এই বয়সে দেশের জন্য কী না করেছেন আয়মান সাদিক! আজ সেই তাকেই যখন 'দয়া করে আমাকে বাঁচতে দিন' বলে মিনতি করতে দেখি, তখন অদ্ভুত একটা হাহাকার আর বিতৃষ্ণায় ছেয়ে যায় হৃদয়..

আইবিএ থেকে গ্র‍্যাজুয়েশন করে সিংহভাগ ছাত্র-ছাত্রীই কর্পোরেট দুনিয়ায় নাম লেখায়, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীগুলো লুফে নেয় এসব ছেলে-মেয়েদের। মোটা বেতন, হাজারো সুযোগ-সুবিধা, চাকচিক্যময় জীবন- সবকিছুই হাতের নাগালে থাকে। সেখানে আয়মান সাদিক নামের এই তরুণ ভিন্ন পথে হেঁটেছিলেন, অন্যরকম কিছু করতে চেয়েছিলেন, হতে চেয়েছিলেন শিক্ষক। তিনি চেয়েছিলেন অনলাইনে এমন একটা প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে, যেখানে বিভিন্ন বয়সের মানুষজন একদম বিনা মূল্যে নানা কিছু শিখতে পারবে। সেটা ভাষা শিক্ষা থেকে শুরু করে ক্লাসের পড়াশোনা- সব কিছু। 

অন্য কোন দেশ হলে এই তরুণকে মাথায় তুলে রাখা হতো। সরকারী-বেসরকারী নানা প্রতিষ্ঠান তার সঙ্গে এক হয়ে কাজ করতো, দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বড়সড় ভূমিকা থাকতো তার। তবে যেহেতু দেশটার নাম বাংলাদেশ, সেখানে গুণীর কদর হবে না- এটাই স্বাভাবিক। কর্পোরেট ক্যারিয়ার ছেড়ে প্রচলিত রাস্তায় না গিয়ে যে তরুণ অনলাইনে একটা বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন, সেই আয়মান সাদিককে যখন আজ ফেসবুক-ইউটিউবে নিজের ধর্ম পরিচয় দিয়ে বলতে হচ্ছে যে তিনি মুসলমান, নামাজ পড়েন, তিনি নাস্তিক নন- তখন খুব একটা অবাক লাগে না আসলে। অজস্র পটেনশিয়াল মৌলবাদিতে ভরা এই দেশে তো এমনটাই হবার কথা ছিল! 

বিতর্কের শুরুটা হয়েছিল আয়মানের গড়া টেন মিনিটস স্কুলের সাবেক কর্মী শামির মোন্তাজিদের একটা ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে। নিজের প্রোফাইল থেকে সমকামিতাকে সমর্থন জানিয়ে একটা ছবি আপলোড দিয়েছিলেন তিনি। তার সেই ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে 'ফেসবুক মুমিন'দের তর্জন গর্জন শুরু হয়ে গিয়েছিল, নব্বই পার্সেন্ট মুসলমানের দেশের নাগরিক হয়ে সমকামিতা নিয়ে কথা বলার ধৃষ্টতা দেখানোর অপরাধে শামির মোন্তাজিদের 'কল্লা' কেটে ফেলতে চেয়েছে অনেকেই। 

শামির যেহেতু দেশের বাইরে থাকেন, তাকে কোপানোর সুযোগ সুবে বাংলার ধর্ম রক্ষা কমিটি পাচ্ছে না। আর তাই স্বভাবতই ঘৃণা প্রকাশের ঢেউটা এসে আছড়ে পড়েছে শামিরের সাবেক প্রতিষ্ঠান টেন মিনিটস স্কুলের ওপর। আয়মান সাদিক এবং তার সহকর্মীরা কবে কোন ভিডিওতে কি বলেছেন, কে কবে কোন পোস্টে কি কমেন্ট করেছেন, সেসব খুঁজে বের করা শুরু হলো। কনসেন্ট এবং পিরিয়ডের ট্যাবু নিয়ে দুটো ভিডিও বানানো হয়েছিল টেন মিনিটস স্কুল থেকে, সেগুলোকে কেন্দ্র করে দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠলো, যে আন্দোলনের অস্ত্র হচ্ছে ঘৃণা। পিরিয়ড আর কনসেন্ট নিয়েও যে কারো আপত্তি থাকতে পারে, সেটা এই মাথামোটা লোকগুলোকে না দেখলে জানা হতো না। 

আয়মান সাদিক

ধর্মান্ধদের ক্রমাগত হুমকির মুখে বাধ্য হয়ে আয়মান সাদিক এবং তার সহকর্মী সাকিব বিন রশিদ ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ক্ষমা চেয়েছেন, কোন অপরাধ না করেই! সাকিবের পোস্টের শেষ অংশটা পড়লেই বুঝতে পারবেন অবস্থা কতটা ভয়াবহ, তিনি লিখেছেন, এসব হুমকির কারণে নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে নিয়ে তিনি চিন্তিত। এদেশে 'নাস্তিক' ট্যাগ দিয়ে এর আগে গন্ডায় গন্ডায় মানুষকে কুপিয়ে মারা হয়েছে, বিচার হয়নি একটা ঘটনারও। বরং অজস্র মানুষ সেসব হত্যাকান্ডকে জাস্টিফাই করেছে, যেন নাস্তিকের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই! কাজেই আয়মান বা সাকিবরাও যে এরকম আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হতে পারতেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। 

দোষ না করেও ক্ষমা চেয়েছেন, বলেছেন- দয়া করে বাঁচতে দিন! তবু থামেনি ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ। উঠেছে টেন মিনিটস স্কুলকে বয়কট করার ডাক, ইউটিউব আর ফেসবুকের কমেন্টবক্সের নিচে বসেছে নোংরা গালিগালাজের মেলা। সেসব আয়মান সাদিকের পরিবারের সদস্যরাও দেখেছেন, তারা ভয় পেয়েছেন। ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। আমেরিকার নাগরিকত্ব থাকা অভিজিৎ রায়কে প্রকাশ্যে কুপিয়ে মারা হয়েছে, একইভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন আরও অনেক ব্লগার- আমরা বিচার করতে পারিনি, পারিনি নিরাপত্তা দিতে। 

কাল আয়মান বা সাকিবরা এভাবে মরে পড়ে থাকলেও তাদের আপনজন ছাড়া আর কারো কিছু আসবে যাবে না। তদন্তের নামে সময়ক্ষেপণ হবে, আর একটা দল হত্যাকান্ডকে জাস্টিফাই করবে। কাজেই আয়মান আবার একটা ভিডিও বানিয়েছেন, করজোড়ে প্রার্থনা করেছেন এসব নোংরামি বন্ধ করার জন্য। আয়মান বলেছেন, "আমি কখনো ভাবি নি আমাকে পাবলিকলি নিজের ধর্মের হিসাব দিতে হবে। হ্যাঁ, আমি মুসলিম। আমাকে বাঁচতে দিন। আমার বাবা-মা কিছুক্ষণ পরপর আমাকে দেখে যাচ্ছে।"

ভিডিওটা দেখে হতাশ হয়েছি, একটা খারাপ লাগা কাজ করেছে, প্রশ্ন জেগেছে মনের ভেতর- ধর্মনিরপেক্ষতা আর সব মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার শপথ নিয়ে যে দেশটা স্বাধীন হয়েছিল, সেই দেশটা এখন কোটি কোটি ধর্মান্ধ মানুষে কীভাবে ভরে গেল? 

আয়মানের কথা ভেবে খারাপ লাগার পরিমাণটা আরও বেড়েছে। এই তরুণ প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে সাধারণ ছাত্রদের জন্য, সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলেন, করেছেনও। যাতে কোচিং সেন্টারের মোটা অংকের ফি না দিয়েই শুধু ইন্টারনেট ব্যবহার করে ছাত্র-ছাত্রীরা পড়ালেখা করতে পারে। সস্তা বিনোদন, আড্ডাবাজি আর নোংরামির চর্চায় যে ফেসবুক-ইউটিউব ভরে উঠেছিল, সেই প্ল্যাটফর্মকে পাঠশালায় পরিণত করেছিলেন আয়মান। 

টেন মিনিটস স্কুলের ভিডিওতে আয়মান সাদিক

একদিন দুইদিনে সম্ভব হয়নি এই কাজটা, বছরের পর বছর ধরে শ্রম দিয়েছেন আয়মান এবং তার দল, কত বসন্ত পেরিয়ে, শ্রম আর সাধনার প্রহর শেষে টেন মিনিটস স্কুল আজকের জায়গায় এসেছে। রবির মতো প্রতিষ্ঠান তাদের সঙ্গে যুক্ত আছে অনেকদিন ধরেই, দেশজুড়ে লাখ লাখ শিক্ষার্থী উপকৃত হয়েছে, হচ্ছে টেন মিনিটস স্কুলের মাধ্যমে। 

ব্যক্তি আয়মানের কথাও একবার ভাবুন। শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য খুব স্বল্প সময়েই তিনি পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা। বৃটেনের কুইন্স ইয়ং লিডার অ্যাওয়ার্ড ২০১৮ জিতেছেন, ইংল্যান্ডের মহারানীর হাত থেকে গ্রহণ করেছেন এই সম্মাননা। ব্র্যাক ম্যানথান ডিজিটাল উদ্ভাবন পুরস্কার, গ্লোমো পুরস্কার, বার্সেলোনা সামাজিক প্রভাবের জন্য সুইস দূতাবাস পুরস্কার, ইয়ুথ এওয়ার্ড ২০১৬- সহ জিতেছেন আরও অনেক অ্যাওয়ার্ড। 

ফোর্বসের থার্টি আন্ডার থার্টি'র তালিকায় নাম এসেছে তার, এশিয়ার সেরা ত্রিশ তরুণ উদ্যোক্তাদের একজন হিসেবে ফোর্বসের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন আয়মান। আজ সেই তরুণকে যখন 'দয়া করে আমাকে বাঁচতে দিন' বলে মিনতি করতে দেখি, তখন অদ্ভুত একটা হাহাকার আর বিতৃষ্ণা ছাড়া হৃদয়ে আর কিছুই জন্মায় না।

বিদ্যানন্দের মতো চমৎকার একটা উদ্যোগের প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার দাসকে আমরা অপমান করেছি তিনি হিন্দু হবার কারণে, তাকে ইসকনের সদস্য বানিয়ে দিয়েছি, তার অবদানকে নোংরাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। এদেশের কিশোর-তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য অসামান্য অবদান রেখেও এখন আয়মান সাদিককে অপরাধ না করেও প্রাণভিক্ষা চাইতে হচ্ছে। এই দেশ আসলে আয়মান বা কিশোর কুমার দাসের মতো মানুষগুলোকে ডিজার্ভই করি না। মেধার মূল্যায়নের বেলায় সবচেয়ে নিকৃষ্ট অবস্থানে যে দেশের নাগরিকরা থাকে, সেদেশের মেধা বিদেশে পাচার হওয়াই বরং ভালো...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা