বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙিয়ে এই তেলবাজি আর কত দিন চলবে?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
এই তেলবাজদের লাই দিলে বঙ্গবন্ধু নামটাকে যে এরা কিছুদিন পরে হাসির বস্তুতে পরিণত করে ছাড়বে, সেটা সবার বোঝা উচিত।
অক্ষয় কুমারের একটা সিনেমা দেখেছিলাম অনেকদিন আগে। ভিলেন এক প্রভাবশালী নেতা, তার জন্মদিনের অনুষ্ঠান থেকে তাকে অপহরণ করবেন অক্ষয়। কিন্ত পুলিশ আর শত শত কর্মীর মাঝখান থেকে সেই নেতাকে তুলে নিয়ে আসা তো সহজ কথা নয়। সিনেমায় দেখা গেল, নেতার মুখের আদলে তৈরি মুখোশ পরে তার জন্মদিন পালন করছে সবাই, সবার এক চেহারা, সেখান থেকে নির্বিঘ্নে সেই ভিলেনকে অপহরণও করে নিয়ে আসা হলো।
সিনেমার পর্দার জন্যে ব্যাপারটা মানানসই। কিন্ত বাস্তবে এমন কোন দৃশ্য দেখতে হবে, সেটা কল্পনায় ছিল না। সকাল থেকে ফেসবুকের নিউজফিডে একটা ছবি ঘুরছে, স্কার্ফ পরিহিত একদল শিশু বঙ্গবন্ধুর মুখের আদলে তৈরী মুখোশ পরে দাঁড়িয়ে আছে সারি বেঁধে, শত শত বঙ্গবন্ধুর মিলনমেলা লেগেছে যেন। পত্রিকার ক্যাপশন মারফত জানা গেল, বগুড়ার পুলিশ লাইন্স স্কুল এন্ড কলেজের নবনির্মিত ভবন উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, সেখানেই শিক্ষার্থীদের মুখে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির মুখোশ চাপিয়ে দিয়ে স্বাগত জানানো হয়েছে শিক্ষামন্ত্রীকে।
২০২০ সাল চলছে, এই বছরটার নামই মুজিব বর্ষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মের একশো বছর পূর্ণ হবে এমাসেই, সরকারী আর বেসরকারী পর্যায়ে নানা আয়োজন হাতে নেয়া হয়েছে ব্যক্তি পর্যায়েও লোকজন বঙ্গবন্ধুর নাম করে তেল মারতে বাকী রাখছে না। সেটারই একটা নির্লজ্জ নমুনা দেখা গেল বগুড়ায়। এই মুখোশগুলোর গন্তব্য কোথাউ? নিশ্চয়ই ময়লার ভাগাড়ে, কিংবা পায়ের নিচে? ময়লার স্তুপের মাঝে জাতির জনকের ছবি পড়ে আছে, এটা যে আমাদের জন্যে কত লজ্জার একটা বিষয়, সেটা যদি এই তেলবাজেরা বুঝতো!
স্কুলের কচি ছেলে-মেয়েদের মুখে বঙ্গবন্ধুর মুখোশ চাপিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নামটাকে হাস্যকর একটা পর্যায়ে নামিয়ে আনার এই পরিকল্পনাটা কার মাথা থেকে বেরিয়েছে, তাকে খুঁজে বের করা দরকার। তার মাথা থেকে মগজটা বের করে সেটা জাদুঘরে সাজিয়ে প্রদর্শনী করা উচিত। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে ঢোকানোর চেষ্টা নেই কারো মধ্যে, পড়ে আছে মুখের ওপরে মুখোশ চাপিয়ে দেয়ার মিশনে। এতই যদি বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা থাকে, অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটা ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিলি করা যেতো না? সবার হাতে অসমাপ্ত আত্মজীবনী তুলে দিয়ে সেটার ছবি তোলা যেতো না? দুই মিনিটের জন্যে বঙ্গবন্ধুর ছবিওয়ালা মুখোশটা পরলেই সবাই দেশপ্রেমিক, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে যাবে?
সবচেয়ে বিরক্ত লেগেছে, দীপু মনির সামনে এই ঘটনাটা ঘটেছে শুনে। আওয়ামী লীগের সবচেয়ে সেন্সিবল নেতাদের তালিকা করা হলে সেখানে দীপু মনির নামটা সবার ওপরের দিকেই থাকবে, বেঁফাস কথাবার্তা বা লাগামহীন আচরণ তিনি কখনোই করেন না, সেগুলো বরদাশতও করেন না। তার চোখের সামনে 'সম্মান' জানানোর নাম করে বঙ্গবন্ধুকে কৌতুকের বস্তুতে পরিণত করেছে কিছু লোক, বাচ্চাদের মুখে তুলে দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর চেহারার আদলে তৈরী মুখোশ- জানি না এই ব্যাপারে তিনি কোন ব্যবস্থা নেয়ার কথা ভেবেছেন কিনা। এই তেলবাজদের লাই দিলে বঙ্গবন্ধু নামটাকে যে এরা কিছুদিন পরে হাসির বস্তুতে পরিণত করে ছাড়বে, সেটা দীপু মনির বোঝা উচিত।
তেলবাজির শেষ এখানেই নয়। রন্ধন বিশারদ কেকা ফেরদৌসি এবারের বইমেলায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আস্ত একটা বই-ই লিখে ফেলেছেন, সেটার নাম বঙ্গবন্ধুর প্রিয় খাবার! ভাত, খিচুড়ি, মাছের চচ্চড়ি আর পিঠার মাঝখানে বঙ্গন্ধুর ছবিটা শোভা পাচ্ছে- বইয়ের কভারটা ঠিক এরকম। এই বই লেখার উদ্দেশ্য সম্পর্কে কারো কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়, আমারও নেই।
২০২০ সালে এসে নতুন প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে জানতে চায়, তার জেলজীবন, তার মূল্যবোধ, তার অসাম্প্রদায়িক ভাবনা, বাঙালি জাতির জন্যে বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ- এসবের বিস্তারিত জানতে চায়। বঙ্গবন্ধু পুঁটি মাছ পছন্দ করতেন নাকি শোল মাছ, তিনি পায়েস ভালোবাসতেন নাকি সেমাই- সেসব জানার আগ্রহ কারো নেই। কারো যদি জানানোর আগ্রহ থেকে থাকে, তবে সেই আগ্রহের পেছনের উদ্দেশ্যটা পরিপূর্ণভাবে ব্যবসায়িক, অন্য কিছুই নয়। কেকা ফেরদৌসির কাছে অন্তত এমন কিছু প্রত্যাশা ছিল না। তিনি নুডলস দিয়েই বাঙালি জাতিকে বিব্রত করবেন ভেবে রেখেছিলাম, বঙ্গবন্ধুকেও যে নিজের সাবজেক্ট হিসেবে বেছে নেবেন- এমনটা ধারণায় ছিল না।
পঁচাত্তরে সপরিবারে খুন হবার পরে এই বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নামটাও উচ্চারণ করা যেতো না। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারী করে খুনিদের রেহাই দেয়া হয়েছিল। সেসবের প্রতিবাদ যারা তখন করেছিলেন, তাদের কাউকে এখন পাওয়া যায় না। তারা আড়ালে চলে গেছেন। চারপাশে এখন তেলবাজের দল বিদ্যমান শুধু। আওয়ামী লীগ প্রায় একযুগ ধরে ক্ষমতায়, বঙ্গবন্ধু এখন বিশাল একটা ব্র্যান্ড, অনেকের কাছে ব্যবসার সবচেয়ে বড় মাধ্যম। জন্মশতবার্ষিকীর এই সময়টায় সবাই তাই বঙ্গবন্ধুকে ব্যবহার করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিতে চাইছে। তাতে কষ্ট যদি কেউ পেয়ে থাকেন, বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত সমর্থকেরাই পাবেন, কারণ তারা কখনও বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙিয়ে খেতে শেখেননি...