গরুর বানানে যদি ও-কার থাকেই, সেটা গত একশো বছরে সংশোধন করা হলো না কেন? বাংলা একাডেমির কর্তারা বাংলাভাষী জনগনকেই 'গোরু' ভাবছেন না তো?

এই করোনাকালে সবার জীবন বিপর্যস্ত, ভাইরাসের তাণ্ডবে মানুষ দিশাহারা। কেউ সরাসরি ভাইরাসের সঙ্গে লড়ছে তো কেউ ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার সঙ্গে, কেউ বা বন্দী জীবনের মানসিক যন্ত্রণার সঙ্গে। এই মানুষগুলোকে নির্মল বিনোদনের যোগান দিতে উদ্ধারকর্তা হিসেবে হাজির হয়েছে বাংলা একাডেমি। বাংলা বানানের ভুলগুলো শুদ্ধ করার মিশনে নেমেছে তারা, শৈশব থেকে যত বানান শিখে এসেছি, সবই এখন অপরিচিত মনে হচ্ছে তাদের সৌজন্যে। পড়ালেখাটা আবার বর্ণপরিচয় থেকে শুরু করতে হবে কিনা, সেটাই ঘুরপাক খাচ্ছে মাথার মধ্যে। 

অনেকদিন ধরেই বাংলা একাডেমি এই মিশনে আছে। ঈদের বানান যেমন বদলে গিয়ে হয়ে গেল ইদ, ব্যাঙ হয়ে গেল ব্যাং, পাদ্রীকে লিখতে হবে পাদরি, ঈ-তে ঈগল পড়ে এসেছি সারা জীবন ধরে, সেই পাখির নাম নাকি এখন হ্রস্ব-ই দিয়ে লিখতে হবে! ঘুষকে লিখতে হবে ঘুস, সবচেয়ে বিরক্ত লেগেছে গরুর বানান পরিবর্তিত হতে দেখে, উচ্চারণের মতো লেখার সময়ও নাকি গোরু-ই লিখতে হবে! অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাংলা একাডেমি সম্ভবত বাংলাভাষী জনগনকেই 'গোরু' ভাবছে। 

গরু বানানে আগেও ও-কার ছিল। এটা বাংলা একাডেমি প্রবর্তন করেনি। রবীন্দ্রনাথ এই শব্দটাকে গরু লিখতে শুরু করেছিলেন, পরে বিশ্বকবিকে অনুসরণ করেছেন সবাই। একইভাবে ঈদ শব্দটার আসল বানান যে ইদ, সেটাও প্রায় আশি-নব্বই বছর আগে ঠিক করা হয়েছিল। কিন্ত সমস্যা হচ্ছে, বাংলা একাডেমি এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র প্রচারণা চালায়নি কখনও, বছরের পর বছর ধরে চলে আসা ভুল বানানগুলো নিয়ে (আদৌ ভুল কিনা সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে) সচেতনতার চেষ্টাও করেনি। আমাদের দাদা-বাবা থেকে শুরু করে আমরাও বড় হয়েছি যেসব বানান শিখতে শিখতে, সেসব বানানকেই এখন ভুল বলছে বাংলা একাডেমি। 

বাল্যশিক্ষার বই থেকে বাংলা আমার বই হয়ে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত সব সরকারী-বেসরকারী বইয়ে যেসব বানান ব্যবহার হয়েছে, সেগুলো যদি একে একে ভুল প্রমাণীতই হয়, তাহলে এই বইগুলো ছাপানোর সময় কেন সেটা খেয়াল রাখা হয়নি? তখন কেন বাংলা একাডেমির বানানরীতি অনুসরণ করা হয়নি? বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ তখন নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়েছে কেন? গরুর বানানে যদি ও-কার থাকেই, সেটা গত একশো বছরে সংশোধন করা হলো না কেন? ঈ-তে ঈগল পরে যারা বড় হয়েছে, তারা কেন ই দিয়ে ইগল লিখবে? 

গোরু বানানে ও-কার অনেক আগে থেকেই ছিল

গো-খাদ্য, গো-হত্যা, গোমাংস- এই শব্দগুলো নিশ্চয়ই শুনেছেন। শুনে থাকলে গোরু বানানটা যে ভুল নয়, সেটাও বোঝা উচিত। এবং একইসঙ্গে এটাও মেনে নেয়া উচিত, বানান চাপিয়ে দেয়ার জিনিস নয়। রবীন্দ্রনাথ গোরু না লিখে গরু লিখেছেন, চাইলে আপনিও লিখতে পারেন। প্রচলিত রূপ এটাই। বানান ভুলের জন্য কেউ কাউকে ফাঁসিতে চড়াবে না। তবে পরীক্ষার খাতায় এমন কনফিউজিং বানানগুলোর জন্য কারো নম্বর কাটা হলে সেটা হবে অত্যাচারের শামিল, কারণ একটা বানান একশো বছর ধরে প্রচলিত, সেটা হুট করে একদিনের নোটিশে বদলে যাবে না, বদলানো সম্ভব না।

বাংলাদেশে যে কোন শব্দের বানান নিয়ে সবশেষ কথা বলার অধিকার বাংলা একাডেমিরই আছে। তবে সেই অধিকারের অপপ্রয়োগ করলে সমস্যা। বাংলা একাডেমি সেটাই করছে। দেশের মানুষকে বানান নিয়ে সচেতন না করেই তারা নতুন বানানরীতি চাপিয়ে দিতে চাইছে। দরকার ছিল প্রচারণা চালানো, স্থানীয় পর্যায়ে শিক্ষকদের সাথে কথা বলা, স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ে নতুন বানানরীতি ঢোকানো, পত্র-পত্রিকা থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও যাতে সবাই নতুন বানানরীতি অনুসরণ করে সেই অনুরোধ এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এই প্রসেসটাতেও বছর দশেক লেগে যেতো নতুন এই বানানগুলো মানুষের মাথায় ঢোকাতে। 

কিন্ত আমাদের বাংলা একাডেমি তো সেই ২০১৬ সালেই এসব বানান ঠিক করে কুম্ভকর্ণের নিদ্রায় মগ্ন হয়েছে, প্রচারণার সময় কোথায় তাদের? নতুন এসব বানান আমাদের জানতে হচ্ছে ফেসবুকের কয়েকটা পেজের কল্যানে, প্রাতিষ্ঠানিক প্রচারণা না থাকায় এসব বানান নিয়ে অবিশ্বস্ততা যেমন তৈরী হচ্ছে, তেমনই হচ্ছে হাসি-ঠাট্টা। বাংলা একডেমির যেটা করার কথা ছিল, সেটা করছে অন্য কেউ, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছে তারা। বানানরীতি ঠিক করার গোটা ব্যাপারটাকে এরকম তামাশায় পরিণত না করলে সম্ভবত বাংলা একাডেমির কর্তারা শান্তি পাচ্ছিলেন না, অবস্থাদৃষ্টে এমনটাই মনে হচ্ছে এখন। 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা