যুক্তি দিয়ে যিনি ইসলামের কথা বলেন, তার মুখে অযৌক্তিক এবং ভিত্তিহীন কথা মানায় কীনা- সেটা বিচারের ভার আপনাদের ওপরেই ছেড়ে দেয়া হলো।

বাংলাদেশে এই মূহুর্তে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিদের তালিকা করা হলে, মিজানুর রহমান আজহারী এদের মধ্যে একদম ওপরের দিকেই থাকবেন। ধর্মীয় ওয়াজ করে তার মতো জনপ্রিয়তা খুব কম বক্তাই পেয়েছেন এই দেশে। তিনি মৃদুভাষী, গুছিয়ে কথা বলেন, চিৎকার চেঁচামেচি করে আসর জমানোর চেষ্টা করেন না, অন্য কোন ধর্মকে আক্রমণ করর জনপ্রিয় হবার সস্তা রাস্তায় হাঁটেননি তিনি। তার মুখে অযৌক্তিক কথাবার্তা শোনা যায় না খুব একটা, বাংলা এবং ইংরেজীর মিশ্রণে পরিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন তিনি, যেটা ওয়াজের বক্তাদের মধ্যে একেবারেই বিরল দৃষ্টান্ত। 

তার জনপ্রিয়তার ছোট্ট একটা নমুনা দেয়া যাক। এক জেলা শহরে আজহারী গিয়েছেন ওয়াজ করতে, প্রচুর জনসমাগম। যে মাঠে ওয়াজের আয়োজন করা হয়েছে, সেটার প্রবেশ পথের বাইরে গাড়ি-রিক্সার যানজট লেগে গেছে। কারণ ওয়াজে আসা অনেকেই যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করেছেন। প্রশাসনের একজন মঞ্চে উঠে সেটা নিয়ে কথা বলতে গেলেন, অমনি জনতা অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলো। তাদের ধারণা, প্রশাসন থেকে লোক এসে আজহারীর ওয়াজ বন্ধ করে দিতে চাইছেন! 

শিক্ষিত শ্রেনীর লোকজনের মধ্যে নিজের একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করেছেন মিজানুর রহমান আজহারী। কিন্ত তিনিও যখন ভুলভাল রেফারেন্স তুলে একটা মিথ্যাকে সত্যি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান, কোন ধর্মের অল্প কিছু মানুষের কার্যক্রমকে পুরো ধর্মের বৈশিষ্ট্য বলে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন- তখন তাকে বাকীদের চেয়ে আলাদা মনে হয় না আর। 

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আজহারীর একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সম্প্রতি, সেখানে তাকে হিন্দু ধর্মের কিছু নিয়ম-কানুনের কথা বলতে শোনা গেছে। আজহারী বলেছেন, হিন্দুরা নাকী বিশ্বাস করে, ভালো হিন্দু হতে হলে তাকে গোমুত্র পান করতেই হবে। আরও বলেছেন, ছোট বাচ্চাদেরকে পবিত্র আর মেধাবী করতে চাইলে হিন্দু বাবা-মায়েরা নাকি তাদের সন্তানদের গোবরের স্তুপে ফেলেন, তাদের গায়ে গোবর মেখে রাখেন। বাচ্চা কান্নাকাটি করে গোবর মাখা অবস্থায় ছুটে এলে তাকে আবার ফেলা হয় ওই স্তুপে- এই হচ্ছে আজহারীর ভাষ্য। 

মিজানুর রহমান আজহারী

একদম শৈশব থেকে এই যুবক বয়স পর্যন্ত প্রচুর হিন্দু বন্ধুবান্ধব পেয়েছি। তাদের মধ্যে খাবারের বিধিনিষেধ মেনে চলা কট্টর ব্রাক্ষ্মণ পরিবারের সন্তান যেমন ছিল, তেমনই ছিল কায়স্থ, ছিল নিচে বর্ণের হিন্দুরাও। তাদের সঙ্গে খেলেছি, ঘুরে বেড়িয়েছি, পড়ালেখা করেছি, একসঙ্গে দুষ্টুমি করতে গিয়ে স্যারের হাতে মার খেয়েছি। এদের কাউকে, বা তাদের পরিবারের কাউকে কখনও গোমুত্র নিয়ে কথা বলতে শুনেছি বলেও মনে পড়ছে না। হিন্দু অধুষ্যিত পাড়ায় বছরের পর বছর বাস করেছি, কিন্ত কোনদিন কোন হিন্দু বাচ্চাকে 'পবিত্র কিংবা মেধাবী' করার উদ্দেশ্যে গোবরের স্তুপে ফেলে দিতে দেখিনি। কে জানে, তাদের মধ্যে হয়তো 'ভালো হিন্দু' ছিল না কেউ! 

ভারতের কিছু অঞ্চলে হিন্দুদের মধ্যে গোমুত্র পানের ব্যাপারটা প্রচলিত আছে। আজহারী যে বাচ্চাকে গোবরের স্তুপে ফেলে দেয়ার কথা বলেছেন, সেটাও ভারতের উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশের কিছু জায়গায় পালন করা হয়। কিন্ত এরা পুরো হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে না, মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের উদাহরণ টেনে কোন ধর্মকে অপমান করার অধিকার কাউকে দেয়া হয়নি, মিজানুর রহমান আজহারীকেও না। 

ইসলাম ধর্মেও শিয়া-সুন্নীদের ধর্ম পালন এক রকমের নয়, আহমদিয়ারা নিজেদের মুসলমান দাবী করেন, আবার সুন্নীরা তাদের কাফের-মুরতাদ বলেন। এখন কেউ যদি আহমদিয়াদের পালন করা রীতিনীতিকে ইসলামের রীতি-রেওয়াজ বলে দাবী করে ইসলাম ধর্ম নিয়ে ঠাট্টা-তামাশায় মেতে ওঠে, সেটা একজন মুসলমানের ভালো লাগার কথা নয়। খোদ হিন্দুদের মধ্যেই অনেকে গোমুত্র নিয়ে এসব বাড়াবাড়ির কড়া প্রতিবাদ করেন, ভ্রান্ত এসব নিয়মের প্রতিবাদ করেন। আজহারী সম্ভবত সেসব জানেন না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বক্তব্যের পরের অংশেই মিজানুর রহমান আজহারী ইসলামকে জ্ঞানের ধর্ম বলেছেন। জ্ঞানের ধর্মের প্রতিনিধি হয়ে তিনি এমন অজ্ঞতার কাজ কী করে করলেন, সেটা মাথায় ঢুকলো না। 

মিজানুর রহমান আজহারী শিক্ষিত মানুষ,  কট্টরপন্থী হুজুরদের মতো নয় তার চিন্তাভাবনা। তিনি বেকার তরুণদের উদ্যোক্তা হবার পরামর্শ দেন, তিন বলেন, ইসলাম কখনও জঙ্গীবাদের শিক্ষা দেয় না। বাকীরা যখন বলে বিধর্মীদের কতল করতে হবে, সেখানে দাঁড়িয়ে মাওলানা আজহারী বলেন, ধর্ম পালনের অধিকার সবার আছে, মুসলিম, হিন্দু খ্রিস্টান সবার। নিজের ওয়াজে দাঁড়িয়েই তিনি বলেন, রাত এগারোটার পর যেন আর মাইক না চলে, এলাকার শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ মানুষ বা পরীক্ষার্থীদের যাতে অসুবিধা না হয় মাইকের আওয়াজে। সেই একই মানুষ যখন মাইক্রোফোনের সামনে অন্য ধর্মকে মিথ্যা এবং ভ্রান্ত কথাবার্তা বলেন, তখন হতাশাটা বাড়ে। বিনোদনের যোগান দেয়া এন্টার-কটিক হুজুরদের সঙ্গে আজহারীর পার্থক্যটা তখন ধরা পড়ে না খুব একটা।

মিজানুর রহমান আজহারীর প্রচুর ভক্ত আছেন, হয়তো এই লেখাটা তাদের মেজাজ খারাপের কারণ হতে পারে। একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবুন, আজহারী একজন মানুষ, তার ভুল হতেই পারে। সেই ভুলটা ধরিয়ে দেয়ায় দোষের কিছু নেই। ভুল সংশোধন মানুষকে পরিণত করে, আর ভুলটা বারবার করতে থাকলে মানুষ অপরাধী হয়। যুক্তি দিয়ে যিনি ইসলামের কথা বলেন, তার মুখে অযৌক্তিক এবং ভিত্তিহীন কথা মানায় কীনা- সেটা বিচারের ভার আপনাদের ওপরেই ছেড়ে দেয়া হলো। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা