নাগোর্নো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে বিতর্কে জড়ায় দুই রাষ্ট্র আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান। যে বিতর্ক এখন রূপ নিয়েছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে, তুরস্ক আর ইরানও জড়িয়ে পড়েছে এই দুই দেশের দ্বন্দ্বে...

যারা ভূ-রাজনীতি নিয়ে মোটামুটি খোঁজখবর রাখেন, তারা সাম্প্রতিক সময়ের আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজানের সশস্ত্র বিক্ষোভ নিয়েও জানেন নিশ্চিতভাবেই। আর্মেনিয়া-আজারবাইজানের প্রধান দ্বন্দ্ব মূলত সাড়ে চার হাজার বর্গমিটারের বিতর্কিত পার্বত্য এলাকা নাগোর্নো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে। এই অঞ্চলকে বিতর্কিত বলার পেছনের কারণ, আর্মেনিয়া-আজারবাইজান সংঘর্ষের ইতিহাস, এই দুই রাষ্ট্রের পেছনে রাশিয়া ও তুরস্কের ইন্ধন, পুরোটা নিয়েই একটু জানার চেষ্টা করা যাক।

ইতিহাসের দিকে যদি তাকাই, দেখতে পাবো, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং পরবর্তীতে ঘটে যাওয়া বলশেভিক বিপ্লবের পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের শক্তি কমতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সিদ্ধান্তে নাগোর্নো-কারাবাখ অঞ্চলটি চলে যায় আজারবাইজানের সীমানায়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আর্মেনিয়ার নাগরিক। ফলে তখন থেকেই এই এলাকা বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। কারা শাসন করবে বা কাদের দখলে থাকবে এটি, সে নিয়ে অসন্তোষ চরমে ওঠে। আজারবাইজান কাগজেকলমে মালিক হলেও পুরো দখল থাকে আর্মেনিয়ার হাতে। সে সাথে এটাও প্রাসঙ্গিক তথ্য, আর্মেনিয়ার সাহায্যেই মূলত এ অঞ্চল এখনো চলছে। আশির দশকের শেষভাগে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছে, তখন নাগোর্নো-কারাবাখের প্রশাসন, আমেরিকার সাথে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে শুরু হয় এক বিশাল সংঘর্ষ। আর্মেনিয়ান আর তুর্কিরা সেই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ত্রিশ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায় এই যুদ্ধে। পরবর্তীতে যুদ্ধবিরতি হয়, বড় বড় রাষ্ট্রের মধ্যস্থতায়।

এরইমধ্যে আর্মেনিয়ানরা এই পার্বত্য অঞ্চলের দখল নিয়ে নেয় এবং নাগোর্নো-কারাবাখকে 'স্বাধীন' ঘোষণা করে। কিন্তু স্বাধীনতার এই ঘোষণা মেনে নেয় নি আজারবাইজান ও তুর্কিরা। থেমে থেমে সংঘর্ষ তখন থেকেই চলছে। ২০১৬ সালেও হয়েছিলো এক ছোটখাটো যুদ্ধ। মারা গিয়েছিলো দুইশোজন সাধারণ মানুষ ও ডজনখানেকেরও বেশি সৈন্য!

সাম্প্রতিক বছরের জুলাইতে বিক্ষোভ আবারো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তখন মোটামুটি প্রানহানি হলেও সবার আশা ছিলো বড়সড় সংঘাতের দিক যাবে না বিষয়টি। আগের সময়গুলোতে বড় বড় মোড়ল রাষ্ট্রগুলো যেমন শান্তি বজায় রাখতে মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে এসেছিলো। এবারও হয়তো আসবে। কিন্তু বিশ্বনেতাদের নজর এবার অন্য দিকে। করোনা, লেবাবন, বেলারুশ, আমেরিকার নির্বাচন... সবকিছু মিলিয়ে বেশ ব্যাকফুটে নাগার্নো-কারাবাখের এই ইস্যু। এ কারণেই সেপ্টেম্বরের দিকে এসে দুই দেশের সংঘর্ষ বেশ বড়সড় আকার ধারণ করেছে। আর্মেনিয়ার আক্রমণের জবাবে আজারবাইজান এবার সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে বেশ আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে। দুই দেশই ঐ অঞ্চলে সামরিক আইন জারি করার পাশাপাশি ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হয়েছে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি শুরু হওয়া যুদ্ধে দুইপক্ষ মিলিয়ে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯৫ জন নিহত হয়েছেন।

নাগোর্না কারাবাখে ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে ভারী অস্ত্রশস্ত্রের মহড়া! 

ইতিহাসের আদিলগ্ন থেকেই আজারবাইজানকে মদদ দিচ্ছে তুরস্ক। যে মদদ বজায় আছে এখনো। যার ফলশ্রুতিতে আর্মেনিয়ার একটি যুদ্ধ বিমান ধ্বংসের জন্যে আর্মেনিয়া অভিযুক্ত করেছে তুরস্ক'কে। সে সাথে তারা এটিও অভিযোগ করেছে, তুরস্ক এই যুদ্ধে সরাসরি সাহায্য করছে আজারবাইজানকে। যদিও তুরস্ক সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তারা কোনো যুদ্ধের মধ্যে নেই। এবং সে সাথে এটিও তারা স্পষ্ট বলে দিয়েছে, নাগোর্নো কারাবাখ অঞ্চলটি আজারবাইজানের। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তারাই এই অঞ্চলের প্রকৃত শাসক। আর্মেনিয়ার মানুষজন সেই অঞ্চলটিকে বেআইনিভাবে দখল করে আছে। যেটিকে তুরস্ক মোটেও ভালো চোখে দেখছে না। তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুলুসি আকার বিবৃতিতে জানিয়েছেনও, দরকার হলে আজারবাইজান কে পুরোপুরি সহায়তা করবেন তারা।

ওদিকে রাশিয়ার সাথে আর্মেনিয়ার বেশ ভালোই দহরম মহরম। সামরিক চুক্তিও আছে দুই দেশের মধ্যে। এ কারণে কেউ কেউ আশা করছেন, তুরস্ক যদি বেশি বাড়াবাড়ি করে, হয়তো রাশিয়াও যুদ্ধমঞ্চে অবতীর্ণ হবেন। তবে সেক্ষেত্রে রাশিয়ার স্ট্রাটেজি কী হবে, সেটা একটু ভাবনার বিষয়। যদি রাশিয়া সামরিক যুদ্ধে জড়ায়, সেটি ঝামেলা বাড়াবে।  তুরস্কের বেশ বড়সড় সামরিক সৈন্যবহর থাকলেও পারমানবিক শক্তিধর রাশিয়া প্রতিপক্ষ হিসেবে বরাবরই অতীব শক্তিধর হিংস্র প্রতিপক্ষ।

তবে কিছুদিন ধরে রাশিয়া একটু ব্যাকফুটে আছে। প্রেসিডেন্ট পুতিনের কড়া সমালোচক নাভালনিকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগের তীর আসছে পুতিনের দিকে। এ অবস্থায় রাশিয়ার ইম্প্রেশন টা ভালো করা একটা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়া যদি এই দুই দেশের মধ্যে শান্তি আনতে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখতে পারে, তাহলে তারা বিশ্বমঞ্চে যে বেশ ভালোভাবেই প্রশংসিত হবেন এবং আগের নেগেটিভ ইস্যুগুলোকে গোপন করা যাবে, সে বলাই বাহুল্য। রাশিয়া তাই এভাবেই যুক্ত হতে পারে যুদ্ধের সাথে। এবং রাশিয়া এরমধ্যেই যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে দুইপক্ষকে।

বিশ্বমঞ্চের নজর থাকবে পুতিন ও এরদোয়ানের দিকেও!  

বিশ্বনেতারাও আস্তে আস্তে নড়েচড়ে বসছেন। এই বিতর্কিত অঞ্চল এবং সেই অঞ্চলকে ঘিরে দুটি রাষ্ট্রের সম্মুখ সমরের রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি ভাবাচ্ছে প্রায় সবাইকেই। পরিস্থিতি এখন কোনদিকে যায়, সেটিই দেখার বিষয়৷

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা