একজন সাংসদ যখন সংসদে দাঁড়িয়ে আহমদ শফির তেঁতুল তত্ত্বকে সমর্থন জানান, ফেসবুকে আলটপকা কমেন্ট করে বেড়ানো ব্যাকটেরিয়াদের সঙ্গে একই সুরে ধর্ষনের জন্য নারীদের দিকেই আঙুল তোলেন, তখন ব্যাপারটা অ্যালার্মিং হয়ে দাঁড়ায়...

বগুড়া-৭ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মো. রেজাউল করিম বাবলু। জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি গতকাল বলেছেন, দেশজুড়ে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধির জন্য নাকি নারীবাদীরা দায়ী। ধর্ষণ ঠেকানোর জন্য তিনি হেফাজতে ইসলামের সাবেক আমির আহমদ শফির কুখ্যাত তেঁতুল তত্ব কাজে লাগানোরও উপদেশ দিয়েছেন। এতে নাকি ধর্ষকেরা নিরুৎসাহিত হবে, আর তাদের মধ্যে ধর্মানুভূতি ফিরে আসবে। 

২০১৩ সালে দেশের সবচেয়ে আলোচিত্র চরিত্রগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছিলেন আহমদ শফি। নাস্তিক ব্লগারদের বিচারের দাবী তুলে হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে লক্ষাধিক কর্মী নিয়ে ঢাকায় চলে এসেছিলে তিনি, শাপলা চত্বরে বিশাল সমাবেশ করেছেন, রাজনৈতিক সহযোগীতার আশ্বাস পেয়ে সরকার পাল্টে দেয়ার হুংকারও দিয়েছিলেন, যদিও সেই হুংকার কাজে লাগেনি, বরং রাতের আঁধারে র‍্যাব-পুলিশের অভিযানে ঢাকা ছাড়তে হয়েছিল হেফাজতকেই। 

সেই আহমদ শফি ২০১৩ সালে নারীদের তেঁতুল হিসেবে উল্লেখ করে এক বিতর্কিত বক্তব্য দিয়েছিলেন। সেই বক্তব্যে আহমদ শফি বলেছিলেন, তেঁতুল দেখলে মানুষের যেমন জিভে জল আসে তেমনি নারীদের দেখলে ‘দিলের মইধ্যে লালা বাইর হয়’। আহমদ শফীর মতে, নারীদের কাজ হলো আসবাবপত্রের যত্ন নেওয়া, সন্তান লালন-পালন করা, ঘরের মধ্যে থাকা। তিনি আরও বলেছিলেন- ‘শোনো নারীরা, চার দেয়ালের ভেতরই তোমাদের থাকতে হবে। স্বামীর বাড়িতে বসে তোমরা আসবাবপত্র দেখভাল করবা, শিশু লালন-পালন, পুরুষ শিশুদের যত্ন করবা। এই হলো তোমাদের কাজ। তোমাদের কেন বাইরে যেতে হবে?’

হেফাজতের সাবেক আমির আহমদ শফি

আহমদ শফির সেই বক্তব্য নিয়ে তখন তুমুল সমালোচনা হয়েছিল, খোদ প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত নিন্দা জানিয়েছিলেন নারীদের প্রতি এমন অবমাননাকর বক্তব্যের। হাওয়া উল্টোদিকে বইছে বুঝতে পেরে হেফাজতে ইসলামও বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিল, আহমদ শফির বক্তব্যকে মিডিয়াতে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তিনি নারীদের অপমান করে কিছু বলতে চাননি, ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে তাতে শিক্ষিত এবং সচেতন নাগরিকদের মন গলেনি, আহমদ শফিকে অনেকেই তেঁতুল হুজুর হিসেবে সম্বোধন করেন তখন থেকেই। এরপরেও একবার মেয়েদের ক্লাস ফাইভের বেশি পড়াশোনা করা উচিত নয়- এমন কথা বলে বিতর্ক উস্কে দিয়েছিলেন আহমদ শফি। 

তেঁতুল তত্বের জন্মের সাত বছর পরে এসে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে একজন নির্বাচিত সাংসদ গতকাল আহমদ শফির সেই বক্তব্যকে সমর্থন করলেন প্রকাশ্যে। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের আইন নিয়ে কথা বলার সময় ধর্ষণের কারন হিসেবে নারীবাদীদের দায়ী করলেন, নারী স্বাধীনতাকে ধর্ষণের কারন হিসেবে উল্লেখ করলেন! রেজাউল করিম বাবলু নামের সেই সংসদ সদস্য, যিনি একজন আইন প্রণেতা, সাংসদ হবার আগে পেশায় একজন সাংবাদিক ছিলেন, তিনি এমন।জঘন্য কথাটা সংসদের মতো জায়গায় বলার আগে একবারও ভাবলেন না। ধর্ষণের দায় নারীর ওপর চাপিয়ে দেয়ার মতো একজন মানুষ এদেশের সাংসদ, এটা ভাবতেই তো মনে বিতৃষ্ণা জাগে। 

এমপি বাবলু বলেছেন, ‘এখানে কী দেখছি মাননীয় স্পিকার, নারীবাদীরা নারী স্বাধীনতার কথা বলে নারীদের উন্মুক্ত করে চলছে। যার কারণেই ধর্ষকেরা ধর্ষণের অনুভূতিকে এতটা একসেপ্ট করেছে যে, ধর্ষণে উৎসাহিত হচ্ছে। আমি যেটা বলবো, আমরা ইতোপূর্বে আল্লামা শফী সাহেবকে ‘তেঁতুল হুজুর’ বলে উল্লেখ করেছি মাননীয় স্পিকার। আল্লামা তেঁতুল হুজুরের তেঁতুল থিওরিটাও যদি কাজে লাগানো যেতো, তাহলে ধর্ষকেরা ধর্ষণ থেকে পিছপা হতো। ধর্ষণ থেকে তারা নিরুৎসাহিত হতো। তাদের ভেতরে ধর্মীয় অনুভূতি আসতো।’

সাংসদ রেজাউল করিম বাবলু

রেজাউল করিম বাবলু আহমদ শফিকে পছন্দ করতেই পারেন, তার চিন্তাভাবনার সাথেও একমত পোষণ করতে পারেন। কিন্ত তিনি যেটা জানেন না, সেটা হলো- আহমদ শফির তেঁতুল তত্বকে সমর্থন করা মানে নারীদেরকে হেয় করা। ধর্ষণের সঙ্গে তেঁতুল তত্বকে মেলানো মানে ধর্ষণের পেছনে নারীর পোশাককে, নারীর আচরণকে দায়ী করা। তেঁতুল তত্বের মাধ্যমে ধর্ষণের প্রতিকার চাওয়ার মানে হলো ধর্ষিতাকে অপমান করা। 

পর্দাপ্রথা কখনোই ধর্ষন ঠেকাতে পারবে না, এই সত্যিটা জনাব রেজাউল করিম বাবলু জানেন না, নয়তো মানেন না। তার ধারনা নারীরা পর্দা করা শুরু করলেই এদেশে ধর্ষণের হার শূন্যে নেমে আসবে। বোরকা পরে বাইরে বের হলেও এদেশে নারীকে নিপীড়নের শিকার হতে হয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান সব জায়গায় এই উদাহরন পাওয়া যাবে। মাদ্রাসায় যে এত এত ছাত্র বলাৎকারের শিকার হয়, সেটার কারন কি, এমপি বাবলু সাহেব কখনও ভেবেছেন? নাক মাদ্রাসার ছাত্রদেরকেও তিনি বোরকা পরতে বলবেন? নারী ঘরের বাইরে বের না হলে, পর্দার আড়ালে থাকলেই যদি নিরাপদে থাকতো, তাহলে তিন বছরের শিশু থেকে আশি বছরের বৃদ্ধাও ধর্ষণের শিকার হতো না। কিন্ত এসব ঘটনা বাবলু সাহেবের চোখে পড়বে না, তিনি বা তার মানসিকতার মানুষেরা শুধু কথার জোরে ধর্ষণের পেছনে নারীবাদ, নারীর স্বাধীনতা, নারীর পোশাক- এসবকেই দায়ী করে যাবেন। 

একজন সাংসদ, যিনি দেশের আইন প্রণয়নের কাজ করেন, তিনি যখন ফেসবুকে আলটপকা কমেন্ট করে বেড়ানো ব্যাকটেরিয়াদের সঙ্গে একই সুরে ধর্ষনের জন্য নারীদের দিকেই আঙুল তোলেন, তখন ব্যাপারটা অ্যালার্মিং হয়ে দাঁড়ায়। এদেশের নাগরিক হিসেবে লজ্জা হয় যে, এই মানসিকতার মানুষ জাতীয় সংসদে কয়েক লক্ষ জনগনের প্রতিনিধিত্ব করছেন! ধর্ষণের জন্য শুধু এবং শুধুমাত্র ধর্ষকের বিকৃত মানসিকতা দায়ী, ডান-বামের অন্য কোন কিছুই দায়ী নয়, সেই কথাটা রেজাউল করিম বাবলু সাহেব বুঝতে পারবেন, এটাই কামনা করি। 

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা