গানের কোয়ালিটি, গানের প্রতি এক্সপিরিমেন্ট, গানকে বৈশ্বিক চিন্তার সাথে মেলানো, ফিলসফিক্যাল পয়েন্ট অফ ভিউ, গানকে বোঝার চেষ্টা- সব মিলিয়ে এই দলটি আরো বেশি এটেনশন ডিজার্ভ করে।

অনেকেই ব্যাকস্টেজ গানের দলটির কথা জেনে থাকবেন। তাদের কাছে হয়ত ভীষণ প্রিয় এই দলটি। তাই তাদের জন্যে শুরুতেই ব্যাকস্টেজ'কে আন্ডাররেটেড বলার কারণটি একটু ব্যাখ্যা করি। আন্ডাররেটেড বলতে বুঝাতে চেয়েছি, এই দলটির যতটা সামর্থ্য, যতটা প্রতিভা ততটুকু মূল্যায়ন সম্ভবত এদের হয়নি। 

ইউটিউব থেকে ব্যাকস্টেজের উত্থান এবং ঠিক একই প্ল্যাটফর্ম থেকে গত কয়েক বছরে অনেকের উত্থান হয়েছে। অনেকে ভাইরাল হয়েছে। সেই তুলনায় ব্যাকস্টেজ যতটা আলোচিত হবার কথা, ততটুকু হয়নি বলেই মনে হয়। দলটির গানের কোয়ালিটি, গানের প্রতি এক্সপিরিমেন্ট, গানকে বৈশ্বিক চিন্তার সাথে মেলানো, ফিলসফিক্যাল পয়েন্ট অফ ভিউ, গানকে বোঝার চেষ্টা সব মিলিয়ে এই দলটি আরো বেশি এটেনশন ডিজার্ভ করে বলেই মনে হয়। তবে ধীরে ধীরে ব্যাকস্টেজ আরো বেশি জনপ্রিয় হবে, আলোচিত হবে সেটা আন্দাজ করাই যায় আত্মবিশ্বাস নিয়ে। 

ঠিক কতদিন আগে ব্যাকস্টেজকে আমি প্রথম শুনি, তা ঠিক স্মরণে আসে না। ইউটিউবে একই ধরনের গান শুনতে শুনতে, একই স্টাইলের পরিবেশনায় বিরক্ত হয়ে এক্সট্রাঅর্ডিনারি কিছু খুঁজছিলাম। ভারতীয় কিছু শিল্পীর কাভার করা গান ভাল লাগত, তবে সেসবও গতানুগতিক হয়ে গেল কিছুদিন বাদে। মনে পড়ে, এমনই একসময় হুট করে ফোক গান খুঁজতে গিয়েই সম্ভবত ব্যাকস্টেজকে খুঁজে পাওয়া। ব্যাকস্টেজের কোনো গান তখনো সম্ভবত সিক্স ডিজিট ভিউ পায়নি ইউটিউবে। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, ব্যাকস্টেজ গান কাভার করলেও তাদের স্টাইল একদমই আলাদা, তারচেয়ে বড় কথা তাদের গানের পরিবেশনায় একটা ক্ল্যাসি ব্যাপার ছিল।

খুব যে দুর্দান্ত সেটআপ তা নয়। সাজানো-গোছানো স্টুডিও, বিশাল আয়োজন করে গান করেন তারা এমনও নয়। একটা বদ্ধ ঘর। কয়েকজন তরুণ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজায়। বালতিকেও তারা ইন্সট্রুমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করে। একজন মুখোশ পড়ে থাকে। খুব সাধারণ একটা মুঠোফোনে কেউ একজন এই পুরো গানের ভিডিও করতে থাকেন, ফোনটা কাঁপে, এবং কখনোই স্থির থাকে না। রুমটাও খুব আলোকোজ্জ্বল তা নয়। এই সাদামাটা একটা আয়োজন, কিন্তু পুরো দল মিলে একটা ম্যাজিক্যাল আবহ তৈরি করতে পারেন বাজনা গায়কী সব কিছু মিলিয়ে। এখানেই ব্যাকস্টেজের স্বাতন্ত্র‍্য।

ব্যাকস্টেজের কাছে 'মিউজিক ইজ ফান'

ব্যাকস্টেজের দুর্দান্ত একটা ইউনিক ব্যাপার হলো, তারা গানের মধ্যে প্রচুর এক্সপিরিমেন্ট করেন। গানটাকে ভালবেসে মজা নিয়ে গান করেন বলেই কিনা তাদের এক্সপিরিমেন্ট কখনোই দৃষ্টিকটু লাগে না। বাংলা একটা গানের সাথে কখনো তারা হিন্দি গানের মিশেলে একটা নতুন ভাবনা তৈরি করেন, কখনো ইংরেজি গান এসে পড়ে, কখনো এসে পড়ে র‍্যাপ কিংবা কবিতাও! এখানে তাদের একটা দারুণ ফিলসফি আছে। গানের ভাষা আলাদা হতে পারে কিন্তু গানের যে বৈশ্বিক মেসেজ সেখানটায় কোনো পার্থক্য নেই। রবীন্দ্রনাথ যেভাবে ভালবাসার কথা বলে গেছেন, একই ভালবাসার অভিব্যক্তি হয়ত হিন্দিতে কেউ করেছেন, কেউ করেছেন ইংরেজিতে। দুইটা গান তাই সুরে আলাদা, ভাষায় আলাদা হলেও ভাবনা যখন কাছাকাছি, আকুলতা যখন প্রগাঢ় তখন এই দুইটা গান মিলে মনের কথা যেন আরো প্রকট হয়ে ফুটে ওঠে। ব্যাকস্টেজ সেই কাজটাই করতে পেরেছে দারুণভাবে, ফলে তাদের যে অডিয়েন্সবেজ সেই শ্রোতাদের কাছে ব্যাকস্টেজ ভীষণ আপন। 

মন আমার দেহ ঘড়ি গানটা যেমন সুফি ঘরানার, কুন ফায়া কুনও তেমনি। এই দুটি গান একই সুতায় মিলিয়েছিল ব্যাকস্টেজ। সে যে বসে আছে একা একা গানের সাথে তারা মিলিয়েছেন সো লেট হার গো গানটিকে। এরকম অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে। গুটিকয়েক লোক অবশ্য জাতীয়তাবাদের দোহাই দিয়ে প্রশ্ন তোলে- কেন বাংলা গানের সাথে ইংরেজি মেলাতে হবে?

প্রশ্নটা হয়ত অমূলক নয়। কিন্তু, এই প্রশ্নের জবাবেও ব্যাকস্টেজের অসাধারণ একটা ফিলসফি আছে। ধরুন, আপনি একটা ইংলিশ গান শুনছেন। গানের যে মেসেজ, এরকম মেসেজের গান বাংলাতেও আছে। কিন্তু সেই বাংলা গান কি কোনো ইংলিশম্যান হেডফোন গুঁজে শুনবে? ব্যাকস্টেজের কাভারের কল্যানে হয়ত একজন ইংরেজ তার ইংরেজি ভাষার কাভার শুনতে গিয়ে শুনে ফেলবে একটা বাংলা গানও। গানের একটা কানেক্টিং ক্ষমতা আছে। সেই ইংরেজ হয়ত বাংলা গানটা না বুঝলেও টের পাবে, ইংরেজির সাথে এই বাংলা গানটাও ভালবাসার আকুলতা জানাচ্ছে, বিরহের কথা বলছে। ব্যাকস্টেজের এই মিশ্রণের কারণে একজন ইংরেজ, একজন ভারতীয়, একজন আরব দেশের লোকের কাছে বাংলা গান পৌঁছে যায়, এর চেয়ে দারুণ আর কী হতে পারে? 

ব্যাকস্টেজের আরেকটা চমৎকারিত্ব হলো, এই দলটি ব্যক্তিস্বর্বস্ব নয়। ভোকালে রুদ্র আল রাজীব সম্ভবত সবচেয়ে বেশি গেয়েছেন তবে রুদ্র ছাড়াও আদিব, বিশ্বজিত সহ আরো অনেকে ভোকাল হিসেবে গান পরিবেশনা করেছেন। আবির, রাব্বি, রুবেল, সোহান, রাসেল, শুভ, তুহিন, সাগর, শিশির, অনিম, ক্ষুদে গানরাজ রাতুল, চয়ন, রায়হান, ফারমিন ফয়সাল, শাহাব উদ্দিন, আকিব, জাহিদ ইকবাল, বিশ্ব, এনোনিমাস (মুখোশ পরে থাকেন যিনি) এরা মোটামুটি পরিচিত মুখ ব্যাকস্টেজের। এর পাশাপাশি মাঝে মধ্যেই নতুন কেউ এসে বাজাচ্ছে, পুরানো মেম্বাররা তো থাকেই। ব্যাকস্টেজের পার্মানেন্ট কোনো লাইনআপ নেই। এরা সবাই মিলে একটি পরিবার। ফলে ব্যাকস্টেজ সবসময়ই ব্যতিক্রম কিছু তৈরি করতে পারে অনেকগুলো প্রতিভাবান মানুষের দল হয়ে উঠবার কারণে। ব্যাকস্টেজের লক্ষ্য একটা অর্কেস্ট্রা হয়ে ওঠা এবং একদিন ১০০ জন মিলে তারা গান, মিউজিক বাজাবেন একসাথে।

ব্যাকস্টেজের সবাই মিলে একটা পরিবার

কোক স্টুডিও মিউজিক শো দেখে তারা একসময় অনুপ্রাণিত হয়েছিল। সম্ভবত সে কারণে তারাও বৈচিত্র্যময় গান পরিবেশনার দিকে মনযোগ দিয়েছিল। শুরুর দিকে কখনোই তাদের চিন্তা ছিল না লোকে কী ভাববে। মনের আনন্দে কয়েকজন শিক্ষানবিশ মিউজিশিয়ান গান করতেন। একদিন মনে হলো, মানুষের ফিডব্যাক নেয়া দরকার। সেই ভাবনা থেকে ইউটিউবে গান আপলোড করা। ধীরে ধীরে ফিডব্যাক পেতে থাকলেন এবং মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে তারা যত ধারণা পেলেন, ততটাই নিজেদেরও চিনতে শুরু করলেন। তারা বলে থাকেন, এখনো তারা শিখছেন। এই শিখাটা একটা আনন্দময় অভিজ্ঞতা। তাদের মোটো হলো, মিউজিক ফর ফান। তারা মজা করতে করতেই গানটা করেন। শুধু কাভার করেন তা নয়, তাদের নিজেদের মৌলিক গানও আছে। তাদের মৌলিক ট্র‍্যাকগুলোর মধ্যে 'মিথ্যা কথা', 'চাঁদের রেডিয়াস', 'কোথায় হারালি' আমার ব্যক্তিগত প্রিয়। 

শুধু আমার প্রিয় নয়, এই দলের গায়কীর প্রতি ভালবাসা কোন স্তরের মানুষ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে তার একটা মিষ্টি গল্প বলা যায়৷ একদিন ব্যাকস্টেজ পথশিশুদের গান শোনাতে এসেছিল কমলাপুরে। ভোকাল রুদ্র, বিশ্বজিত, শুভ মিলে সেখানে গান শুনিয়েছিল। হাসান নামের একটি ছেলে যার দুইটা পা নেই, একটা হাত নেই, সে ছেলেটি রুদ্রদের গান শুনে তাকে জড়িয়ে বলেছিল, 'তুমি আমার ভাই হবে?' ছেলেটি রুদ্রকে একটি রিস্টব্যান্ডও উপহার দিয়েছিল। গানের সূত্রে মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক হয় তার চেয়ে মানবিক সুন্দর সম্পর্ক খুব কমই হয়। ব্যাকস্টেজের সাথে মানুষের এমন মানবিক সম্পর্ক বাড়তেই থাকুক গানের কল্যাণে, ব্যাকস্টেজকে মানুষ আরও আপন করে নিক, গানের মধ্যেই বেঁচে থাকুক মানবীয় ভালবাসার হাজারো গল্প!

* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা