ম্যারিজ রেজিস্ট্রারের লিখিত পরীক্ষা এবং সাক্ষাৎকার- দুটোতেই হয়েছেন উত্তীর্ণ। কিন্ত মন্ত্রণালয় বলেছে, কোন নারীকে তারা এই পদে নিয়োগ দেবে না। হাইকোর্টের বিচারকেরাও দিয়েছেন একই রায়। কিন্ত আয়রন লেডি আয়েশা সিদ্দিকা হাল ছাড়ছেন না, সিস্টেমের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধটা থামছে না এখনই...

আয়েশা সিদ্দিকার যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল আজ থেকে সাত বছর আগে, ২০১৪ সালে। তবে ঘটনাক্রম শুরু হয়েছে এরও দুই বছর আগে। দিনাজপুরের ফুলবাড়িয়া পৌরসভার আয়েশা সিদ্দিকা ফাজিল পাশ৷ তিনটি ওয়ার্ডের জন্য নিকাহ রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে তিনি নিয়ম মেনেই আবেদন করেছিলেন৷ পরীক্ষাও দিয়েছেন৷ পরীক্ষায় তিনি হয়েছিলেন প্রথম৷ তারপর তাকে ডাকা হয় ইন্টারভিউতে। সেখানেও তিনি পাশ করেছেন ভালোভাবে। কিন্ত মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, কোন মহিলাকে তারা নিকাহ রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ দেবে না। সব যোগ্যতা থাকা স্বত্বেও শুধুমাত্র 'নারী হওয়ার অপরাধে' বাতিল করা হয় তার নিয়োগ প্রক্রিয়া। 

নিকাহ রেজিস্ট্রার হওয়ার জন্য সরকারি প্রজ্ঞাপনে তিনটি যোগ্যতার কথা বলা হয়েছিল। সেগুলো হচ্ছে-

১.সরকার স্বীকৃত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা মাদ্রাসাবোর্ডের নিবন্ধিত কোনো মাদ্রাসা থেকে কমপক্ষে আলিম সার্টিফিকেটধারী হতে হবে

২. বয়স কমপক্ষে ২১ এবং  সবোচ্চ ৪৫ বছর হতে হবে

৩. সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দা হতে হবে

এই তিন যোগ্যতাই আছে আয়েশা সিদ্দিকার৷ তারপরও নারী হওয়ায় প্রথমে মন্ত্রণালয় তাকে এই পদে নিয়োগ দেয়া হয়নি। 

আয়েশা সিদ্দিকার কথা হচ্ছে, "বিজ্ঞপ্তির কোথাও বলা হয়নি নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে হলে পুরুষ হতে হবে৷ আর আমি ফাজিল পাশ৷ আলিমেরও এক ধাপ উপরে৷ তারপরও আমি কেন পারব না? তারা যা বলছেন তা আইনের ভাষা নয়৷ শুধু পুরুষের জন্য হলে আমি নিশ্চয়ই আবেদন করতাম না। তাছাড়া তারা সবাই তো জানতেন আমি একজন মহিলা, এরপরেও তো আমাকে ইন্টার্ভিউতে ডাকা হলো?" একারণে ন্যায়বিচারের জন্য তিনি আদালতের দ্বারস্থ হন, করেন রিট। কিন্ত ২০২০ সালে আদালতও জানিয়ে দেয়, বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় নারীরা ম্যারিজ রেজিস্ট্রার হতে পারবেন না৷ 

আয়েশা সিদ্দিকা

দুই দিন আগে সেই রিটের পূর্নাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়েছে৷ বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের এই রায়ে বলা হয়েছে, ‘‘নারীরা মাসের একটি নির্দিষ্ট সময় ফিজিক্যাল ডিসকোয়ালিফেশনে থাকেন৷ সেক্ষেত্রে মুসলিম বিবাহ হচ্ছে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং আমাদের দেশে বেশিরভাগ বিয়ে মসজিদে পড়ানো হয়ে থাকে৷ ওই সময়ে নারীরা মসজিদে প্রবেশ করতে পারেন না এবং তারা নামাজও পড়তে পারেন না৷ সুতরাং বিয়ে যেহেতু একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সেহেতু এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে নারীদের দিয়ে নিকাহ রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়৷ ফলে নারীরা নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজী) হতে পারবেন না৷''

দুই বিচারক যে ইস্যুটিকে সামনে এনেছেন, সেটির নাম রজঃস্রাব। একজন নারীকে পূর্ণতা দেয়ার শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, সেটাকেই তারা ম্যারিজ রেজিস্ট্রার পদে নারীর 'ফিজিক্যাল ডিসকোয়ালিফিকেশন' হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্ত এই রায়ে যেভাবে বলা হয়েছে, এবং ম্যারিজ রেজিস্ট্রারের বাস্তবে যে কাজ- তার মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। আদালত তার দেয়া বলেছেন, বেশিরভাগ বিয়ে মসজিদে পড়ানো হয়। একারণে মাসের একটা নির্দিষ্ট সময়ে মসজিদে গিয়ে বিয়ে পড়ানো সেই নারীর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্ত বাস্তবতা হচ্ছে, ম্যারিজ রেজিস্ট্রারের কাজ বিয়ে পড়ানো নয়, বিয়ে রেজিস্ট্রি করা৷ নিকাহ রেজিস্ট্রার বিয়েটাকে আইন অনুযায়ী রেজিস্ট্রেশন করবেন৷ এজন্য নিকাহ রেজিস্ট্রারকে বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়া বাধ্যতামূলক নয়৷

এই রায়ের পর আয়েশা সিদ্দিকাও একই কথা বলেছেন, ‘‘আমার কাজ তো বিয়ে পড়ানো নয়৷ বাংলাদেশে মসজিদে অধিকাংশ বিয়ে হয়, এই বিষয়টিও ঠিক নয়, কিছু বিয়ে হতে পারে৷ সেক্ষেত্রে আমি বিয়ে পড়ানোর জন্য প্রয়োজনে পুরুষ মাওলানা পাঠাতে পারতাম৷ নারী হিসেবে আমার যে শারীরিক অক্ষমতার কথা বলা হয়েছে সেটা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিনা৷ নারী প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, পাইলট হতে পারেন৷ তাহলে আমি কেন নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে পারব না৷''

ছবিতে হাইকোর্ট

এই আদেশের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই আপিলের আবেদন করেছেন আয়েশা সিদ্দিকা৷ আর সেই আপিলে আইনজীবী হিসেবে যুক্ত হয়েছেন ফাউন্ডেশন ফর ল' অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিম৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা আদালতের এই রায় মানতে পারছিনা বলেই আপিল করেছি৷ আইনে নিকাহ রেজিস্ট্রারের যোগ্যতা এবং কাজ সুনির্দিষ্ট করে দেয়া আছে৷ তিনি বিয়ে রেজিষ্ট্রি করবেন, সিগনেচার নেবেন৷ ডিভোর্সের ক্ষেত্রেও তাই৷ তাদের কোনো ধর্মীয় কাজ নাই৷ আর আইনে কিন্তু কাজি শব্দটি নাই৷ রেজিস্ট্রার বলা আছে৷ কাজি হলো বিচারক৷ বিচারকও যদি হয়  আমাদের তো অনেক নারী বিচারক আছেন৷''

যে দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধীদলীয় নেত্রীরা নারী, স্পিকার নারী। অথচ সেদেশে একজন নারীকে শারীরবৃত্তিয় কারণে 'আনফিট' ঘোষণা করে একটা চাকরির ক্ষেত্র থেকে বঞ্চিত করা হবে? আয়েশা সিদ্দিকা মাদ্রাসা মিডিয়ামে পড়শোনা করেছেন, উচ্চ ডিগ্রি আছে তার, আছে নিকাহ রেজিস্ট্রার হবার সব যোগ্যতা। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রতিক্রিয়াশীলতা প্রতিবাদ করে, আপত্তি জানায়। অথচ আয়েশা সিদ্দিকাকে কোন প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী বা ব্যক্তি বাধা দেয়নি, তাকে বাধা দিচ্ছে এই রাষ্ট্রের সিস্টেম, রাষ্ট্রের আইন। একজন নারীর মাসিক বা রজঃস্রাব হচ্ছে বলে তাকে একটা চাকরির জন্য 'ফিজিক্যালি ডিসকোয়ালিফায়েড' বলা হবে, এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। 

আয়েশা সিদ্দিকা অবশ্য এত সহজে লড়াইটাতে হার মানছেন না। দিনাজপুর থেকে উঠে আসা এই নারী মন্ত্রণালয়ে প্রত্যাখ্যাত হবার পর আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন, হাইকোর্টের রায় নিজের পক্ষে না আসার পরেও আশা ছাড়ছেন না, আপীল করবেন উচ্চ আদালতে। নারী বলে কাউকে নির্দিষ্ট একটা পেশা থেকে 'আনফিট' হিসেবে ঘোষণা করাটা গোটা নারী জাতির প্রতিই অবিচারের শামিল। আয়েশা সিদ্দিকা কয়েক বছর ধরেই লড়ে যাচ্ছেন সেই অবিচারের বিরুদ্ধে, প্রয়োজনে লড়বেন আরও দীর্ঘ সময় ধরে। এই আয়রন লেডির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা, আয়েশা সিদ্দিকাকে স্যালুট! 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা