বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সিনেমা বানানোর ব্যাপারটি খুব আশাব্যঞ্জক ছিলো। তাই বলে শেখ হাসিনার চরিত্রে নুসরাত ফারিয়া? এটাও দেখার বাকী ছিলো!

বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করার গুঞ্জনে আরিফিন শুভকে নিয়ে যখন আলোচনা-সমালোচনা চলছিলো তখনও আশা করেছিলাম অন্তত সিনেমাটা প্রোডাকশনে গেলে হয়তো ভালো কিছুই হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে নিয়ে সিরিয়াসলি একটা সিনেমা বানানো হবে- কী দারুণ উদ্যোগ! আজকে প্রকাশ করা হলো সেই সিনেমার ৫০ জনের অভিনয় শিল্পীর তালিকা। কিছু কাস্টিং খুব সুন্দর হয়েছে, বাকীগুলো দেখে মনে হলো জোর করে লিস্ট করবার চেষ্টা। সরকারঘেঁষা সিন্ডিকেট বা লবিং যা-ই বলি না কেন, ব্যাপারটা যে শুধু মেধার বিচারে হচ্ছে না, সেটা তালিকা দেখলেই বোঝা যাচ্ছে।  

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফডিসি) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করবেন চিত্রনায়ক আরিফিন শুভ। নুসরাত ইমরোজ তিশা করবেন বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা চরিত্রে এবং শেখ হাসিনার চরিত্রে অভিনয় করবেন নুসরাত ফারিয়া। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী সিনেমাটার নাম নির্ধারণ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু’।

'বঙ্গবন্ধু' সিনেমার শুটিং সেটের ছবি 

বাকী উল্লেখযোগ্য চরিত্রে অভিনয় করবেন দেশের জনপ্রিয় এবং খ্যাতিমান অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। রাইসুল ইসলাম আসাদ অভিনয় করবেন আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর চরিত্রে, সায়েম সামাদ করছেন সৈয়দ নজরুল ইসলামের চরিত্র, চিত্রনায়ক ফেরদৌস করছেন তাজউদ্দিন আহমেদ, শহীদুল আলম সাচ্চু করছেন এ কে ফজলুল হক, সমু চৌধুরী করছেন কামরুজ্জামান, খলিলুর রহমান কাদেরী করছেন মনসুর আলী, তৌকির আহমেদ করছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং ফজলুর রহমান বাবু করছেন খন্দকার মোশতাক আহমেদের চরিত্রে। সিয়াম আহমেদ অভিনয় করবেন বঙ্গবন্ধুর চাচা শওকত মিয়ার ভূমিকায় এবং মিশা সওদাগর করছেন জেনারেল আইয়ুব খানের চরিত্র।

বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকের আর্টিস্টদের তালিকার প্রথম ৩৪ জন

এই লিস্টে যেমন প্রতিভাবান শিল্পীর নাম রয়েছে, তেমনি কিছু শিল্পীকে মেনে নেয়া যাচ্ছে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চরিত্রে কোনোভাবেই নুসরাত ফারিয়াকে মেনে নেয়া যাচ্ছে না। তার যে গ্ল্যামারাস ইমেজ, সেটা তিনি ভাঙতে পারবেন কিনা সেই প্রশ্নটা ঘুরেফিরে দর্শকদের মনে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। নুসরাত ফারিয়া বিতার্কিক ছিলেন, মানে কি এটাই প্রমাণ করে দেয় যে শুধু তিনিই এ চরিত্রটার জন্য উপযুক্ত? যেকোনো বয়সের শেখ হাসিনার চরিত্রটা ফুটিয়ে তোলার জন্য যে পরিমাণ মেধাবী অভিনেত্রী হওয়া দরকার, তার ধারে কাছের কেউ নেই কাস্টিং এ। তিক্ত হলেও সত্য।

এদিকে বঙ্গতাজের চরিত্রায়ন করবেন ফেরদৌস। এমন একটা ডায়নামিক ক্যারেক্টার উনার চায়ের কাপ কিনা সেটাও ভেবে দেখা উচিত ছিলো। ক্যারেক্টার ব্রেকিং রোলে ফারিয়া কিংবা ফেরদৌস কারোই তেমন অভিজ্ঞতা নেই। তারা নিজেদের ভেঙে গড়েও দেখাননি কখনও। তাই এক লাফেই তারা ক্যারাক্টার আর্টিস্ট হয়ে যাবেন- এটা অন্তত মেনে নেয়া যাচ্ছে না। কোনও সিরিয়াস মেথড এক্টরকে দিয়ে করানো উচিত ছিলো এই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলো।

ফুজলুর রহমান বাবুর চরিত্রায়ন বেশ ভালো হবে বলে মনে হচ্ছে। চাটুকার-বেইমান খন্দকার মোশতাককে তিনি খুব ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারবেন। নুসরাত ইমরোজ তিশা একজন ভালো অভিনেত্রী। এছাড়া রাইসুল ইসলাম আসাদের উপস্থিতিও আশা জাগাচ্ছে। জাতীয় চার নেতা, শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী কিংবা স্বৈরাচারী আইয়ুব খানদের মতো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলো উক্ত অভিনেতারা সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারবেন কিনা সেটা নিয়ে শঙ্কিত হওয়া ছাড়া উপায় দেখছি না আপাতত। সবাইকে নাকি অডিশনের মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হয়েছে। এই যদি হয় অডিশনের অবস্থা, তবে আর কিছু বলার রুচি হচ্ছে না।

বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকের আর্টিস্টদের তালিকার বাকী ১৬ জন 

ঠিক বুঝতে পারছি না, ভারতের সাথে যদি যৌথ প্রযোজনায় এই সিনামাটা বানাতেই হবে তাহলে আরও ভালো পরিচালক বা ক্রিয়েটিভ টিম কেন নেয়া হলো না? এর চাইতে ভালো কি করা যেত না? শ্যাম বেনেগালের থেকে ভালো পরিচালক বলিউডে ছিলো না? ভালো কাস্টিং ডিরেক্টর ছিলো না? নাকি সবই লবিং এর খেলা? 

জাতির জনককে নিয়ে বানানো সিনেমাতেই যদি এতো উদাসীন হয়ে যায় সংশ্লিষ্টরা, তাদের কাছে থেকে ভালো কাজ আশা করি কিভাবে? মেনেই নিলাম আমাদের আন্তর্জাতিক মানের সিনেমা বানানোর মতো টেকনিকাল ম্যাচুরিটি এখনও আসেনি। তাই বলে যখন আউটসোর্সিং করবো, একটুও কি ভেবে চিনতে করবো না? নাকি মুজিববর্ষ উপলিক্ষ্যে একটা সিনেমা বানানো দরকার তাই সে দায় মেটানো হচ্ছে স্রেফ। 

বিএফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুজহাত ইয়াসিমিন সাক্ষরিত গেজেট

গনমাধ্যমসূত্রে জানা গেছে, এই বায়োপিকে উঠে আসবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় থেকে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নির্মম ট্র্যাজেডি। তারুণ্য থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং পরবর্তী সময়ের মুজিবের দেখা মিলবে এই সিনেমায়। বাংলাদেশের ইতিহাসের এতো গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট নিয়ে কাজ করতে গেলে যে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত তারা কি সেটা দায়িত্ব নিয়ে করছেন? নাকি সবই বঙ্গবন্ধু নামে তেলবাজি আর হরিলুটের বাহার? ৩৫ কোটি টাকার বাজেট কি শুধুই লোক দেখানো?  

বঙ্গবন্ধু শুধুই জাতির জনক কিংবা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিতা নন। তিনি সবকিছু ছাপিয়ে এক শব্দে বাংলাদেশের অনুভূতির নাম। যে ইতিহাস তিনি সৃষ্টি করে গেছেন, সেটা প্রচারের জন্য কোনও তেলবাজির প্রয়োজন হয় না। দরকার শুরু একটু স্বদিচ্ছার। এবং সেই স্বদিচ্ছা থেকে যদি সিনেমটা বানানো হয় তবে অবশ্যই স্বাগতম জানাই। সিনেমা বানানোর নামে যদি শুধু আই ওয়াশই করা হবে তবে এর চাইতে না বানানোই বোধ হয় ভালো ছিলো। বাকিটা সিনেমাই বলে দেবে। অপেক্ষায় রইলাম।

 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা