পশুও তো তার নিজের জন্মইতিহাস অস্বীকার করার মত নির্লজ্জ হতে পারে না, আপনি নিশ্চয়ই পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট নির্লজ্জ না, তাই না?

বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান কী, তাকে কেন জাতির জনক বলা হয় ইত্যাদি নানা প্রশ্ন করে থাকেন অনেকেই। অনেকে আবার পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে গলা মিলিয়ে বলেন, এই হিন্দুস্তানের দালাল শেখ মুজিবই সবকিছুর জন্য দায়ী।

আপনারা কি জানেন, পৃথিবীর বুকে যে দেশের নাম উচ্চারণ করে, যে দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিয়ে বুক ফুলিয়ে চলেন, সেই জন্মভূমির নাম “বাংলাদেশ” কে রেখেছিলেন? চলেন আপনাদের তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক! প্রখ্যাত মনীষী ও বিখ্যাত সাহিত্যিক শ্রী অন্নদাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সেই সাক্ষাৎকারটা সম্পর্কে জেনে আসা যাক আগে।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত আলাপচারিতা ছিল। ছিল হৃদ্যতাও। অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তার সাক্ষাৎকারের ঘটনাটা: “শেখ সাহেবকে আমরা প্রশ্ন করি, ‘বাংলাদেশের আইডিয়াটা প্রথম কবে আপনার মাথায় এলো?’ -‘শুনবেন?’ বলে তিনি (বঙ্গবন্ধু) মুচকি হেসে বলেন, সেটা ১৯৪৭ সাল। তখন আমি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের দলে। তিনি ও শরৎচন্দ্র বসু চান যুক্তবঙ্গ। আমিও চাই সব বাঙালির এক দেশ। বাঙালিরা এক হলে কী না করতে পারত। তারা জগৎ জয় করতে পারত। 

বলতে বলতে তিনি উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন। তারপর বিমর্ষ হয়ে বলেন, ‘দিল্লি থেকে খালি হাতে ফিরে এলেন সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বোস। কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ কেউ রাজি নয় তাদের প্রস্তাবে। তারা হাল ছেড়ে দেন। আমিও দেখি যে আর কোনো উপায় নেই। ঢাকায় চলে এসে নতুন করে আরম্ভ করি। তখনকার মতো পাকিস্তান মেনে নিই। কিন্তু আমার সূত্র কেমন করে পূর্ণ হবে এই আমার চিন্তা। হবার কোনো সম্ভাবনাও ছিল না। লোকগুলি যা কমিউনাল! বাংলাদেশ চাই বললে সন্দেহ করত।

হঠাৎ একদিন রব উঠল, আমরা চাই বাংলা ভাষা। আমিও ভিড়ে যাই ভাষা আন্দোলনে। ভাষাভিত্তিক আন্দোলনকেই একটু একটু করে রূপ দিই দেশভিত্তিক আন্দোলনে। পরে এমন একদিন আসে যেদিন আমি আমার দলের লোকদের জিজ্ঞাসা করি, আমাদের দেশের নাম কী হবে? কেউ বলে পাক-বাংলা। কেউ বলে পূর্ণ বাংলা। আমি বলি, না বাংলাদেশ। তারপর আমি স্লোগান দিই, জয় বাংলা।

…আসলে ওরা আমাকে বুঝতে পারে নাই। জয় বাংলা বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছিলাম বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জয়। যা সম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে।” 

সবসময় সম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু

১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীতে আয়োজিত এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতা দেবার সময় ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ ঘোষণা করেন, “একসময় এদেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। একমাত্র ‘বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কোন কিছুর নামের সঙ্গে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি- আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র বাংলাদেশ।” 

সেই থেকে এই জমিনের নাম বাংলাদেশ! আজকে আপনারা যারা সেই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে স্বাধীন আলো-হাওয়ায় শ্বাস নিয়ে মাথা উঁচু করে বেশ উঁচু গলায় বলেন যে, বঙ্গবন্ধুর দেশ স্বাধীনে অবদানটা কী? কী কচুটা করছে সে, আপনাদের সদয় অবগতির জন্য জানাই, এই মানুষটা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই ‘৪৭ সালেই, যখন সবাই পাকিস্তান হবার আনন্দে বিভোর ছিল। এই মানুষটা একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জন্য জীবনের সাড়ে ১২ বছর স্রেফ জেলেই ছিলেন, বেশিরভাগ সময় জেল থেকে বেরিয়েই সরাসরি রাজপথের আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন মানুষটা, একটু পর সেই আন্দোলন থেকেই আবার গ্রেফতার হয়েছেন। প্রতিবারই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল রাজপথের অবিচল আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার সময়, বর্তমান সময়ের তথাকথিত নেতাদের মত লুকিয়ে-পালিয়ে থাকা গর্ত থেকে না। 

বঙ্গবন্ধুর মত একজন নেতা পায়নি বলেই আজো ফিলিস্তিন, বেলুচিস্তান স্বাধীন হতে পারেনি, আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম মাত্র নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামে, কিন্তু এর পেছনে ছিল একজন শেখ মুজিবের দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে তার স্বাধীনতাকামী জনগণকে নিয়ে অবিশ্রান্ত আন্দোলন-সংগ্রামের বীরত্বগাঁথা! এই দীর্ঘ সময়টায় ছয় ফুট লম্বা দীর্ঘদেহী ঋজু মানুষটা সামনে থেকে তার মুক্তিপাগল জনতাকে প্রবল পরাক্রমে নেতৃত্ব দিয়ে একটু একটু করে এনেছিলেন স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে, উদ্ভুদ্ধ করেছিলেন সবকিছু বাজি রেখে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে, হাসতে হাসতে প্রাণ দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনতে। 

এই ২৪ বছরের দীর্ঘ সংগ্রামে একজন সাধারণ শেখ মুজিব থেকে তিনি পরিণত হয়েছিলেন বঙ্গের বন্ধুতে, এই উপাধি দিয়েছিল তাকে তার জনগণ, তার “মানুষ”, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পাবার পর ১৯৬৯ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি এক বিশাল সংবর্ধনায়, পরম ভালোবেসে! তার ”৪৭-৭১” এর এই ২৪ বছরের পুরো সময়টাতেই প্রত্যেকটা মিছিলের সামনে সবচেয়ে উঁচু মাথাটা সবসময়ই ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের।

এ লিডার লিডিং ফ্রম দ্য ফ্রন্ট, অলওয়েজ! এরপর থেকে যখন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিয়ে কোথাও এই দেশের স্বাধীনতায় বঙ্গবন্ধুর অবদান নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন, মনে রাখবেন বাংলাদেশ নামটা বঙ্গবন্ধুর দেওয়া! পশুও তো তার নিজের জন্মইতিহাস অস্বীকার করার মত নির্লজ্জ হতে পারে না, আপনি নিশ্চয়ই পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট নির্লজ্জ না, তাই না?

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা