে। গার্মেন্টস খাতে নানা সময়ে আঘাত এলেও এটির ওপর ভর করেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। নির্মাণ এবং ঔষধ শিল্প বিকশিত হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে সুনামও কুড়িয়েছে।
একটা সময় বাংলাদেশের রাজনীতি ছিল পুরোপুরি ভারতকেন্দ্রীক, এলাকার মোড়ল হওয়ায় ভারতও বাংলাদেশের ওপর অযথা দাদাগিরি করেছে যুগের পর যুগ ধরে, নিজেদের সুবিধা আদায় করে নিয়েছে, আমাদের কপালে জুটেছে কাঁচকলা। এখন আর সেই দিন নেই। ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এখন বারবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চেয়েও পান না। বাংলাদেশ এখন ভারতের ছায়া থেকে বেরিয়ে সবার বন্ধু হবার পথ বেছে নিয়েছে। ভারতের শত্রু চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক দৃঢ় হচ্ছে, চীনা প্রকল্প বাড়ছে দেশে, অর্থনীতিও গতিশীল হচ্ছে আরও।
যে আমেরিকা এককালে বাংলাদেশকে 'তলাবিহীন ঝুড়ি' বলতো, সেই আমেরিকাও এখন বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক গড়ার জন্য মুখিয়ে থাকে, তাদের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসে বাংলাদেশের পাশে থাকার বার্তা দেন, বাংলাদেশকে পাশে পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন! যে ভারত বাংলাদেশকে বরাবরই অবহেলা করে এসেছে, ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করেছে, সেই দেশটাই এখন আমাদের তোয়াজ করার জন্য আকস্মিকভাবে তাদের পররাষ্ট্র সচিবকে কোন আগাম সংকেত না দিয়ে বাংলাদেশ সফরে পাঠায়, তিনি এসে যাতে বাংলাদেশের অভিমান দূর করতে পারেন, বাংলাদেশ যেন ভারতকে ছেড়ে চীনা বলয়ে ঢুকে না যায়। ভারত বুঝে গেছে, বাংলাদেশ এখন আর কারো হাতের পুতুল হয়ে থাকার অবস্থায় নেই।
দিন বদলে গেছে, বদলেছে বাংলাদেশ, বদলেছে আমাদের কৌশল, নীতি। আমরা এখন কারো সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হই না, বরং নিজেদের ছাপিয়ে যাওয়ার মিশনে নামি। তাতেই একশো ত্রিশ কোটি মানুষের দেশটাও আমাদের পেছনে পড়ে যায়। পেছনে পড়ে থাকে আমাদের নিয়ে করা সেদেশের মন্ত্রী আর রাজনৈতিক নেতাদের বক্রোক্তিগুলোও। এগিয়ে যাওয়ার চিন্তায় আমরা এত বেশি মশগুল যে, এসব মন্তব্য নিয়ে ভাবার বা এসবের পাল্টা জবাব দেয়ার সময়টাও নেই। বাংলাদেশের হয়ে জবাব দিচ্ছে আমাদের অর্জন, অর্থনীতিক সূচকগুলোতে আমাদের ঊর্ধ্বগমন। আমরা কথায় নয়, কাজে প্রমাণের নীতিতে বিশ্বাসী...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন