কেমন হয় একজন মানুষের বান্দরবান ভ্রমণ? একা একা পাহাড়ি এই জনপদ থেকে ঘুরে আসা কি আসলেই অসম্ভব?
ইমন খান: যেখানে যার কাছেই গিয়েছি, একা ভ্রমণের ব্যাপারে সবাই মোটামুটি নিরুৎসাহিত করেছিল। খরচ, ঝুঁকিসহ আরো অন্যান্য বিষয় ছিল যা আসলেই অগ্রাহ্য করার মতো না। গেল পৌষে বেদের মেয়ে জোসনার ফাঁকিবাজির কারণে জীবন যখন দুর্বিষহ, তখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলি- যেতেই হবে এবার পাহাড়ে। কিন্তু বিধি বাম! সাথে যাবার মত কাউকেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অফিসের ছুটিও পেয়েছি এমন সময়ে, যা কিনা যারা ঘুরতে যায়, তাদের ছুটির সাথে খুব একটা ম্যাচ করে না। কিন্তু এবার বের হতেই হবে- এই পণে যাত্রা শুরু করলাম। কোন প্ল্যান ছিল না, কিছুই জানা ছিল না, একেবারেই প্রথমবারের যাত্রা ছিল বান্দরবানের বুকের গহীনে।
সকালে বান্দরবান শহরে প্রবেশের পরও বুঝতে পারছিলাম না যে কী করবো! খুব ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলাম প্রথমে রুমা যাব। যেহেতু একা মানুষ ছিলাম, তাই জীপ ভাড়া করাটা অসম্ভব ছিল। বাসে করে রওনা দিলাম রুমা বাজারের উদ্দেশ্যে। ১২০ টাকা ভাড়াতে প্রথম এমন এক বাসে উঠলাম যেটা দিয়ে প্রতিদিন নানা সম্প্রদায়ের পাহাড়ের মানুষ যাতায়াত করে। আমার অনুভূতি ছিল শাহরুখ খানের 'ইউহি চ্যালা চ্যাল রাহি' এর মত! আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথে রুমা যেতে লেগে যায় কয়েক ঘন্টা।
রুমা বাজারে গিয়ে দুপুরের খাবার সেরে ছন্নছাড়ার মত ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, কোনদিকে যাব বুঝতে পারছিলাম না। আশরাফ নামে এক ভাইকে ফোন দিলাম, কী করা যায় জানতে। যেহেতু তিনি আলাদীনের চেরাগ, তাই সমাধানটা তাঁর জানা ছিল! তিনি একজন গাইডের ব্যবস্থা করে দিলেন, যিনি আমাকে রুমা থেকে বগালেক হয়ে দার্জিলিং পাড়ায় নিয়ে যাবেন। উদ্দেশ্য- সহজাত জীবন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা!
কিন্তু এবারও বিধি বাম! আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে রিপোর্ট করতে করতে বেজে গেল ৪ টার বেশি, নিরাপত্তাজনিত কারণে যাত্রা আর সেদিন শুরু করা গেল না। প্রথমে কিছুটা হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম, তবে হতাশাকে জিততে না দিয়ে বের হয়ে পড়লাম রুমার জীবনযাত্রা দেখতে। বিকেলে সাংগুর বুকে নিজেকে কিছুক্ষণ মেলে দিলাম। সাঙ্গু হল আমার কাছে বাংলাদেশের অবহেলিত আমাজন নদী। তুলনাটা হয়তো ঠিক হয়নি, তবে আমার কাছে সাঙ্গুর বুকের প্রতিটি স্রোতকেই রহস্যময় মনে হয়েছে। রাতে থাকলাম নদীর তীরবর্তী হোটেল সাঙ্গুতে।
পরদিন খুব সকালে আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট করে আমার গাইড রাজীব দাদাকে নিয়ে মোটরসাইকেলে রওনা দিলাম। সকাল বেলার এই যাত্রাটাও ছিল অনেক উপভোগ্য। তবে রাস্তা এতটাই উঁচুনিচু যে এই পথে মোটরসাইকেল যাত্রা আসলেই আমার কাছে ভয়ানক থ্রিলিং এর ব্যাপার-স্যাপার মনে হয়েছে। বিশেষ করে বগা লেকের আগে থেকে রাস্তা বলতে গেলে ৮০ ডিগ্রী খাঁড়া! বগালেকের ক্যাম্পে রিপোর্ট করেই এগিয়ে গেলাম দার্জিলিং পাড়ার উদ্দেশ্যে, এই পথটুকু হেঁটেই রওনা দিলাম। পথিমধ্যে এক ঝিরিতে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম, আর্মি ক্যাম্প থেকে সংগ্রহীত খিচুড়ি। ঘন্টা ৩ হাঁটবার পর দার্জিলিং পাড়াতে এসে উপস্থিত হলাম যখন, তখন এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করল নিজের ভেতর। একেবারেই অন্য একটি সমাজ, কৃষ্টি, সংস্কৃতিতে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। প্রতিটা প্রাণ এখানে এক একটি অণুকাব্য!
মেঘলা দিদির কটেজে এরপর কাটালাম কতগুলো দিন। এই প্রতিটি দিন, একেকটি থেকে এতটাই আলাদা আর বৈচিত্র্যময় আমার কাছে যে আমি আসলে এই পার্টটার কোনো বর্ণনা দেয়া থেকে বিরত থাকলাম। শুধু এতটুকু বলতে পারি, প্রতি বেলায় দার্জিলিং পাড়াতে আমি নিজেকে খুঁজে ফিরেছি এই পাহাড়ের আত্মাদের মাঝে। প্রতিদিন সকালে উঠে হরেক পদের পাহাড়ি খাবারের স্বাদ পুরো ব্যাপারটাতে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে! ৩ দিন দার্জিলিং পাড়াতে থেকে অবশেষে আবারো সেই জীবনযুদ্ধে যোগদানের জন্য রওনা দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। এর মাঝে কেওকারাডং এর দিকেও যাওয়া পড়েছে, তবে প্রতি মুহুর্তে দার্জিলিং পাড়ার মোহ আমাকে এতটাই নিজের কাছে রেখেছে যে পাড়া থেকে আশেপাশে যাবার ইচ্ছা খুব একটা উপলব্ধি করিনি আমি।
একেবারেই একা একা একটা ভ্রমণে সবচেয়ে বড় সুবিধা যা পেলাম, চিন্তায় কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি। যখন যা করতে মন চায়, ঠিক তাই করেছি। একেবারেই বেপরোয়া ছিলাম। (তবে গাইডের কথার অবাধ্য হইনি কখনো) আর অত্যন্ত কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করতে চাই মেঘলা দিদি এবং তাঁর পরিবারকে, যারা বলতে গেলে একরকম আদর দিয়েই আমাকে আগলে রেখেছিলেন কয়েকটা দিন। আর একই সাথে রাজীব দাদাকেও ধন্যবাদ, গাইডের চেয়েও একজন বন্ধু হিসেবেই তিনি বেশি ভূমিকা পালন করেছেন।
পুরো যাত্রায় যেভাবে যাবেন- ঢাকা থেকে বান্দরবানের বাসে উঠবেন। বাস ভাড়া ৫০০ এর কাছাকছি বা হয়তো তার বেশি, আমার এটা মনে নেই। এরপর বান্দরবান নেমে রুমা যাবার বাসে উঠে রুমা যেতে হবে। বাস ভাড়া জনপ্রতি ১২০ টাকা। রুমা বাজারে নেমে বিকেল চারটার আগে গাইডদের একটা এসোসিয়েশন আছে, সেটা থেকে একজন গাইড হায়ার করতে হবে। দিনপ্রতি গাইড ভাড়া ৬০০ টাকা। রুমা বাজার থেকে মোটরসাইকেলে বগালেক পর্যন্ত আপডাউন ১০০০-১২০০ এর মত নিবে। আপনার গাইডের মোটরসাইকেল থাকলে অনেক ভাল।
এরপর চলে যাবেন মেঘলা দিদির কটেজে, পার নাইট এক জন থাকতে ২০০-২৫০ টাকার মত লাগে, খাবারের বিল আপনি যেমনটা খাবেন তার উপর নির্ভর করবে। একটি বিশেষ অনুরোধ, পুরো জার্নিতে কখনো ময়লা, আবর্জনা পলিথিন ফেলে পরিবেশ নোংরা করবেন না। যাবার পথে ঝিরিতে অনেক জায়গাতেই চিপসের প্যাকেট পরে থাকতে দেখেছি, এ ব্যাপারগুলোতে সতর্ক থাকাটা খুব জরুরী। আমাদের পরিবেশ রক্ষা করবার দায়িত্ব আমাদেরই।
আরেকটা বিষয়, পাহাড়ের জীবনের নিজের একটা সুর আছে, লয় আছে। এমন কোন কর্মকাণ্ড করবেন না যা তাদেরকে কোনভাবে আপনার ব্যাপারে বিরূপ ধারণা পোষণ করতে সহায়তা করে। আর তাদের সাথে ছবি তুলবার সময় অনুমতি নিয়ে নিবেন।হড় আমাকে চুম্বকের মত টানে, একজানা মোহতে। তার চেয়েও বেশি টানে পাহাড়ের বুকের শত-শত বছরের জীবন-যাত্রা, ভাষা, আত্মা, কৃষ্টি। তাই কেওকারাডং এর উপরের অসাধারণ দৃশ্যের চেয়ে আমার কাছে দার্জিলিং পাড়ার প্রতিটি মুহুর্তের জীবনের স্লোগানের মূল্য বেশি। আবার যাবো দার্জিলিং পাড়ার কফি বাগানের ভেতরে, এমন এক পাখি নিয়ে যে কখনো অন্যের বুলি আওড়াবে না।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন