সিএনজিতে করে যেই সাংবাদিক ভদ্রলোক মানুষটার ছিদ্র হয়ে যাওয়া মাথাটা কোলের মধ্যে চেপে ধরে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি তার বর্ণনায় লিখেছেন দাদার মাথার খুলির অংশটা ধারালো হয়ে ভদ্রলোকের পাঞ্জাবী ছিঁড়ে ফেলছিলো। দাদার মগজ খুলি থেকে বারবার ছিটকে বের হয়ে আসছিলো। আর গলগল করে রক্ত পড়ছিলো।

ছাপোষা মধ্যবিত্তদের আন্দোলনগুলো সাধারণত হয় স্বপ্নিল আন্দোলন। যেই আন্দোলনে ভয়-ডর নেই, যেই আন্দোলনে রাজপথে থাকার ঝামেলা নেই, যেই আন্দোলনে আমরণ-অনশন নেই, যেই আন্দোলনে পুলিশ এসে বেঁধে নিয়ে যায় না- এসমস্ত আন্দোলনই আমাদের পছন্দ। একটু যদি গতর খাটা লাগে, একটু যদি নিজের কমফোর্ট জোন থেকে বের হয়ে আসার দরকার পড়ে, তাহলেই আর পরেরদিন আমাদের পাওয়া যায় না।

এসবের কারণও আছে। এই দেশে একটা জীবন দাঁড় করাতে অনেক কষ্ট। কোন আন্দোলনে গিয়ে একবার কোন ‘ঝামেলায় পড়ে গেলে’ কিংবা ‘ধরা’ খেয়ে গেলে বহু কষ্টের চাকরিটা চলে যায়, অনেক দিনের সম্মানটা চলে যায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দেয়। জীবনের এক একটা বছরের অনেক দাম। একজনের পড়ালেখা শেষ হবার ওপর নির্ভর করে আরেকজনের রিটায়ারমেন্ট। একটা চাকরির ওপর নির্ভর করে অনেকগুলো মানুষের খাওয়া-পরা।

নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্যের এলাকায় থাকলে আমরা অনেক বড় বড় কথা বলি। আমাদের কথার ভারে আর মাহত্ত্বে মাঝেমধ্যে ফেসবুক ফেটে যায়। সেটাকে তখন রিপেয়ার করতে হয়। নিজেকে নিরাপদে রেখে বাঘের খাঁচায় ঢিল মারা খুব সহজ, একটু খুঁচিয়ে দেয়াও একরকম আরামের অনুভূতি দেয়। নিজের কাপুরুষ স্বত্বা বুকের খাঁচা ভেঙ্গে বেরিয়ে এসে হুংকার দেয়ার যে আপ্রাণ প্রয়াস চালায়, ফেসবুকে এসে আমরা সেটা উগলে দেই।

গন-জাগরন মঞ্চ বইমেলার একটু সামনের একটা জায়গায় অভিজিৎ রায়ের একটা বড় ছবি টানিয়ে রেখেছে। সেই জায়গাটা, যেখানে একজন নিরীহ চিন্তককে সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থায় ৫-৬ জন ধারালো চাপাতধারী কুপিয়ে, কুপিয়ে জখম করে রেখে যায়। সিএনজি করে যেই সাংবাদিক ভদ্রলোক মানুষটার ছিদ্র হয়ে যাওয়া মাথাটা কোলের মধ্যে চেপে ধরে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি তার বর্ণনায় লিখেছেন দাদার মাথার খুলির অংশটা ধারালো হয়ে ভদ্রলোকের পাঞ্জাবী ছিঁড়ে ফেলছিলো। দাদার মগজ খুলি থেকে বারবার ছিটকে বের হয়ে আসছিলো। আর গলগল করে রক্ত পড়ছিলো।

যেখানে হামলার শিকার অভিজিৎ, বন্যা

সেই ফটোগ্রাফার ভদ্রলোক, সেই সিএনজি চালক। তারা তো আমার চাইতে সাহসী তাই না? তারা তো নিজেদের কমফোর্ট জোনে বসে বসে #I_AM_AVIJIT স্ট্যাটাস দিয়ে অন্য ইস্যুতে ঢুকে পড়ে নাই। নিজের পাঞ্জাবী ফুটো করে আমার ভাইয়ের রক্তাক্ত মুণ্ডুটা ধরে বসে ছিলেন। অথচ এত যে ভাই ভাই করি, তখন তো আমি সেখানে ছিলাম না।

না গণজাগরণ মঞ্চ এর পরের তিন দিনের লাগাতার কর্মসূচিতেও আমি ছিলাম না। আজকে অভিজিৎ রায়কে নিয়ে বানানো প্রায় সবগুল ব্যানার ফেস্টুনে যেই ছবিটা দেখেন সেই ছবিটা তোলা হয়েছিলো আমার বইয়ের প্রকাশনা উৎসবের দিন। গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী সঞ্জীবন সুদীপের ক্যামেরায় তোলা।

অভিজিৎ দা ঢাকা মেডিক্যালে থাকেন এখন, সেখানে থাকেন আমার খুব প্রিয় আরও একজন কণ্ঠশিল্পী সঞ্জীব চৌধুরী। মাঝে মাঝে মনে হয় যাই একটু দেখে আসি। দেখার কোন সিস্টেম আছে কি না জানি না। বিশ্বাস করবেন একবার গিয়েছিলাম মেডিক্যালে। ভেতর পর্যন্ত গিয়ে কাউকে জিজ্ঞাসা করার সাহস হয়ে ওঠে নাই অভিজিৎ রায়কে তারা কোথায় রেখেছে। আমি এতই সাহসী। 

আমি বলতে পারি না। আমি চিৎকার করে বলতে পারি না যে- অভিজিৎ রায়কে তোমরা মেরে ফেলেছো, অভিজিৎ রায়কে আমরা মেরে ফেলেছি। অভিজিৎ রায়ের রক্ত আমাদের সকলের হাতে, অভিজিৎ রায়ের লাশের ভার আমাদের সকলের বইতে হবে। আজকের কমফোর্ট জোনে থাকা নিষ্ক্রিয় সকল মানুষের বিচার করতে হবে। শুধু ধারালো অস্ত্র দিয়ে দুটো পোচ দিলেই কি খুন হয়? সারা বইমেলা চত্তরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা নেয়া মানষের দায় নাই? অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর পরের দিন সারা ঢাকা শহরের কোটি কোটি মানুষ যে রাজপথে নেমে এসে ধিক্কার জানায় নাই সেটার দায় নাই? দেশের সমস্ত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মরচে ধরা তরুণদের দায় নাই? সেটার বিচার কে করবে? কোন আদালত?

স্মরণে অভিজিৎ রায়

অর্থহীন এই লেখাটা শেষ করে দেই। শেষে একটা গল্প শোনাই। গল্পের রেফারেন্স দিতে পারবো না, তবে বহুল প্রচলিত বলেই জানি। মুসলিম সাধক মনসুর হাল্লাজ হঠাৎ নিজেকে ‘আনাল হক’ বলে দাবী করে ওঠ যার মানে করলে দাঁড়ায় ‘আমিই সত্য’। এদিইকে আরবীতে হক শব্দের আরেক মানে আল্লাহ। তখনকার মোল্লারা মনসুর হাল্লাজের বিরুদ্ধে শিরকের অভিযোগ ওঠায়। অভিযোগের ফলে অপরাধ অনুযায়ী তার রায় হলো মৃত্যুদন্ড কিন্তু এর স্বপক্ষে ১০১ জন আলেমের স্বাক্ষর বাধ্যতামূলক। 

অভিযোগকারীরা ১০০ জন আলেমর স্বাক্ষর গ্রহন করতে পেরেছিল, আর দরকার মাত্র ১ জন। অভিযোগকারীরা যখন হতাশ তখন মনসুর হাল্লাজ নিজেই ১০১ নম্বর আলেম হিসেবে স্বাক্ষর করেছিলেন। বলেছিলেন ‘তোমরা তোমাদের শরিয়তের নিয়ম পালন কর’। মনসুর হাল্লাজেকে যখন ১০০ টুকরো করে মৃত্যুদন্ড কর্যকর করা হয় তখন তার প্রত্যেকটা টুকরো থেকে ‘আনাল হক’ উচ্চারিত হতে থাকলো।

অভিজিৎ রায় এবং তার পরবর্তী সমস্ত হত্যাকাণ্ডের পেছনে এই দেশের কোটি কোটি নাগরিকের সাথে আমার নিষ্ক্রিয়তাও দায়ী। এ অভিযোগে সমস্ত শাস্তি আমি মাথা পেতে নেবো। যে কোন মুহূর্তে যে কোন উপায়ে আমার মৃত্যুর আগে এবং পরে আমার জীবনের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য একটাই। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারির পরে গোটা জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য একটাই।

‘অভিজিৎ হত্যার বিচার চাই’

‘অভিজিৎ হত্যার বিচার চাই’

‘অভিজিৎ হত্যার বিচার চাই’

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা