বাঘা যতীনের ক্ষতবিক্ষত ভাস্কর্য বনাম আমাদের 'সাম্প্রদায়িক' হৃদয়!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

চার বৃটিশকে একাই পিটিয়ে তুলোধোনা করেছিলেন তিনি। ভারবর্ষের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছিলেন যে বাঘা যতীন, আজ তারই স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য ভাঙছে একদল অমানুষ, স্বাধীনতার জন্য যাদের বিন্দুমাত্র অবদান ছিল না কখনও...
খুব অল্পবয়সে ছেলেটি একবার জেদের বশে হাতে একটি ধারালো ছোরা নিয়ে চলে গেছিলেন গ্রামের পাশের গহীন জঙ্গলে, বাঘ শিকারের জন্যে। এবং শেষপর্যন্ত তিনি বাঘকে বধও করে ফেলেছিলেন। এই ঘটনা রীতিমতো হৈচৈ ফেলে দেয় পুরো গ্রামে। তাকে বিশেষ জনপ্রিয়তাও এনে দেয় এই চাঞ্চল্যকর ঘটনা। পারিবারিক নাম যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় হলেও মানুষজন তখন থেকে তাকে ডাকা শুরু করে 'বাঘা যতীন' নামে।
ক্ষুদিরাম, বাঘা যতীন, প্রফুল্ল চাকী এদের নাম কোথাও শুনলেই একটা স্বদেশী স্বদেশী অনুভূতি টের পাওয়া যায়। সাহেবের ফিটন গাড়ি, গঙ্গার তীরে হাওয়া খেতে যাওয়া, গোপন থেকে বেরিয়ে আসা খদ্দরের জামা পরা মুখে হালকা গোঁফের রেণু ওঠা বিপ্লবী, বন্দে মাতরম, হাতের পেটোবোমা আছড়ে পড়া ফিটন গাড়ির ছাদে, বিস্ফোরণ, সাহেব নিকেশ... এরকম দৃশ্যকল্প ভেসে ওঠে এই বিপ্লবীদের নাম শুনলে। তবে এই বিপ্লবীদের মধ্যেও বাঘা যতীন ছিলেন অনেকটাই স্বকীয়।একটা সময়ে তিনি নিজে ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একমাত্র নেতা৷ প্রবল শক্তিতে তিনি আগলে রেখেছিলেন পুরো বিপ্লবকে।
বাঙ্গালীদের মধ্যে এরকম শক্তপোক্ত দৈহিক গঠন খুব কম মানুষেরই ছিলো। বাঘা যতীন তাই বাঙ্গালী হয়েও অনেকটা অন্য আঙ্গিকের মানুষ। মানসিকতাও সেরকম। ভীষণ একরোখা ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অনমনীয়। অবশ্য এরকমটা বোধহয় হওয়ারই ছিলো। পাঁঁচ বছর বয়সে বাবা মারা যান। এরপর মায়ের অধীনেই কায়ক্লেশে বড় হয়ে ওঠা। মুদ্রার উল্টোপাশ দেখেছিলেন খুব কম বয়সেই। এ কারনেই হয়তো হতে পেরেছেন কঠিন মানসিকতার।
তবে তাই বলে সুকুমার বৃত্তিগুলোর চর্চা যে করতেন তা না। মা শরৎশশী ছিলেন স্বভাবকবি৷ প্রচুর পড়াশোনা করতেন৷ যতীন ও তার বড় বোন বিনোদবালা তাই মায়ের দেখাদেখি অল্পবয়সেই অনেক বই পড়ে ফেলেন। ভেতরে ভেতর সুস্থ এক সংস্কৃতির বীজও গড়ে ওঠে সে সময়ে। যতীন যাত্রার মঞ্চেও ছিলেন নিয়মিত মুখ। পৌরাণিক চরিত্রগুলোতে অভিনয় করতেন তিনি। এছাড়া নিয়মিত খেলাধুলাতেও ব্যস্ত থাকতেন। নিজের ফুটবল ক্লাবও ছিলো।
পরবর্তীতে লেখাপড়ার জন্যে তিনি যান কলকাতায়। দেশে ব্রিটিশদের উৎপাত তখন ক্রমশ বাড়ছে৷ সে সময়েই তার দেখা হয় স্বামী বিবেকানন্দের সাথে। স্বদেশপ্রেমের এক অন্য মাত্রা পান তিনি বিবেকানন্দের কাছ থেকে। জোরেসোরে আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ায় স্বদেশপ্রেমের চর্চা শুরু করেন তিনি। পার্টটাইম স্টেনোগ্রাফার হিসেবে একটা চাকরিও জুটিয়ে নেন। নিয়মিত কুস্তির আখড়ায়ও যেতেন। মোটামুটি একটি মাসোহারা, শরীরচর্চা, সে সাথে সাথে স্বদেশপ্রেমের চর্চা... এভাবেই দিন যাচ্ছিলো। সুশৃঙ্খলভাবেই যাচ্ছিলো।
মাঝখান দিয়ে জীবন খানিকটা উল্টেপাল্টে গেলো। মা মারা গেলেন। যতীন মায়ের শেষ ইচ্ছানুযায়ী গ্রামেই বিয়ে করলেন। কলকাতায় না ফিরে নিজের গ্রামের বাড়িতেই থেকে গেলেন। এরইমধ্যে ঘটনাচক্রে দেখা হয়ে গেলো শ্রী অরবিন্দের সাথে। সেই অরবিন্দ ঘোষ, যিনি ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তি।

অরবিন্দের সাথে দেখা হওয়াটা যতীনের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। যতীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন আষ্টেপৃষ্টে। কাজ করতে করতে একসময়ে তিনি অরবিন্দের ডান হাত বলেও পরিচিত হন। বন্দুক ছোঁড়া, নানারকম অপারেশনের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করা...সবই হতো গোপন বিভিন্ন আখড়ায়। যতীন সেগুলোতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন৷ যতীন আখড়াগুলোকেও সচল রাখতেন বিভিন্ন প্রক্রিয়ায়।
বিক্ষিপ্ত বিভিন্ন সংঘর্ষেও যতীন প্রায়শই অংশ নিতেন৷ রাস্তাঘাটে সুযোগ পেলেই গোরাদের ধরে পেটাতেন। তার মতে- বিপ্লব সফল হবে তিনটি ধাপে। প্রথম ধাপে একদল মানুষ নিহত হবে৷ তাদের মৃত্যু সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করবে। নাড়া দেবে। দ্বিতীয় ধাপে মানুষজন বিক্ষিপ্ত কিছু দলে ভাগ হয়ে আন্দোলন করবে। এই আন্দোলন ক্রমশ বাড়তেই থাকবে। তৃতীয় ধাপে এসে দেশব্যাপী প্রবল আন্দোলন হবে। এভাবেই সফল হবে বিপ্লব। যতীনের মনে তাই ভয়ডর ছিলো না। যখনই সুযোগ পেতেন তাই হাত চালিয়ে আসতেন৷ মরে যাওয়ার ভয়ও পেতেন না। তার মৃত্যু হলেও তা যে অনেক মানুষকে আলোড়িত করবে, তা জানতেন তিনি।
এরইমধ্যে ঘটে একটা বড়সড় ঘটনা। চারজন ব্রিটিশ অফিসারের সাথে শিলিগুড়ি স্টেশনে তিনি মারামারি করেন৷ চারজনেরই চোয়াল ভেঙ্গে তাদের কুপোকাত করেন তিনি। এই ঘটনা সারা দেশে আলোড়ন তোলে। যতীনের নামে মামলা দায়ের হয়। এই মামলা প্রত্যাহারের দাবীতে আবার সারা দেশ একাট্টা হয়ে বিপ্লব করে। সরকার যতীনের বিরুদ্ধে করা মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয়। যদিও ম্যাজিস্ট্রেট যতীনকে হুশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন-
এমনটি আর করবেন না কখনো।
যতীনও পালটা উত্তর দিয়েছিলো-
নিজের বা দেশবাসীর সম্মান বাঁচাতে যদি প্রয়োজন হয়, এমনটা যে আবার করবো না, এ শপথ করতে পারছি না।
যতীন টাকাপয়সা জোগাড় করে অনেক ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করতে বিদেশে পাঠাতেন। যাতে করে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশে ফিরে এই ছেলেমেয়েরা ব্রিটিশদের সাথে টক্কর দিতে পারে। বিপ্লবীদের অস্ত্রশস্ত্রও সরবরাহ করতেন তিনি। গ্রামে গ্রামে ক্ষুদ্র কুটিরশিল্প, নৈশ বিদ্যালয়ও চালু করেছিলেন যতীন। সাধারণ মানুষের কাছে 'বাঘা যতীন' মানেই তখন অন্যরকম এক বিষয়। দৃঢ় বিপ্লবী, তুমুল আদর্শবাদী মানুষ যেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।
সময় গড়ায়। অনেককিছুর পালাবদল ঘটে। যতীনের জেল। সেখান থেকে বের হওয়া। জার্মানি-ইংল্যান্ডের যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখে জার্মানির সাথে মতলব আঁটা। ভারত-জার্মান ষড়যন্ত্রের নাটের গুরু হওয়া। যতীনের অনেক গল্প। অনেক কাজ। অনেক প্রচেষ্টা।
এরমধ্যেই পুলিশ রেড দেওয়া শুরু করে বিপ্লবীদের আস্তানায়। বাঘা যতীন খবর পেলেন তার অজ্ঞাতনামা গুপ্ত আস্তানা বালেশ্বরেও আসবে পুলিশ। বাঘা যতীন তখন চাইলে পালাতে পারতেন। কিন্তু তিনি দৃঢ়স্বরে জানালেন, এবার যুদ্ধ করেই মরতে হবে। দেশকে জাগাতে হবে। ব্রিটিশদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধ হলো। সহযোদ্ধা কেউ কেউ মারা গেলেন। যতীন কে আহত অবস্থায় আটক করে নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। সারারাত রক্তপাত হয়ে পরদিন হাসপাতালে মারা গেলেন তিনি। তখনও রক্তবমি হচ্ছিলো তার। হেসে হেসেই বললেন-
এত রক্ত ছিলো শরীরে? ভাগ্যক্রমে, প্রতিটি বিন্দু অর্পণ করে গেলাম দেশমাতার চরণে।
এই কথাগুলো বলেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মহীরূহ বাঘা যতীন।
বাঘা যতীনের জন্ম কুষ্টিয়া জেলায়। এই কুষ্টিয়াতেই নির্মান করা হয়েছিলো বাঘা যতীনের এক ভাস্কর্য। সেই ভাস্কর্যকে কে বা কারা যেন ভাংচুর করেছে দুইদিন আগে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যও এখানে ভাংচুর হয়েছে ক'দিন আগেই। এমনিতেই 'ভাস্কর্য' টপিক এখন বেশ গরম। ভস্মে ঘি ঢালার মতন ঘটছে একের পর এক অরাজকতা। কিন্তু জড়মস্তিষ্কের এই দুষ্কৃতিকারীদের এই বিষয়টি বোঝার ক্ষমতা নেই, কীর্তিমান মানুষদের ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেললে তা তাদের অবদানকে মোটেও খাটো করে না, বরং তা এইসব অপোগণ্ড প্রানীদের মানসিক দৈন্যতাকেই প্রকাশ করে। জাতি হিসেবে আমরা কতটা অপদার্থ মানসিকতার, সেটাও বুঝিয়ে দেয়। যেখানে অন্য দেশ গুলো জাতীয় বীরদের নিয়মিত সম্মান দেয়, আলাদা মর্যাদা দেয়, সেখানে আমরা তাদের ভাস্কর্য ভেঙ্গে নিজেদের শৌর্যবীর্যের জানান দেই।
কী এক হাস্যকর জাতি আমরা! কী এক বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী সমাজ আমাদের! ভাবলে ঘৃণাও হয় না। করুনা হয়।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন